শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

সজীবের হাসি

সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী

সজীবের হাসি

শহরের পথে পথে মিছিল। মানুষের ঢল নেমেছে। ঢোল আর মাইকের আওয়াজে শহর সরগরম। কোলাহলে মুখরিত। রং-বেরঙের কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে দোকানগুলো। পত পত করে উড়ছে পতাকা। মাইকে বাজছে বিজয়ের গান। সজীব পথ হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়ায়। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে দেখে। ভাবনায় পড়ে। শহরে সাজ সাজ। ব্যাপারটা কী?

জিজ্ঞেস করে পাশের একজন লোককে।

এই যে মিয়া ভাই, শহরে খুশির ঢল। রাজা-রানী কেউ আসবেন নাকি? লোকটি হেসে উত্তর দিলো, আরে না না। আজ বিজয় দিবস। আমাদের মহাআনন্দের দিন। এদিন দেশমুক্ত হয়েছিল শত্রুদের হাত থেকে। শহরে তাই তো তাদের হাট। সজীবের চোখে আগুনের ঝিলিক ঝলসে ওঠে। মুখে খুশির বান বয়ে যায়। কানে বাজে গুলির গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। সজীব বলল, তাই বুঝি? এই দেখুন তো আমরা যুদ্ধ করলাম। অথচ জানি না আজ বিজয়ের দিন। এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। চেতনার রং লাল পলাশে মন ছেয়ে যায়। সজীব রাস্তার এক পাশে দাঁড়ায়, আকাশের দিকে চোখ পড়ে তার। এক ঝাঁক পাখি ডানা মেলে উড়ছে। আকাশের নীল জমিনে ওরা মুক্ত বিহঙ্গ। ওদের জগতে ওরা অনন্য। সজীবের চোখে ভেসে ওঠে অতীত। সে তখন শহরের শেখপাড়ায় বাস করে। বাবার সঙ্গে টগবগে তরুণ। সুস্বাস্থ্য ঝাঁকড়া চুল। ঠোঁটের ওপর গোঁফ। প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত যুবক। বাবার মুদির দোকান আছে। মাঝে মাঝে বসে সে। পকেটের খরচ পায়। নির্বাচনের মৌসুম। নৌকার সমর্থক সে। মিছিল মিটিংয়ে সরব কর্মী। পাড়ায় পাড়ায় পোস্টারিং, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করে। সঙ্গে উদ্যমী একদল তরুণ। বঙ্গবন্ধুর একটি বড় ছবি টাঙিয়ে রাখে তার শয়নকক্ষে। বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় নেতা। বারান্দায় রাখে টাঙিয়ে কাগজের তৈরি নৌকা। সজীবের নাওয়া-খাওয়ায় রুচি যায় হারিয়ে। একটাই ভাবনা তখন তার। নির্বাচনে নৌকাকে পাস করাতে হবে। নির্বাচন হলো। নৌকা জিতে গেল। মাথায় লাল সালু কাপড় বাঁধে। হাতে নেয় লাঠি। যায় বিজয় মিছিলে। খুশিতে ঘুম পালায় দুই চোখ থেকে।

হঠাৎ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল পাগলা কুকুরের মতো। মধ্যরাতে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। নরপিশাচের দল শুরু করল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।

সজীবদের বস্তিতেও আগুন ধরাল। দাউ দাউ করে জ্বলে আগুন। শহরজুড়ে শুরু করে ত্রাসের রাজত্ব। নির্বিচারে হত্যা করে মানুষ আর মানুষ। সজীব বেঁচে যায়। প্রাণ নিয়ে পলায়ন করে। চলে যায় গ্রামে। গ্রাম থেকে গ্রাম ঘোরে। ক'জন যুবকের সঙ্গে শেষে ওরা চলে যায় মুজিবনগরে। যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। নাম লেখায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। তার চোখে বারুদ জ্বলছে। মুখে বিদ্রোহের শিখা। ট্রেনিং নেয় কদিন। এরপর যায় যুদ্ধে। রণাঙ্গনে বীরবিক্রমে লড়ে মুখোমুখি। প্রতিটি অপারেশনেই সাকসেসফুল হয়। এক অপারেশনে তার শরীরে গুলি লাগে অল্পের জন্য বেঁচে যায়। কিন্তু শরীর যায় ভেঙে। হাড্ডিসার হয়ে যায় দেহ। সুস্বাস্থ্যের যুবক হয়ে যায় প্রৌঢ়।

একদিন খবর এলো। মহাখুশির। দেশ স্বাধীন। সবার মুখে জয়-বাংলা স্লোগান। দেশে ফেরার আনন্দে উজ্জ্বল সবার মুখ। সবার সঙ্গে দেশে এলো সজীবও! এলো বেনাপোল হয়ে। বর্ডার দিয়ে প্রবেশ করল শহরে। বিধ্বস্ত শহর। আনন্দের মাঝেও বুকে আলপিনের ঘায়ের মতো অনুভব করে। তবু ও দুঃখ ভুলতে চেষ্টা করে। স্বদেশের মাটিতে পা রেখে গর্বিত সজীব। মুক্তবাংলা, ছুটে যায় শেখপাড়ায়। পাড়ায় করুণ চিত্র। বস্তি উজাড়। মুদির দোকান নেই। জানোয়াররা জ্বালিয়ে দিয়েছে। রাগে ক্ষোভে ধিক্কার দিয়ে সজীব বলে হারামির বাচ্চারা। তার বাবা-মা, ভাই-বোনকে হত্যা করেছে। লাইনে দাঁড় করিয়ে মেরেছে। জানাল পাড়ার বৃদ্ধ রহিমউদ্দিন। নিঃস্ব আজ। শোকে পাথর। বসে থাকে। নিশ্চুপ। কিছুদিন এখানে সেখানে ঘোরে ভবঘুরে জীবন। ভালো লাগে না।

কদিন এক দোকানে চাকরি করে। কিন্তু শরীরের জন্য বেশিদিন কাজ করতে পারেনি। নূন আনতে পানতা ফুরায়। দিন কাটে কষ্টে। যুদ্ধে ওলট-পালট হয়ে গেছে সব। স্বপ্ন আশা ধূলিসাৎ। বসতবাটি হারিয়ে ঠাঁই রাস্তায় রাস্তায়। রেলস্টেশনে কিছুদিন কুলির কাজ করে। কিন্তু মুটোগিরিও তার সইলো না। তাও ছেড়ে দেয়। কাগজ কুড়ানোর কাজ বেঁচে নেয় শেষে। শহরের পথে-ঘাটে বিপণি বিতানে কাগজ কুড়ায়। রুজি হয় অল্প। কোনো রকম বেঁচে আছে। শহরের ফুটপাতে বারান্দায় ঘুমায়। ঠিকানা নেই। গন্তব্য নেই। যাযাবর জীবন।

সজীবের ভাবনার অবসান হয় এক সময়। হাঁটতে শুরু করে। টুকরো সিগারেট বের করে। সামনে এক রিকশাচালক দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। সজীব আগুন ধরায় টুকরো সিগারেটে। সুখটান দেয়। ধোঁয়া ছাড়ে। পা বাড়ায়। একটু সামনে যেতেই দেখে বিশাল সমাবেশ। তার কানে ভেসে আসছে এক বক্তার কথা। আজ মুক্তিযুদ্ধের মহাআনন্দের দিন। সজীব উচ্চৈঃস্বরে হাসতে থাকে। আর সেই হাসি যেন থামতে চায় না।

 

সর্বশেষ খবর