শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

মমির বিয়ে

কঙ্কন সরকার

মমির বিয়ে

বিকেলে তারা পৌঁছল মামাবাড়িতে। যানবাহনের মাঝে তিতলির ইচ্ছেতেই শেষ পথটুকু ঘোড়ার গাড়িতে এলো তারা। তবে যাত্রী পারাপারের জন্য সাজানো নয় গাড়িটি। মালামাল আনা-নেয়াতে ব্যবহূত হয় এটি। তবুও কী এক আকর্ষণে তারা এলো এ গাড়িতে! মজাও হলো বেশ।

তিতলির মামাবাড়ি নদীর পাশেই। এক সময় ভাঙনকবলিত ছিল নদীটি। কিন্তু এখন সেই উচ্ছলতা নেই এটির। বর্ষায় খানিকটা ফুলে ফেঁপে ওঠে ঠিকই কিন্তু তেমন ভাঙে না। শুকনো মৌসুমে শীর্ণ প্রায় একটা ধারা বয়ে চলে। চর জেগেছে এর বুকে। ধু ধু বালুচর। অনেক বাড়িঘর হয়েছে সে চরে।

তিতলিদের যে উপলক্ষে এবার মামাবাড়িতে আসা তা হচ্ছে ওদের কাজের মেয়ে মমির বিয়ে। অনেক দিন থেকে সে ওদের ওখানে থাকে। মমি ওদের বাড়িতে এমন হয়েছে যে যেন পরিবারের সদস্য। তিতলির বড় আপন ছিল ‘মমি আপু’। সে মানতেই পারেনি ওদের ওখানে কাজ করে মমি। ছিল তার বড় আপু। ‘মমিও’ আপন করে নিয়েছিল সবাইকে।

মন ভেঙেছে সব চাইতে বেশি তিতলির। কেননা, ওকেই তো খাইয়েছে, কোলে নিয়েছে, যত্ন করেছে মমি। খেলার সাথীও হয়েছে কখনো কখনো। চাকরির কারণে মা তো সময় দিতে পারে না। মমিই বলতে ছিল সব ওর। তার বিয়ে! চলে যাবে অন্য বাড়ি? তবুও আনন্দ। বিয়ের আনন্দ।

দাদু কোলে নিতে না পারলেও যেন জড়িয়ে ধরল তিতলিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। মামাতো ভাই বোনেরা জুটল। এর ফাঁকে মামাতো বোন সুমি হাত ধরে জোর করে নিয়ে গেল প্রায়। ওর তৈরি খেলনা অর্থাৎ মাটির পুতুল, পুতুলের বিছানা, অন্যান্য খেলনা এক এক করে দেখাতে লাগল। মমির বিয়ের আমেজে এক পর্যায়ে তারাও পুতুল বিয়ে খেলায় মত্ত হলো। এক সময় মামাতো ভাই সুমনের দুষ্টমিতে খেলা ভেঙে গেল। সুমি চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল। তিতলি চেয়ে থাকল। অতঃপর মামি এসে সুমনকে রাগিয়ে সুমিকেও মৃদু রাগ দেখাল। ডেকে নিয়ে তিতলিকে বলল, চল মা, হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নাও আগে। তারপর খেলবে।

রাতে পায়েসের সঙ্গে তালের পিঠা খেল।

খুব সকালে জেগে উঠল তিতলি। সুমিকে ডাকতেই দরজা খুলে বাইরে বেরুল। তাল গাছের নিচে গেল ওরা। ও মা! তিন-চারটা তাল পড়ে আছে। আনন্দে কুড়াল তিতলি। কী ঘ্রাণ পাকা তালের!

সুমন তালের আঁটি নিয়ে এলো। কুড়াল দিয়ে চোট দিয়ে শ্বাস বের করল। সুন্দর করে ধুয়ে তিতলি আর সুমির হাতে দিল কিছুটা। এরপর তিনজনে বেড়াতে গেল নদীর পাড়ে। নদীতে স্বচ্ছ জল। স্রোতহীন শান্ত তার প্রকৃতি। একটি পালতোলা নৌকা ভেসে চলছে। মৃদু বাতাস যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরও। কাশফুলে ছেয়ে গেছে নদীর চর। এর কিছু কিছু বাতাসে উড়ছে। কী এক অপরূপ দৃশ্য!

তিতলি আকাশ পানে তাকাল। নীলাকাশ! সাদা মেঘের ভেলা যেন ভেসে চলেছে। সুমি ডেকে বলল, তিতলি ওই দেখ দুটো বক কেমন করে মাছ ধরছে। এক এক করে তাদের কাছাকাছি দু’তিনজন আধো ল্যাংটা ছেলে ভিড়ল। তারা তিতলিকে দেখছে। তিতলি নদীর পাড় ধরে হাঁটল। ওরাও পিছে পিছে এলো। এক স্থানে নদীর একটা ধারা চলে গিয়ে থেমেছে। সেটি এখন বদ্ধ জলাশয় যেন। সেথায় শাপলা ফুল ফুটেছে। তিতলি যেন লাফ দিয়ে বলল, কী সুন্দর শাপলা ফুল! সুমন ভাইয়া, এনে দিবে দুটো?

আরও কাছে আসার জন্য বোধহয় আধো ল্যাংটো ছেলের একজন দৌড়ে লাফ দিল ওতে। চার-পাঁচটা শাপলা তুলে এনে হাতে দিল। ধন্যবাদ জানাল তিতলি। হাতের তাল শাসের টুকরা দিল ওদের। কি খুশি হলো যে, নিয়ে হাসতে হাসতে দৌড় দিল ওরা। সুমি একটা ডাটা হাতে নিয়ে ভেঙে মালা বানাল। তিতলির গলায় ঝুলিয়ে দিল। ঘুরেফিরে তারা বাড়িতে এলো। সকালের নাশতায় তালপিঠা, বড়াসহ তাল দিয়ে বানানো কয়েক প্রকারের খাবার খেল। সারাদিন ভাইবোনদের সঙ্গে নানান খেলা খেলল, গল্প করল, শুকাতে দেওয়া পাটকাঠিতে ফড়িং বসলে ধরার চেষ্টা করল। পাটকাঠি দিয়ে ফড়িং ধরার ফাঁদ বানাল। গাছের জাম্বুরা পেড়ে এনে নুন মরিচ দিয়ে খেল। শেষ বিকালে তারা মমিদের বাড়িতে যেতে বেরোল। চরের মধ্যে বাড়ি ওদের। হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। তবে নৌকায় করে নদীর একটা অংশ পেরুল তারা। মাকে নৌকায় চড়ে বেড়ানোর কথা বলল তিতলি। সুমন বলল, মমিদের নৌকা আছে। তিতলি যেন লাফ দিয়ে উঠে বলল, কী মজা! বিয়েবাড়িতে খাওয়া-দাওয়া হলো। বেশ ছেলেমেয়ে জুটেছে। তিতলিদের ঘিরে ধরল। মাইক বাজছে। কেউ কেউ নাচানাচি করছে। তিতলি দেখল কয়েকজন মহিলা একস্থানে হয়ে গীত গাইছে। বেশ দুুলে দুলে গাচ্ছে তারা। খুব ভালো লাগছে ওকে। মমি নতুন কাপড় পরে বসে আছে। মমির ডাকে তিতলি ওর কাছে বসল। তিতলিকে জড়িয়ে ধরল সে। কেঁদে কেঁদে আকুল। তিতলিও কান্না থামাতে পারল না। মমি শুধু বলছে, তোমাকে ছেড়ে থাকতে হবে যে আপু। কেমন করে থাকব?

তিতলির মা কাঁদো কাঁদো চোখে মমির মাথা বুলিয়ে দিল। বলল, তুই-ও-তো আমার মেয়ে। কেন কান্না? যখন খুশি, যখন মন চাবে বাসায় বেরিয়ে আসবে। তোমার বোন তিতলি তো রইল।

সুমন ওদের ডেকে নিয়ে বাড়ির বাইরে গেল। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। কিন্তু কী এক অপূর্ব সে জ্যোত্স্নার আলো। মাঝে মাঝে আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। তিতলি গেয়ে উঠল আকাশ পানে তাকিয়ে— চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে...

গায়ে লাগছে মৃদু বাতাসের পরশ। ছেলে-মেয়েরা বিয়েবাড়ি সাজিয়েছে কাশফুল দিয়ে। তিতলিও কয়েকটি নিল। সকালে মমির ভাই নৌকায় করে অনেক দূরে নিয়ে যাবে বলল। শেষে তারা অনেক রাতে মামাবাড়িতে ফিরল।

আজও খুব সকালে উঠল সে। সুমি সুমনসহ তালগাছের নিচ থেকে বাইরের উঠানে শিউলি গাছের নিচে গেল। অনেক ফুল পড়ে আছে। আনন্দে কুড়াল ফুল। সুমি দৌড়ে সুই সুতা নিয়ে এলো। মালা বানাতে লেগে গেল। এর মধ্যে মমির ভাই এলো। চলল তারা নৌকায় বেড়ানোর জন্য।

পরদিন তাদের যাওয়ার পালা। তা ভেবে ভেঙে যাচ্ছে যেন বুকখানা। দুদিনেই যেন কী এক বন্ধনে বাঁধা পড়েছে মন। তালের ঘ্রাণ, শাপলার মালা, নৌকায় ভেসে বেড়ানো, শিউলি ফুলের মালা, সাদা কাশফুল, পূর্ণিমার চাঁদের আলো সব যেন আপন হয়ে ধরা দিয়েছে ! সুমির সঙ্গে গল্প, পুতুল খেলা, সুমন ভাইয়ার জুগিয়ে দেওয়া, সব ছেড়ে যেতে হবে?

আজ সকালে চরের ছেলেগুলো অনেক শাপলা ফুল নিয়ে এসেছে। মামি দুটো তাল দিয়েছে ওদের। এর থেকে ক’টি ফুল নিল সে। ঠিক সময়ে রিকশা এলো। কাঁদো কাঁদো চোখে তিতলি রিকশায় উঠল মায়ের সঙ্গে। সুমি শিউলি ফুলের মালা তিতলির গলায় পরিয়ে দিল। সুমন ভাইয়া দিল তাল শাসের টুকরা। চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারল না কেউ। রিকশা চলল। বিদায় জানাতে হাত নাড়াল সবাই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর