শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

একাত্তরের পাখিরা

মুহাম্মদ মনিরুল হক

একাত্তরের পাখিরা

প্রায় প্রতিদিনই হাঁসটার সঙ্গে পানকৌড়িটার দেখা হয়, কথা হয়। তারা একে অন্যের একটা নামও দিয়েছে। হাঁসের বাচ্চাটা পানকৌড়িটাকে ডাকে কাকৈ বলে আর পানকৌড়ি হাঁসটাকে ডাকে চৈচৈ। পানকৌড়িটার মনে হলো আজ বুঝি হাঁসের সঙ্গে দেখা হবে না। আজ চিতন নদীর মোহনায় আসতে তার একটু দেরি হয়ে গেছে। নদীতে ইদানীং মাছ কমে গেছে। হঠাৎ করে নদীতে মাছ কমে যাওয়ার কারণ কাকৈ বুঝতে পারে না। তবে ইদানীং নদীতে স্টিমারের চলাচল অনেক বেড়ে গেছে। নদীর মাছ কমে যাওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে। মাছের কথা কি বলবে তার অনেক সঙ্গী-সাথীকেই এখন আর নদীতে দেখা যায় না। তবে স্টিমারের বিকট শব্দে যে তার ভয় লাগে না এমন নয়। তাই বলে স্টিমারের ভয়ে নদী ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ দেখে না কাকৈ। কাকৈ চিতন নদীতে এসে অবাক হয়ে দেখল চৈচৈ এখনো আছে। অথচ সন্ধ্যে হয়েছে সেই কখন! আরেকটু পরে এলে হয়তো অন্ধকারের কারণে চৈচৈকে দেখাই যেত না। চৈচৈ নদীর পাড়ের ধানগাছের আড়ালে চুপ হয়ে বসে আছে। কাকৈ চৈচৈয়ের কাছে গিয়ে চিন্তিত গলায় বলল, চৈচৈ তুমি এখনো বাড়ি যাওনি!

চৈচৈ কিছুটা অভিমানী গলায় বলল, আমি ঠিক করেছি আর কখনো বাড়ি ফিরব না। নদীতেই থাকব সবসময়।

কাকৈ বিস্মিত গলায় বলল, কি বল! এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলে তুমি?

চৈচৈ কাকৈর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, রিতুর সঙ্গে রাগ করেছি।

কাকৈ প্রশ্ন করল রিতু কে?

যে মেয়েটা আমার খাবার জোগাড় করে তার নাম রিতু। সে-ই আমার জন্য শামুক, কুঁড়ার ব্যবস্থা করে।

-কুঁড়া কি?

-ধান থেকে কুঁড়া হয়, তুমি চিনবে না।

-যে মেয়েটা তোমার জন্য কষ্ট করে খাবারের ব্যবস্থা করে তুমি তার উপর রাগ করেছ কেন?

-তুমি তো জান কাকৈ, এই সময়টাতে নদীতে শামুক কম থাকে। তুমি জান, এই কয়েকদিন আমি শামুকের অভাবে কাদা খেয়েছি? চৈচৈয়ের গলাটা যেন একটু ধরে এলো। কাকৈয়েরও এখন চৈচৈয়ের জন্য খারাপ লাগছে। চৈচৈ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিয়ানো গলায় বলল, আমি মনে হয় বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারব না কাকৈ। ওই দেখ পিচ্চি মেয়েটা নদীর পাড়ে হাঁটছে আর আমাকে ডাকছে। ওদের ঘরেও মনে হয় তেমন খাবার নেই। কয়েকদিন ধরে তার বাবা শুধু যুদ্ধ নিয়ে কি যেন বলে। ও বাড়ির কাউকেই এখন আগের মতো মনে হয় না। সবাই যেন কেমন হয়ে গেছে। কাকৈ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই নদীতে বিকট একটা শব্দ হলো। কাকৈ-চৈচৈ দুজনই শব্দের উেসর দিকে ফিরে তাকাল। তারা কিছু বুঝে উঠার আগেই আবারও বিকট শব্দ হলো। একের পর এক আকাশ কাঁপানো শব্দ হচ্ছে। কাকৈ পানিতে ডুব দিল। চৈচৈ ঢুকে গেল ধানখেতের ভিতর। চৈচৈ ভয় এবং আতঙ্ক নিয়ে মুহূর্তে অচেনা হয়ে যাওয়া চিতন নদীটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে দেখছে ছোট একটা নৌকা বড় একটা স্টিমারকে আক্রমণ করার চেষ্টা করছে কিন্তু ছোট নৌকাটা কিছুতেই স্টিমারটার সঙ্গে পেরে উঠছে না। কাকৈয়ের ধারণা ছিল সে অনেকক্ষণ পানিতে ডুবে থাকতে পারে আর ডুবে থেকেই অনেক দূর চলে যেতে পারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে মোটেই দীর্ঘক্ষণ ডুবে থাকতে পারে না। প্রতিবার পানির নিচ থেকে উঠার সময় ভাবে সে হয়তো অনেক দূরে চলে এসেছে কিন্তু পানিতে ভেসে উঠেই দেখে সে স্টিমারের কাছাকাছিই আছে আর মনে হচ্ছে তার শরীরে আগুন লেগে যাচ্ছে। শুধু তার শরীরে না, মনে হচ্ছে যেন আজ চিতন নদীতেই আগুন লেগে গেছে। চৈচৈ দেখছে নদীর আগুন ধীরে ধীরে নদীপাড়ের বাড়িগুলোর ওপর উঠে যাচ্ছে। সে রাতে চৈচৈ রিতুদের বাড়ি খুঁজে পেল না। ভোরের দিকে চৈচৈ নদী থেকে উঠল। চৈচৈ চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে কোনো শব্দ করছে না।

গত রাতের আগুনে রিতুদের বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাড়িতে কোনো মানুষ নেই। শুধু রিতুদের বাড়ি নয়। আশপাশের প্রায় সব বাড়িই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। চৈচৈ আরও কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত হয়ে বসে থেকে ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে নেমে এলো। গ্রীষ্ম বর্ষা পেরিয়ে নদীতে শীত নামে। নদীতে স্টিমারের সংখ্যা কমে আসে কিন্তু কাকৈ আর ফিরে আসে না। প্রতি সন্ধ্যেয় চৈচৈ রিতুদের বাড়ির পাশ দিয়ে ভেসে যায়। তার মনে হয় এক্ষণি বুঝি পিচ্চি মেয়েটা তাকে ‘আয় চু চু চু’ করে ডাকবে। এখনই বুঝি সন্ধ্যের আবছা কুয়াশার ভিতরে নদীর পাড়ে হাত বাড়িয়ে হেঁটে যাওয়া একটা মেয়েকে দেখা যাবে।

সর্বশেষ খবর