শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ইরমা ও দাদুনের গল্প

রুনা তাসমিনা

ইরমা ও দাদুনের গল্প

বেশ কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে অবশেষে প্রজাপতিটি ধরল সে! হলুদের ওপর কালে ছোপ ছোপ পাখার প্রজাপতিটি পুরে রাখে ঝুড়িতে। ছোট্ট ঝুড়িটিতে প্রতিদিনিই সে রং বেরঙের প্রজাপতি ধরে ধরে রাখে। কখনো দুটি কখনো তিন- চারটি। রোজ স্কুল থেকে আসার সময় রঙিন প্রজাপতি তার ধরে আনা চাই-ই চাই। কিন্তু দাদুনের আপত্তি ছিল এতে। ইরমাকে নিষেধ করে বলতো, ধরলে ওরা কষ্ট পায়। ওরা উড়তে চায় ফুলে ফুলে। কিন্তু ইরমার মন মানতো না সে কথায়। মন খারাপ হয়ে যেত। ছোট্ট মনটি বুঝতে পারতো না কী করবে ! ওর ও যে প্রজাপতি অনেক পছন্দ! শেষে এই কথা হয়, প্রজাপতি ধরে বাড়ি আনার পর আবার উড়িয়ে দেবে। একগাল হেসে একমত হয় দাদুনের সঙ্গে ইরমা। ইরমার সঙ্গে দাদুনের দারুণ সখ্য। নাওয়া-খাওয়া সবই দাদুনের সঙ্গে। রাতে ঘুমানোও দাদুনের সঙ্গে। দাদুনকে জড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসে না ইরমার।

‘আচ্ছা, দাদুন বলো তো, প্রজাপতিগুলো এত রং-বেরঙের হয় কেন?’ ‘মানুষের মতো। সব মানুষ কি একই চেহারার হয়? দেখো না এক একজন এক এক চেহারার। প্রজাপতিদেরও সৃষ্টিকর্তা সেভাবে বিভিন্ন রঙের করে সৃষ্টি করেছেন।’ ‘প্রজাপতিরাও কি মানুষের মতো ঝগড়া করে?’ ‘না! ওরা ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়। ওরা যেমন সুন্দর তেমনি ভালোবাসেও সৌন্দর্যকে’ কপালে ছোট্ট একটি চুমু এঁকে দিয়ে বলেন দাদু রোশনারা ‘ওরা মানুষকে ভালোবাসে না!’ গাল ফুলিয়ে বলে ইরমা। ‘কেন মনে হলো মানুষকে ভালোবাসে না?’ দাদু বুকের কাছে টেনে নিয়ে প্রশ্ন করে। ‘দেখো না! আমি যখন ধরতে যাই ওরা ছুটে পালায়। আর ফুলের কাছে ওরা নিজেই যায়।’ কথাটি একটি বাচ্চা মেয়ের। মাত্র ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। কিন্তু দাদুর মনে হয় ইরমা ঠিকই বলেছে। একটু আনমনা হতে দেখে দাদুনের কোলে ওঠে গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ও দাদুনি, বল না ওরা ফুলকে কেন এত ভালোবাসে?’ ফুলকে তো সবাই ভালোবাসে দাদুমণি! ফুল যে সুন্দর! তাহলে আমি সব মানুষকে ফুলের মতো করে দেবো। তাহলে প্রজাপতিরা মানুষকেও ফুলের মতো ভালোবাসবে। বাচ্চা মেয়েটির কথায় দাদুর একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। এদের মতোই নিষ্পাপ যদি সব মানুষের মন হতো তাহলে পৃথিবীটা মানুষ নামের ফুলের বাগান হয়ে থাকত। ভাবনা বাদ দিয়ে ইরমার দিকে মনোযোগ দেন দাদু রোশনারা। দাদাকে দেখেনি ইরমা। কিন্তু তার কাছে দাদাভাইয়ের অনেক গল্প শুনেছে। ছোট্ট বাচ্চারা ছিল দাদাভাইয়ের খুব প্রিয়। দাদাভাইয়ের কথা শুনে ইরমা বলতো। দাদাভাই থাকলে আমাকে অনেক আদর করতো। তাই না দাদুন? অ-নে-ক ইরমাকে বুকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পড়তে বসার আগে দাদু নাতনির গল্প করতে বসা যেন নিত্যদিনের রুটিন। ইরমা মেধাবী ছাত্রী। পরীক্ষায় তার ফার্স্ট হওয়া চাই-ই চাই। দাদুনের সঙ্গে গল্প-গুজব শেষেই লক্ষ্মীমেয়ের মতো পড়তে বসে যেত। তৃতীয় শ্রেণিতে বেসরকারি একটি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। তাই এখন গল্প একটু কম হয়। দেখতে দেখতে এসে যায় পরীক্ষা। ইরমা খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছে, তাই খুব খুশি। দাদুন! আমি যদি বৃত্তি পাই তুমি আমাকে কী দেবে? ইরমা যা চাইবে দাদুন তা-ই  দেবো। আদর করে বলে রোশনারা। রোজ আমি তোমার জন্য প্রজাপতি ধরে আনি, বৃত্তি পেলে তুমি আমার জন্য এত্তগুলো প্রজাপতি ধরে আনবে! আমি তো বুড়ো মানুষ। কীভাবে ধরবো এত্তগুলো প্রজাপতি? হাসেন তিনি। খুব পারবে! আমি তোমাকে শিখিয়ে দেবো। তুমি ধরে আনবে তারপর দুজনে মিলে সবগুলো উড়িয়ে দেবো। খুব মজা হবে! অনেকগুলো প্রজাপতি একসঙ্গে উড়বে! ছোট্ট ইরমার চোখ দুটো স্বপ্নীল দেখায়। আজ বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে। স্যার আসেন ফলাফল নিয়ে, এসেই ইরমাকে খুশিতে কোলে তুলে নিয়ে অন্য স্যারদের উদ্দেশ্য বলেন, আমাদের ইরমা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে! ইরমার খুশি ধরে না! বাবাকে তাড়া দেয় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে কখন তার প্রিয় বন্ধু দাদুনকে এ খবর দেবে! বাড়ির কাছে আসতেই দেখে ঘরভর্তি লোক। ভিড়ের মধ্যে ইরমা দাদুনের কাছে যেতে পারে না। সবাই দাদুনকে এমনভাবে ঘিরে আছে ছোট্ট ইরমা কিছুতেই দাদুনের কাছে পৌঁছুতে পারে না। অ্যাম্বুলেন্স এলে আব্বু, চাচ্চু তাড়াতাড়ি করে দাদুনকে নিয়ে শহরের পথে রওয়ানা দেয়। ইরমা আম্মুর কাছে বার বার জানতে চায়, দাদুনের কী হয়েছে? পরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় খুব মন খারাপ হয়ে থাকে। কিচ্ছু ভালো লাগে না। স্কুলেও মন খারাপ থাকে। সন্ধ্যা নামলেই মন আরও খারাপ হয়। ‘দাদুন আর কতদিন হসপিটালে থাকবে? এবার চলে আস না! তোমাকে ছাড়া যে ভালো লাগে না।’

এক সপ্তাহ পর দাদুনকে শহর থেকে নিয়ে আসে। বিছানায় শোয়া দাদুনের কাছে ডাক্তারের নিষেধের কারণে যেতে দেওয়া হয় না ইরমাকে। রাতে দাদুনের পাশে তাকে আম্মু আর শুতে দেয়নি। দাদুনও কথা বলে না, চোখও খোলে না। এখনো স্কুল থেকে আসার সময় দেখে কোথা থেকে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ে আসে অথচ ইরমার একটাও ধরতে ইচ্ছা করে না।

স্কুল থেকে ফিরেই দাদুনের মাথার কাছে বসে ছোট্ট হাত বুলিয়ে আদর করে মনে মনে কত কথা! দাদুন চোখ খোল! কথা বলো! ডাক্তার কতদিন কথা বলতে নিষেধ করেছে? আমার যে কিছু ভালো লাগে না! জানো দাদুন? তোমার অসুখ হওয়ার পর থেকে আমি আর প্রজাপতি ধরি না। আমি ওদের ধরে রেখে কষ্ট দিই বলে ওরা তোমাকে অসুখ দিল, পরীক্ষা শেষে রাত জেগে দাদুন আর পরীর গল্প আর বলবে না। ছোট্ট মনে কত ভাবনা! সেদিনও স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিনকার মতো দাদুনের পাশে বসে মাথায় হাত রাখতেই দাদু হঠাৎ চোখ খুলে জিজ্ঞেস করে, আমার জন্য প্রজাপতি আনো নি আজ? চমকে উঠে ইরমা! কি খুশি! কি খুশি! দাদুন কথা বলছে! কি আনন্দ! কি আনন্দ! তাড়াতাড়ি মাথার কাছ থেকে উঠে গিয়ে শুয়ে পড়ে দাদুনের বুকের ওপর! দাদুন রুগ্ন হাত দুটি ইরমার পিঠে বুলাতে থাকে। ইরমার ছোট্ট বুকের দুরুদুরু শব্দ যেন দাদুনের বুকেও স্পন্দিত হয়, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু!

সর্বশেষ খবর