শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বড় হবার সাধ

ফজলে রাব্বী দ্বীন

বড় হবার সাধ

‘বাবা, আমায় তুমি আকাশ দেখতে নিয়ে যাবে না?’

মৃদুলের কথা শুনে তার বাবা কী বলবে কিছু ভেবে পেল না! শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘নিয়ে যাব বাবা, একদিন ঠিকই নিয়ে যাব।’

‘কিন্তু কবে?’

‘আরেকটু বড় হয়ে নে তারপর।’

সেই বড় হবার দিনগুলো মৃদুলের জীবনে যেন আসেই না। সারাক্ষণ সেই বড় হবার অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে! তার পায়ের নখ, মাথার চুলগুলো তো ছোট করতে না করতেই বড় হয়ে যায় কিন্তু সে কেন বড় হয় না? মাকে বললে মা বলে, ‘দূর বোকা! আজ যাদেরকে বড় দেখছিস তারা সবাই একদিন তোর মতোই ছোট ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে সবাই বড় হয়ে গেছে। তুইও একদিন ঠিক বড় হয়ে যাবি।’

মৃদুল হুইল চেয়ারে বসে সারাক্ষণ শুধু এসব নিয়ে চিন্তা করে। কারণ সে জন্মের পর থেকেই হাঁটতে পারে না। মনে মনে ভাবে হয়তো বড় হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অন্য সবার মতো সেও হাঁটতে পারবে, দৌড়াতে পারবে, ক্রিকেট খেলতে পারবে এমনকি জোরে জোরে ফুটবলে কিক দিতেও পারবে। তার বাবাকে বলে এসব অনেক আগেই খেলার সব উপকরণ সে কিনে রেখেছে। এখন শুধু বড় হবার পালা। বড় হয়ে গেলেই বন্ধুদের সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই খেলতে পারবে। যে বন্ধুরা এখন তাকে অবজ্ঞা করে, তারা হয়তো একদিন ঠিক বুঝতে পারবে। তখন তার কাছে এসে ক্ষমা চাইবে এবং বলবে, ‘মৃদুল, আমাদের ভুল হয়ে গেছে বন্ধু, আমাদের তুমি ক্ষমা করে দাও, আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিব না, অবজ্ঞা করব না। চল তোমার সাথে এখন আমরা গোল্লাছুট খেলি।’

মৃদুল তার স্বপ্নমাখা শত শত কথার ঝুড়ি ডায়রির ভিতর লিখে রেখেছে। মাঝে মাঝে সেই ডায়রি খুলে আর খুব যন্তসহকারে সেসব পড়ে আবার রেখে দেয়।

একদিন তার বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেই দেখে মৃদুল তার রুমে নেই। চিন্তায় মাথা ঘামতে শুরু করল। মৃদুলের মা-ও বলতে পারে না মৃদুল কোথায়। যে ছেলেটা হুইল চেয়ারে বসে সারাক্ষণ বকবক করতে করতে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখে সেই ছেলেটা হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেল কেউই বলতে পারছে না! কী আজব কথা! মৃদুলের বাবা ঘরে আর এক মুহূর্ত বসে থাকতে পারল না। এদিক সেদিক খোঁজ করার জন্য বাইরে বের হয়ে এলো।

আকাশে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম ডাক। মাঝে মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে। এই বুঝি তুমুল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল! চারদিকের গাছপালাগুলো ঠিক থাকতে পারছে না। মৃদুলকে খুঁজতে গিয়ে তার বাবার অস্থিরতার শেষ নেই। একপর্যায়ে কয়েক গ্রাম তন্ম তন্ম করে খুঁজে অবশেষে মৃদুলকে না পেয়ে তার বাবা যখন বাড়ির দিকে রওনা দিল এমন সময় পথিমধ্যে একটা কুঁড়েঘর দেখতে পেল। কুঁড়েঘর দেখে বাবার আশ্চর্যের আর শেষ থাকল না। গাছের নিচে এত সুন্দর ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর আগে তো কখনো লক্ষ্য করেনি। তাহলে এটা কোথা থেকে এলো? বিষয়টা পরিষ্কার করতে কুঁড়েঘরের ভিতরে একবার উঁকি দিতে গেল মৃদুলের বাবা। কিন্তু যেই উঁকি দিতে গিয়েছে অমনি দেখে বিরাট এক কাণ্ড! কুঁড়েঘর ভর্তি অনেকগুলো গরিব নিঃস্ব ছোট ছোট ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে বসে আনন্দ করছে আর হৈ হৈ করে খেলাধুলা করছে। সবার হাতেই একটা করে খেলনা রকেট। মৃদুলের বাবা হঠাৎ আরেকটু সামনে তাকাতেই চমকে উঠল। দেখে হুইল চেয়ারে বসে মৃদুলও সেই গরিব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আনন্দে আপ্লুত হয়ে আছে। বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না তার। চাঁদের মতো ঝলমলে মৃদুলের মুখের জমকালো একরাশ হাসির আয়োজন দেখে বাবা আর কিছু না বলে সেই স্থান ত্যাগ করে সোজা বাড়িতে চলে এলো।

প্রায় ১ ঘণ্টা পর। মৃদুল হুইল চেয়ারের দুই চাকা হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বাড়িতে এসে হাজির। বাড়িতে এসেই দেখে তার বাবা বারান্দায় বসে আছে। মৃদুলকে দেখেই তার বাবা জিজ্ঞাস করে বসল, ‘খেলনা রকেটগুলো কোথায় পেয়েছিলে?’

মৃদুল প্রথমে হকচকিয়ে উঠল। তারপর মাথা নিচু করে বলল, ‘তুমি প্রতিদিন আমাকে যে টাকাগুলো উপহার হিসেবে দিতে সেগুলো জড়ো করে কিনেছি বাবা।’

মৃদুলের বাবা অকারণে রকেট কিনার কথাটা আর মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে পারল না।

কিছুদিন আগের কথা। মৃদুল কী করে যেন ডাক্তারের মুখ থেকে শুনেছে সে আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না। এমনকি বড় হলেও না। কাঠবিড়ালির মতো গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়ানোর ইচ্ছাগুলো তার হারিয়ে গেছে। তাই সে এখন প্রতিদিন সেই সব গরিব নিঃস্ব সমবয়সী ছেলেমেয়েদের বড় হবার স্বপ্ন দেখায়। সেই স্বপ্ন ঘুড়ির মতো আকাশে উড়ে বেড়ানোর, ইচ্ছামতো হেঁটে হেঁটে বিশ্বভ্রমণের। ঈদ উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে যত উপহার বা টাকাকড়ি পেয়েছিল সবগুলো ইচ্ছামতো খরচ না করে লুকিয়ে লুকিয়ে সেইসব দিয়ে গরিব ছেলেমেয়েদের সাহায্য করেছিল সে।

মৃদুলের মুখের প্রতিটা কথা শুনে তার বাবা চোখের জল আটকাতে পারে না। মৃদুলকে অমনি বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোর জন্য আজ আমার গর্ব হচ্ছে রে মৃদুল। আসলে মানুষ বড় হয়ে গেলেই বড় হয়ে যায় না। বড় হতে গেলে তোর মতো বিশাল একটা মন লাগে...।’

           

            চকপাঠক, শেরপুর সদর, শেরপুর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর