শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

\\\'বউ কথা কও\\\' পাখি

আ শ ম বাবর আলী

\\\'বউ কথা কও\\\' পাখি

'বউ কথা কও' পাখিকে তোমরা সবাই নিশ্চয়ই চিন। তাই না? হলুদ রঙের পাখিটি। গাছের ডালে বসে সারাদিন 'বউ কথা কও'- 'বউ কথা কও' করে ডেকে ডেকে গলা ফাটায়। এই 'বউ কথা কও' পাখিটির আদি পুরুষের জন্ম কেমন করে হলো তোমরা হয়তো তা জান না। শুনতে খুব ইচ্ছা হয়, তাই না? আচ্ছা তবে শোন-

অ-নে-ক দিন আগের কথা।

এক দেশে ছিলেন এক রাজা। তার ছিল এক বিশাল সাম্রাজ্য। যেমন ছিল তার সেনাবল, তেমনি ছিল তার দেশ-বিদেশে সুনাম। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ শাসক। তাই তার রাজ্যে কারও কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। প্রজাদের মন ছিল শান্তিতে ভরপুর। সবাই সব সময় তাদের রাজার মঙ্গল কামনা করত।

সেই রাজার ছিল এ রানী। যেমন ছিল তার রূপ, তেমনি ছিল তার গুণ। তার রূপের আর গুণের কথা প্রজাদের মুখে মুখে রূপকথার মতো বিরাজ করত। প্রজারা রানীকে নিজেদের মায়ের মতো ভক্তি করত। রানীও প্রজাদের নিজের সন্তানের মতো মনে করত।

হঠাৎ একদিন রাজ্যের প্রজাদের কাঁদিয়ে একমাত্র কুমারকে রেখে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

রূপকুমার তখন অনেক ছোট। বয়স তার এক বছরও পূর্ণ হয়নি। সারা রাজ্যে নেমে এলো গভীর শোকের ছায়া। এতটুকু কুমারকে নিয়ে রাজা পড়লেন বিষম চিন্তায়। কী করবেন ভেবে কূলকিনারা করতে পারলেন না।

অনেক ভাবনা-চিন্তার পর তিনি আরেকটি বিয়ে করলেন।

রাজার ধারণা ছিল, নতুন রানী শিশু রূপকুমারকে নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করবে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো তার সম্পূর্ণ বিপরীত। নতুন রানী এই সতীন পুত্রটিকে দুই চোখেই দেখতে পারত না। তাই সব সময় সে রাজার অলক্ষ্যে কুমারের ওপর নানারকম নির্যাতন করত। মাতৃহারা কলিজার টুকরা পুত্রটিকে রাজা যখন প্রাণভরে আদর করতেন, সে দৃশ্য রানী যেন কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। রাজকুমারের প্রতি রাজা যত বেশি স্নেহপ্রবণ হতেন, নতুন রানীর হিংসা ততই বেড়ে যেত। তাই সব সময় সে সুযোগ খুঁজত কেমন করে রূপকুমারের সর্বনাশ করা যায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তেমন কোনো সুযোগ পেত না রানী।

এমনি করে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। কুমারের বয়স এখন কৈশোর পেরিয়ে গেছে। একদিন রাজা খুব ঘটা করে এক অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যার সঙ্গে কুমারের বিয়ে দিয়ে দিলেন। নাম তার রূপকুমারী। এত রূপ আর কারও হয় না। কুঁচবরণ তার গায়ের রং। আর মেঘবরণ তার কেশ। রাজপুরীতে রূপকুমারী ঘর আলো করে থাকত। যে ঘরে সে থাকত রাত-দিন সে ঘরে যেন হাজার চাঁদের জ্যোতি ছড়াত। এত আলো বুঝি কেউ কখনো দেখেনি। এমন একটি পুত্রবধূ পেয়ে রাজার মনে আনন্দ আর ধরে না। অনেক বছর পর প্রজাদের মনেও যেন আজ আবার সব আনন্দ ফিরে এলো। সবার ঘরে জাগল খুশির জোয়ার। শুধু শান্তি নেই একজনের মনে। সে হচ্ছে, নতুন রানী। রূপকুমারীকে দেখে নতুন রানীর মনের হিংসা আরও দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে উঠল। সব রাগ গিয়ে পড়ল নতুন বধূর ওপর। সে মনে করল, এই নতুন শত্রুকে জব্দ করতে পারলে সবাই জব্দ হবে। তাই সে সুযোগ খুঁজতে লাগল, কেমন করে তাকে জব্দ করা যায়।

একদিন বিশেষ রাজকার্যে রাজার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলো। যাওয়ার সময় তিনি পুত্র রাজকুমার এবং পুত্রবধূ রূপকুমারীকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে অশ্রুতে বুক ভাসালেন। এত আদরের মানিক দুটিকে ছেড়ে যেতে তার ভীষণ কষ্ট হলো। কিন্তু কোনো উপায় নেই। রাজকর্মে অবহেলা করা চলে না। অনেক কষ্টে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।

তিন দিন তিন রাত কেটে গেল।

একদিন রূপকুমারের শখ হলো, সে বনে যাবে শিকার করতে। কিন্তু নয়নের মণি রূপকুমারীকে ছেড়ে যেতে তার মন চায় না। কারণ, স্ত্রীকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। স্বামীর শিকারে যাওয়ার কথা শুনে রূপকুমারীও কেঁদে বুক ভাসাল। রূপকুমার তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল যে, দিন তিনেকের মধ্যেই সে ফিরে আসবে।

অনেক কষ্টে রূপকুমার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিল।

এবার নতুন রানী দেখলে, মস্তবড় সুযোগ। আসলে সে ছিল একজন জাদুকরী মহিলা। রাজা অথবা রাজকুমার কেউ সে খবর জানত না। রাজকুমার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে রূপকুমারীর কাছে গিয়ে মন্ত্র দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই তাকে বিরাট একটা কদাকর নারীতে পরিণত করে দিল। কোথায় গেল রূপকুমারির এত রূপ আর কোথায় গেল হাজার চাঁদের জ্যোতি। মুহূর্তের মধ্যেই সে একটি কালো নিগ্রো নারীতে পরিণত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রূপকুমারীর বাকশক্তিও গেল হারিয়ে।

তিন দিন পর রূপকুমার শিকার করে দেশে ফিরল। প্রাসাদে ফিরে প্রথমেই সে গেল রূপকুমারীর ঘরে।

কিন্তু ঘরে ঢুকতেই মাথাটা ঘুরে গেল রূপকুমারের। এ কী হয়েছে তার নয়নের মণি রূপকুমারীর! ছুটে গিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে সে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। কিন্তু সে আরও আশ্চর্য হলো যখন দেখল রূপকুমারীর বাকশক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে কাঁদতে বুকফাটা চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল- 'বউ কথা কও'... 'বউ কথা কও...'

দূরে থেকে সব কিছু লক্ষ করল রানী। সে দেখল, বিপদ আরও বেড়ে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েকদিন পর রাজা দেশে ফিরে এসে এ দৃশ্য দেখলে তাকে আর আস্ত রাখবেন না। জল্লাদের হাতে তার নির্ঘাত প্রাণ যাবে। তাই তাড়াতাড়ি সে ছুটে এসে রূপকুমারকে একটি পাখিতে পরিণত করে দিল। আর তখনই পাখিটি উড়ে রাজপুরীর বাইরে একটি গাছে গিয়ে বসল।

কিন্তু তবুও সে রূপকুমারীকে ভুলতে পারল না। তাই সে বসে কাঁদতে কাঁদতে আকুল সুরে চিৎকার দিতে লাগল- 'বউ কথা কও'... 'বউ কথা কও...'

সেদিন থেকেই সে তার রূপকুমারীর জন্য অবিরামভাবে কেঁদে চলেছে। যতদিন তার বউ রূপকুমারী কথা না বলবে, ততদিন সে এমনি করে আকুল স্বরে কাঁদতেই থাকবে।

 

 

সর্বশেষ খবর