শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

ধানশালিক

আবেদীন জনী

ধানশালিক

রাত পোহালেই কিচিরমিচির ডেকে ওঠে ধানশালিক। মিষ্টি মধুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে রাতুলের। আলসেমি ঝেড়ে ফেলে মোচড় দিয়ে ওঠে বিছানা থেকে। হাত-মুখ ধুয়ে এসে ঢক ঢক করে গিলে এক গ্লাস জল। পরক্ষণেই কাঁচা হলদে রঙের রোদ ঠোঁটে নিয়ে পুব আকাশে উঁকি দেয় থালার মতো গোল সূর্য। একটু পরেই রোদ এসে উঠোনের ঘাসপাতা ছোঁয়। খেজুর পাতায় বোনা নকশি অাঁকা পাটি বিছিয়ে পড়তে বসে রাতুল।

রাতুলের বাবা চাষি পরান আলি। তিনিও জেগে ওঠেন শালিকদের চেঁচামেচিতেই। একদিন শালিকদের কিচিরমিচির গান শোনা গেল না কোথাও। থমথমে, প্রাণহীন নীরব সকাল। বনেও কোনো কোলাহল নেই। চুপচাপ। সেদিন ঠিক সময়ে রাতুলের ঘুম ভাঙল না। পড়তে বসা হলো না ওর। ইশকুলে যাওয়ার সময়ও চলে গেল ঘুম ভাঙতে ভাঙতেই। রাতুলের মন ভীষণ খারাপ হলো। শালিকরা আজ ডাকল না কেন? রোজ সকালেই তো ডাকে- কিচমিচ... কিচির মিচির। তাহলে কি অসুখ করেছে? নাকি অন্য কোথাও চলে গেছে ওরা? আমরা তো আর শালিকদের জ্বালাতন করিনি। প্রশ্নগুলো ভিড় করে রাতুলের মনে। বনের এগাছ ওগাছ খোঁজাখুঁজি করে। হঠাৎ রাতুলের চোখে পড়ল, কে যেন শালিকদের বাসাগুলো ভেঙে তছনছ করে ফেলেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খড়-কুটো। আর পড়ে আছে ধানশালিকদের দু'চারটে ঝরা পালক। পালকগুলো কুড়িয়ে হাতে তুলে নিয়ে বলল, হায়, ধানশালিক, কে এমন শত্রু হল তোমাদের?

রাতুলের এখন কিছুই ভালো লাগে না। খাওয়া-দাওয়া। লেখাপড়া। ইশকুলে যাওয়া। কোনো কিছুতেই মন বসে না। রাতুল তার বাবাকে প্রশ্ন করল, তুমি কি বলতে পারো আব্বু ধানশালিকের বাসাগুলো ভাঙল কারা? পরাণ আলি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর রাগভরা গলায় বললেন, আমি কমু ক্যামনে?

রাতুল চুপসে গেল। বাবার কড়া মেজাজ দেখে আর কোনো প্রশ্ন তোলার সাহস পেল না।

ধানশালিকদের বাসা কে ভেঙেছে, তা পরাণ আলির অজানা নয়। এর জন্য তিনিই দায়ী। রাতুলদের ধানক্ষেতের পাশেই ছোট্ট একটি বন। নানা রকমের গাছগাছালি। ওইখানেই ছিল শালিকদের বাসা। খড়কুটো কুড়িয়ে বাসা বুনেছিল ওরা। দিনের বেলা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসত ধানক্ষেতে। ধানের শীষ থেকে দু'একটা ধান ছিঁড়ে খেত। পোকা-মাকড় খেত। শালিকদের কিচিরমিচির গান পরাণ আলির কাছেও ভালো লাগে। দেখতে ভালো লাগে ডানার উড়াল। কিন্তু ওরা যখন ক্ষেতের পাকা ধানগুলো খেয়ে যায়, তখন বুকের ভেতরে কলজের মধ্যে টান লাগে। শীতের কামড় খেয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, ঘাম ঝরিয়ে ফলানো ফসল শালিকরা খায়।

ঠুকরিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। এসব সহ্য হয় না পরাণ আলির। পরাণ আলি শালিকদের উৎপাত আর সইতে চায় না। তাই এ বছর ক্ষেতে হাল দেওয়ার আগেই বনে গিয়ে শালিকদের সব বাসা খুঁজে খুঁজে ভেঙে ফেলেছে। ধানশালিকরা ভয় পেয়ে বন ছেড়ে চলে গেছে।

পরাণ আলি চাষি ক্ষেতে লাগিয়েছে হাইব্রিড ধানের চারা। যত্নও করে এক মনে। সার দেয়। কীটনাশক ওষুধ ছিটায়। সময় মতো আগাছা পরিষ্কার করে। পানি শুকিয়ে গেলে পানি দেয়। মোটকথা, যত্নের একটুও কমতি নেই।

পরাণ আলির মনের মাঠেও নেচে ওঠে প্রশান্তির ঢেউ। এবার আর চিন্তা নেই। সইতে হবে না ধানশালিকদের যন্ত্রণা। গোলা ভরে তোলা যাবে সোনার ধান। তার অনেক কাজ। গরু-ছাগলে ধান খায় কিনা, পোকায় ধরে কিনা, ক্ষেতে প্রয়োজনমতো পানি আছে কিনা- সব ব্যাপারেই নজর রাখতে হয়। কোনো কোনোদিন বাবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে ক্ষেতের ধারে যায় রাতুল। মাঝেমধ্যে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, আব্বু, ধানমালিকরা কি এসেছিল? পরাণ আলি জবাব দেন, শালিক দিয়া আমাগো কামডা কী? ওরা কি ক্ষ্যাতের আগাছা বাইচা দিব?

রাতুল আর কোনো কথা বলে না।

দিন যায়। ধানের চারাগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক হয়। দু'একটা শীষ বেরোতে থাকে। পরাণ আলি প্রতিদিন ক্ষেতের কাছে যায়। গন্ধে মন ভরে ওঠে তার। এক সময় সব ধানগাছের শীষ বের হয়। কিন্তু শীষগুলো কয়েকদিন যেতে না যেতেই শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। ধানের ভেতরে চাল হয় না। শুধু চিটা আর চিটা। পরাণ আলির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। হায়, আল্লাহ! তোমার কেমুন গজব! এই গরিবের জমিনে ক্যান গজব দিলা? ছল ছল করে দু'চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। সোনার ধানের সোনার স্বপ্ন ছাই হয়ে যায় পরাণ আলির। পরিশ্রম, টাকা-পয়সা সব বিফলে যায়। চোখের পাতায় ভিড় করে হতাশার অন্ধকার। কষ্টভরা বুকে ক্ষেতের এপাশ ওপাশ হাঁটে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসে। পরাণ আলি যেন বাড়ি ফেরার কথা ভুলে গেছেন।

বাবাকে ডাকতে আসে রাতুল। এসেই ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে, ধানশালিকদের কি দেখেছিলে?

পরাণ আলি নির্বাক তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ রাতুলকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠেন। শালিকদের প্রতি তার নিষ্ঠুর আচরণের কথা রাতুলকে জানায়। আমি ভুল কইরা ফালাইছি-রে রাতুল। রাতুল বাবাকে বলে, ধানশালিকরা শুধু ধান খায় না আব্বু। ক্ষতিকর পোকা-মাকড় খেয়েও ফসলের উপকার করে। আর পাখিরা হচ্ছে আমাদের প্রকৃতির সৌন্দর্য। ওদের উড়াউড়ি, ডাকাডাকি আমাদের পরিবেশকে ছন্দময় করে তোলে। এসব আমি পাখির গল্প পড়ে জেনেছি।

রাতুলের কথা শুনে পরাণ আলির অপরাধবোধ আরও বেড়ে গেল। ক্ষেতের আশপাশে পড়ে থাকা ধানশালিকের ঝরা পালকগুলো কুড়িয়ে পরম আদরে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললেন- আয় ধানশালিক আয়, ধান খেয়ে যা। রাতুলও দু'হাত বাড়িয়ে ডাকল, আয় ধানশালিক আয়, ধান খেয়ে যা।

 

 

সর্বশেষ খবর