—আম্মু আম্মু, কোথায়..... ?
স্কুল থেকে বাসায় ফিরে মাকে কেবল ডেকেই যাচ্ছে মুনতাহা। উদ্দেশ্য সু-সংবাদটা সবার আগে আম্মুকে জানানো।
সেই কতক্ষণ হলো ডাকছে কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই। তাহলে আম্মু কোথায়? সারা ঘর খুঁজে না পেয়ে মুনতাহা উঠে পড়ে বাসার ছাদে।—ইস আম্মু, তুমি এখানে আর আমি কতক্ষণ ধরেই না ডাকছি।
মেয়ের কথা শুনে মা শাকেরা শিমু ফিরে তাকান। ছাদে তিনি গাছের পরিচর্যা করছিলেন। টবে নানা জাতের ফুল ফলের গাছ লাগিয়েছেন। নিয়মিত এগুলো দেখভাল করেন তিনি। মা-মেয়ে ছাড়া বাসায় তো অন্য কোন প্রাণী নেই যে এ কাজটুকু করবে। মুনতাহা আম্মুকে সহযোগিতা করে। এ কাজে তারও বেশ আগ্রহ। আম্মুর কাজ দেখতে দেখতে সু-সংবাদটা দেওয়ার কথা ভুলেই গেছে।
—কেন আম্মু, কি জন্য ডাকছ?
মায়ের প্রশ্নে মুনতাহা সম্বিৎ ফিরে পায়।
—জী আম্মু, আজ আমাদের স্কুলের স্যার বলেছেন একুশে ফেব্রুয়ারিতে স্কুলে দিনব্যপী অনুষ্ঠান হবে। নানারকম আয়োজন থাকবে।
—আচ্ছা,তাহলে তো ভালোই। গাছে পানি ঢালতে ঢালতে মেয়ের কথার উত্তর দেন মা শাকেরা শিমু।
—জী আম্মু, তবে আরেকটা সু-সংবাদ আছে।
—কি সেই সু সংবাদটা? বলতো আম্মু।
—স্যার বলেছেন সেদিন অনুষ্ঠানের মূল পর্বে যখন অতিথিরা থাকবেন তখন নাকি আমাকে একক গান গাইতে হবে।
—তাই নাকি? তাহলে বিশাল সু সংবাদ আম্মু। এবার পানি ঢালা বিরত রেখে মেয়ের কাছাকাছি এসে দাঁড়ান শাকেরা শিমু।
—কিন্তু আম্মু....
—কিন্তু কিসের?
—আমি এতো বড় অনুষ্ঠানে একা গান গাইবো কিভাবে?
মেয়ের কথা শুনে মুচকি হাসেন শাকেরা শিমু।
—কি যে বলে না আমার আম্মুটা, এখানে ভয় পাওয়ার কি আছে। আরে আমি তো তোমাকে ভালো করে শিখিয়ে দেবো। শুনো আম্মু, কোন কাজে ভয় করা চলবে না, সাহস নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে, কেমন!
—জী আম্মু। হাসিমুখে উত্তর দেয় মুনতাহা।
মুনতাহার আব্বু বিদেশে থাকেন। দাদু আর চাচ্চুরা গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
আর আম্মু তো আস্ত একজন লেখিকা।দেশ বিদেশের অনেকগুলো পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখেন। শাকেরা শিমু নামেই তার পরিচয়, পাঠক মহলে তার লেখাগুলো প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম। মুনতাহা শুনেছে তার আম্মু নাকি আগে ভালো গান করতেন। বিয়ে হওয়ার পর থেকে আর করেন না। তবে লেখালেখি ঠিকমতোই করে যাচ্ছেন। আম্মুর কাছ থেকেই মুনতাহার গান শেখার হাতেখড়ি। সেই ছোটবেলা থেকেই আম্মু তাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে গান গাইতে দিতেন। ছোট্ট মুনতাহাও মায়ের দেওয়া তালিমে ভালোই গান করতে পারে।
এবার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে মুনতাহা। স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকা থেকে শুরু করে ছোট বড় সবার কাছে মুনতাহার সুনাম রয়েছে।। সবার কাছে তার পরিচয় লেখিকা মায়ের মেয়ে ‘গানের পাখি’ মুনতাহা। তার সুমধুর কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ না হয়ে কি কেউ থাকতে পারে? তবে মুনতাহার মনে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। সে সবার সঙ্গে মিশে। গল্প করে, খেলাধুলা করে। আম্মু বলেছেন কখনো নিজেকে বড় ভাবতে নেই। কাউকে ছোট বলে অবহেলা করা যাবে না। সবার সাথে ভালো আচরণ করতে হবে।
এদিকে অনুষ্ঠানের দিন ঘনিয়ে আসছে। মুনতাহাকে তার আম্মু ভালোভাবে প্রস্তুত করে তুলছেন অনুষ্ঠানের জন্য। বারবার রিহার্সাল দিচ্ছেন গানের।
অনুষ্ঠানের দিন খুব সকালে আম্মু তাকে প্রস্তুত করিয়ে দিলেন। নির্ধারিত সময়ে তারা অনুষ্ঠানস্থলে চলে আসে। জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে একে একে অতিথিরাও চলে আসলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের স্বাগত বক্তব্যের পর কয়েকজন অতিথির বক্তব্য দিলেন।
এবার পরিচালক মাইকে ঘোষণা দিলেন—
এ পর্যায়ে একক গান নিয়ে আসছে আমাদের স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থী ‘গানের পাখি’ মনতাহা।
ডাক শুনে মঞ্চে এসে মাইক হাতে নিয়ে গান শুরু করে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কি ভুলিতে পা...রি....।”
মুনতাহার গান শুরু হলে গোটা অনুষ্ঠানে পিনপতন নীরবতা চলে আসে। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে ছোট্ট মুনতাহার গান। গান শেষ হতে না হতেই মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল গোটা অনুষ্ঠান আঙিনা।
মঞ্চে বসা প্রধান অতিথি মুনতাহাকে কাছে নিয়ে আদর করলেন। সামনে রাখা মাইক অন করে ঘোষণা দিলেন, তিনি মুনতাহাকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা উপহার দিবেন। প্রধান অতিথির ঘোষণা শুনে দর্শক সারিতে বসা মুনতাহার আম্মুর চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। উপহার হাতে তুলে দিলেন মঞ্চে বসা অতিথিবৃন্দ। আবারো সবাই করতালি দিতে লাগল। উপহার হাতে নিয়েই একদৌড়ে আম্মুর কাছে চলে আসে। শাড়ির আঁচলে চোখের আনন্দাশ্রু মুছে নিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন মুনতাহাকে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। আম্মুর হাত ধরে আনন্দের সাথে বাসায় ফিরল মুনতাহা।