শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

একটি শিশির বিন্দু

গল্প -আহমেদ রিয়াজ

একটি শিশির বিন্দু

প্রথমে ও শিশুই ছিল। শিশু শিশিরবিন্দু। বিকালবেলা একটি ঘাসের আগায় ওর জন্ম। বিকাল গড়িয়ে সন্ধে হয়। তখন ও হয়ে গেল কিশোর শিশিরবিন্দু। কিন্তু তখনও ও জানে না ও কে? কী ওর পরিচয়। জানার কোনো ইচ্ছাও ওর ছিল না। সন্ধের পর দুটো তারার ফিসফিসানি শুনতে পেল ও। একটা তারা আরেকটা তারাকে বলছে, দ্যাখ দ্যাখ শিশিরটা বড় হচ্ছে। কী অবাক ব্যাপার তাই না?

অপর তারাটি বলল, কোনটা শিশিরবিন্দু?

প্রথম তারা বলল, ওই যে ঘাসের আগা ধরে ঝুলে আছে, দেখতে পাচ্ছিস না?

দ্বিতীয় তারা বলল, না বাপু। কিছুই তো দেখছি না। এত দূর থেকে সবকিছু ভালোভাবে দেখা যায় না।

প্রথম তারা বলল, তাহলে আমি দেখছি কেমন করে? তোর নিশ্চয়ই চোখ খারাপ।

দ্বিতীয় তারার কিন্তু মোটেও ভালো লাগল না প্রথম তারার কথা। ক্ষেপে গিয়ে বলল, তুইও কিছু দেখছিস না। তুই স্বপ্ন দেখছিস। স্বপ্নে আবোল তাবোল বকছিস।

এরপর প্রথম তারা আর কী বলেছিল তা আর শোনেনি শিশিরবিন্দু। আকাশের দিকে তাকিয়েও দেখা পায়নি তারা দুটোর। ওরা তখন কোথায় যে হারিয়ে গেছে কে জানে। আকাশে তখন বিশাল কী যেন একটা আলো ছড়াচ্ছে। তার কাছেই জানতে চাইল শিশিরবিন্দু, আচ্ছা বল তো আমি কে?

জবাব পেল, তুমি একটা শিশিরবিন্দু।

আবার জানতে চাইল শিশিরবিন্দু, তুমি কে?

জবাব পেল, আমি চাঁদ।

শিশিরবিন্দু অবাক হলো। ও চাঁদকে চেনে না, অথচ চাঁদ ওকে চিনল কেমন করে! জানতে চাইল, আচ্ছা তুমি আমাকে চিনলে কেমন করে?

চাঁদ হাসল। সঙ্গে সঙ্গে জোছনার আলোও ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। হাসতে হাসতে চাঁদ বলল, প্রতিরাতেই কত শিশিরের সঙ্গে যে আমার কথা হয়! শিশিরকে আমার চেয়ে ভালো আর কে চেনে? শোনো শিশিরবিন্দু, আমার আলোয় তাপ নেই বললেই চলে। কাজেই তোমার ভয় নেই। তুমি আরও বড় হবে। মাঝরাত পেরোলেই যুবক হয়ে উঠবে।

চাঁদের কথাই ঠিক। মাঝরাত পেরোতে না পেরোতেই যুবক শিশিরবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ও। যতই বড় হয়, ততই অবাক হয়। দুনিয়াটা আরও বড় মনে হয়। চারদিক ভালো করে দেখে নেয়। যে ঘাসের আগায় ও ঝুলে আছে, সেটা অন্যান্য ঘাসের চেয়ে খানিকটা উঁচু। কাজেই পুরো ঘাসের বনটাই দেখতে পেল ও। ঘাসের বন পেরিয়ে বেশ কিছুটা দূরে দৈত্যগাছ। ওসব গাছেও কি শিশিরবিন্দু আছে? জানে না শিশিরবিন্দুটা। ভাবছে, ওসব গাছে শিশিরবিন্দু থাকলেও থাকতে পারে। এবং ওই শিশিরবিন্দুগুলো দৈত্য শিশিরবিন্দু। চাঁদকে জিজ্ঞেস করবে, সে উপায়ও নেই। চাঁদটা অনেক দূরে চলে গেছে। এত দূর থেকে চাঁদ ওর কথা শুনতে পাবে? একবার জিজ্ঞাসা করেই দেখা যাক। তার আগেই ঝিরঝিরে বাতাস এলো। তখন ভোর। ঝিরঝিরে বাতাসে দোলা লাগল পুরো ঘাসবনে। দোলা লাগল আরও বড় বিন্দুতে পরিণত হওয়া শিশিরটারও। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকল ঘাসের আগা। ভয় হলো এ বুঝি ছিটকে পড়ে যাবে ঘাসের আগা থেকে। তখনই হই হই করে ওঠল ওর ঠিক নিচে ঝুলে থাকা আরেকটা শিশিরবিন্দু, হেই, আর মোটা হোস নে তুই। আরও মোটা হলে ঝুলে থাকতে পারবি না। গড়িয়ে আমার ওপর পড়বি। তখন দুজনই চিত্পটাং হবো। একসঙ্গে সোজা মাটিতে পড়ে যাব। মাটি শুষে নেবে আমাদের। সকালটা আর দেখতে পাবি না তখন। শুনেছি সকালটা নাকি অনেক সুন্দর। অমন সুন্দর সকাল না দেখে গড়িয়ে পড়তে চাই না আমি।

ভাগ্য ভালো শিশিরবিন্দুটার। বাতাসের জলীয়বাষ্প কমে গেছে। কাজেই আর বড় হওয়ার ভয় নেই। আহা কী জীবন ওদের! বেশি বড় হলেও বিপদ।

টকটকে লাল সূর্যের আলো যখন ওই বিশাল শিশিরবিন্দুটার ওপর পড়ল, সোনালি আলো ছড়াতে লাগল ওর গা থেকে। কিন্তু ওই সোনাবরণ রূপ বেশিক্ষণ থাকল না। সূর্যের আলো যত বেশি হতে লাগল, ততই ফ্যাকাসে হতে শুরু করল ও। একসময় রুপালি আলো ছড়াতে লাগল ওর গা থেকে। পাশের ঘাসের আগায় ঝুলে থাকা আরেকটা শিশিরবিন্দুতে বার বার নিজেকে দেখে নিচ্ছে ও। নিজের সোনালি রূপ দেখে যতখানি মুগ্ধ হয়েছিল, রুপালি রূপটা দেখেও ঠিক ততখানি মুগ্ধ হলো। ধীরে ধীরে ঝুলে থাকার কষ্ট কমতে শুরু করল। সূর্যের আলোও হু হু করে বাড়ছে। আর ও ততই ছোট হতে থাকল। একসময় নিজেকে আর দেখতে পেল না শিশিরবিন্দুটা। দেখবে কী করে, পাশের ঘাসের আগায় ঝুলে থাকা শিশিরবিন্দুটা ততক্ষণে কোথায় যে মিলিয়ে গেল!

আশপাশে ওর কোনো প্রতিবেশী শিশিরবিন্দুকে আর চোখে পড়ল না। ভাবতে লাগল শিশিরবিন্দু, তাহলে কি ও নিজেও মিলিয়ে যাবে এমনি করে?

সত্যি সত্যি তা-ই ঘটল। ভাবনার ডানা পুরোটা মেলার আগেই সূর্যের উত্তাপে মিলিয়ে গেল শিশিরবিন্দুটা। মিলিয়ে গেল বাতাসে। অনেক বড়সড় একটা শিশিরবিন্দু ছিল বলেই এতক্ষণ টিকেছিল ও। গতকাল বিকালে যেখান থেকে জন্ম হয়েছিল, সেই বাতাসেই আবার ডানা মেলল জলীয়বাষ্প হয়ে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর