শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

লুবাবার পরীক্ষা

মঈন মুরসালিন

লুবাবার পরীক্ষা

‘তোর আর স্কুলে যাওন লাগব না। তুই স্কুলে গেলে কাম করব কেডা? তুই হইছত গরিবের মাইয়া। গরিবগো শিক্ষিত অওন লাগে না।’ কথাগুলো ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, মোবারক মিয়া। স্কুলের হেড মাস্টারের কথাগুলোই যেন মোবারক মিয়া লুবাবার সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করল।

লুবাবা মণিমুকুর কিন্ডার গার্টেন স্কুলে এবার থ্রিতে পড়ে। পড়ালেখায় তার খুব মনোযোগ। বাবা-মা পড়তে বসতে বলার আগেই সে সন্ধ্যার সময় হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসে যায়। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় সে ক্লাসে তিন নম্বর হয়েছিল। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা সামনে, পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভালোভাবে। মোবারক মিয়া স্কুলে যায় মেয়ের বেতনের খোঁজ নিতে। গিয়ে দেখে তিন মাসের বারো’শ টাকা বাকি। কেরানি বলে দেয় তিন মাসের বারো’শ টাকা আর পরীক্ষার ফিস ২০০ টাকা দিলেই পরীক্ষা দেওয়া যাবে। মোবারক মিয়া দিনমজুরের কাজ করে, বারো’শ টাকা একত্রে দেওয়া তার জন্য সম্ভব নয়, সে চিন্তা করতে করতে বাসায় ফিরে আসে।

বাসা বলতে একটা টিনশেড ঘর, চৌধুরীপাড়া মাটির মসজিদের পাশে। দিনমজুরের কাজ করে যা পায় তা থেকে দুই হাজার টাকা ঘর ভাড়া দেওয়া তার কষ্ট হয়ে যায়, তার ওপর মেয়ের পরীক্ষার ফিস দেওয়া অসম্ভব।

বাসায় আসতেই বাবার কাছে লুবাবা জানতে চায়, ফিস দিয়া আইছ?

মোবারক মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, মারে বারো’শ টেকা দেয়ন লাগব। কইত্তে পামু এত টাকা?

লুবাবা নরম স্বরে বলে বাবা, পরীক্ষা আমার দিতেই অইব। তুমি যেমনেই পার আমার পরীক্ষার টেকা দিতে অইব। আর কয়দিন আছে পরীক্ষার!

মোবারক মিয়ার খুব আশা মেয়েটা শিক্ষিত হবে। ভালো ঘরে বিয়ে দেবে। মেয়েটাকে নিয়ে খুবই স্বপ্ন দেখে। কিন্তু নিজের আয়ের কথা যখন ভাবে তখন সব স্বপ্নই ফানুশের মতো চুপসে যায়।

মোবারক মিয়া সারা দিন জোগালি করেও এখন সন্ধ্যার পর থেকে রিকশা চালায়। তার খুব কষ্ট হয়। শরীর ভেঙে পড়ে। কিন্তু মেয়ের পড়ালেখার কথা ভেবেই সে কষ্ট করে যায়। মেয়েটা যে তার খুব আদরের।

মোবারক মিয়া অনেক কষ্টে এক হাজার টাকা জোগাড় করে স্কুলে নিয়ে যায়। কেরানির কাছে এক হাজার টাকা আনার কথা বলতেই সে হেড মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। হেড মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে মোবারক মিয়া বলেন, স্যার আমার মাইয়ার পরীক্ষা। বারো’শ টেকা দেওন আমার পক্ষে সম্ভব না। গরিব মানুষ। স্যার দেহেন দুইশ’ টেকা মাফ করন যায়নি। হেড মাস্টার রুক্ষস্বরে বলেন—এটা তো এতিমখানা খুলে রাখিনি যে, টাকা মাফ করে দেব। পরীক্ষার ফিস-বেতন দিতে না পারলে পরীক্ষা দেওয়ার দরকার কি? গরিব মানুষ কাজ করে খাও। কাজ করতে শিক্ষিত হওয়া লাগে না। মোবারক মিয়া রাগে-অভিমানে স্কুলের অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। শিক্ষিত লোকেরা টাকার জন্য এমন ব্যবহার করে। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে এসে ঢোকে মোবারক মিয়া। লুবাবা জোরে জোরে পড়ছে। পরীক্ষার পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে। লুবাবা পড়া বন্ধ করে বাবার মুখের দিকে তাকাতেই বাবা ধমকে উঠলেন—পড়ালেহা বাদ দে। পড়ালেহা আর করন লাগত না। গরিবগো পড়ালেহা করন লাগে না। তহন কাম করতে মন চাইত না।

লুবাবা কিছুই বুঝতে পারল না, তার বাবা কেন পড়তে নিষেধ করল। তবে এটা বুঝতে পেরেছে তার আর পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। তার মুখটি মলিন হয়ে গেল। মোবারক মিয়া মেয়েকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে আবার ধমকে উঠল, চুপ কইরা কি ভাবতাছত, যা তোর মারে ক ভাত দিতে, রিকশা লইয়া বাইরইতে অইব।

আগামীকালই লুবাবার পরীক্ষার তারিখ। লুবাবা আর পড়তে বসে না। সে তো পরীক্ষার পড়া সব মুখস্থই করে ফেলেছিল। এগুলো এখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখে ঘুম আসছে না।

লুবাবা স্কুল ড্রেস পরছে। হাতে বোর্ড নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে স্কুলের দিকে যায় যায়। দফতরি ঘণ্টা বাজালেন। সব ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষার রুমে প্রবেশ করে। স্যারেরা খাতা দিতে লাগলেন।

আরেকটি ঘণ্টা পড়তেই স্যারেরা প্রশ্ন দিয়ে গেলেন। লুবাবার আজ বাংলা পরীক্ষা। প্রশ্ন খুবই সহজ। লুবাবা লিখতে শুরু করে। আরে কলমে যে কালি আসছে না। সে তো ভালো কলমই কিনেছিল। কালি আসছে না কেন? কাউকে ডাকতে গেলে মুখে আওয়াজ আসছে না। তার হাত-পা যেন অবশ হয়ে আছে।

খুব অস্বস্তিতে লুবাবার ঘুম ভেঙে গেল। লুবাবা বুঝতে পারল এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখেছিল। তার তো পরীক্ষা দেওয়ার কথা না। বাবাই তো বলল, তার আর পড়ালেখা করতে হবে না। পরীক্ষা না দিতে পারবার কষ্ট নিয়েই লুবাবা আবার ঢলে পড়ে ঘুমের কোলে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর