- আচ্ছা দাদু, আমাদের এখানে তো একটাই বিশাল বড় আয়তনের বন। যে বনের অধিকাংশ গাছেই তো শালগাছ। এই বনের নাম তো শালবন বা শাল বাগান হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা না হয়ে ‘পিঁপড়ার বন’ নাম হয়েছে কেন? যে কোনো বনে তো মানুষজন ঘুরে বেড়াতে যায়, ওখানে যায় না কেন? কীসের ভয়ে যায় না? দাদির কাছেও জানতে চেয়েছিলাম, বলতে পারেনি, তুমি কি জানো?
হাসতে হাসতে দাদু বলে, জানি তো, জানব না কেন? ছোট্টবেলায় ওই বনের অনেক গল্প শুনেছি। অত্র এলাকার এটিই সবচেয়ে বড়ো বন, অসংখ্য গল্প আছে এই বনকে ঘিরে। আমি ওই সময়টা নিজ চোখে দেখিনি, তবে শুনেছি ওখানে একসময় কয়েক জাতের বাঘ ছিল। এক সাংঘাতিক রকমের ঘটনায় খাবারের অভাবে, না খেতে পেয়ে বাঘগুলো মরতে মরতে শেষ হয়ে গেছে।
- তাই নাকি? বড়সড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে ডালিম।
- বলো না দাদু, আমি শুনতে চাই সেই ‘পিঁপড়ার বনের’ গল্প। কী কারণে খাবারের অভাবে, না খেতে পেয়ে মরে গিয়েছিল বাঘগুলো, আর বাঘ মরার সাথে পিঁপড়ারই বা কী সম্পর্ক? আমি জানতে চাই দাদু।
পা তুলে বিছানায় আরাম করে বসে বললো দাদু, তবে শোন, কেন ওই বন ‘পিঁপড়ার বন’ হলো এর গল্প।
সে অনেকদিন দিন আগের কথা, আমারও জন্মের অনেক আগে। ওই বনে একসময় বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুর বসবাস ছিল। পুরো বনজুড়ে ছিল পাখপাখালিদের আনাগোনা, মুখরিত ছিল কলরবে।
- আচ্ছা দাদু, তুমি না বললে এ তোমারও জন্মের অনেক আগের কথা, তাহলে তুমি এসব জানলে কী করে?
- এই যে তুমি যেভাবে আমার মাধ্যমে জানতে চাইছো, সেই ভাবে- আমিও ছোটবেলায় আমাদের এলাকার প্রবীণ মানুষগুলোর কাছে থেকে জেনে নিয়েছি।
- ও - তাই বলো। বেশ দাদু তারপর বলো কী হয়েছিল? খুব মনোযোগ সহকারে আগ্রহভরে দাদুর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ডালিম।
- শোন, বনে যতোগুলো প্রাণী ছিল, ওদের রাজা ছিল বাঘ। তবে এই রাজা নির্বাচনের বিষয়টি ছিল একটু ব্যতিক্রম। সাধারণত অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সের ও জ্ঞানী গুণীদের মধ্য থেকে রাজা নির্বাচনের প্রচলন থাকলেও এই বনের নিয়মকানুন ছিল একটু অন্যরকম। সেখানে বিবাহ উপযুক্ত বাঘদের মধ্যে থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি কোনো রাগী বাঘকে রাজা নির্বাচন করা হতো। এর মূল কারণ হলো, ওদের ধারণা রাজা যদি বদমেজাজের খুব রাগী হয়, তাহলে বাইরের শত্রুদের আক্রমণ থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকা যাবে। রাজার ভয়ে বাইরের কোনো জীবজন্তু, এমনকি মানুষ পর্যন্ত বনের ধারের কাছে আসতে ভয় পাবে।
- নড়েচড়ে ভালোমতো বসে ডালিম বলে, বলো দাদু তারপর কী হলো?
- এক সময় ওই বনের জীবজন্তুগুলো এমন এক বাঘকে রাজা বানিয়েছিল, যে শুধু বদ মেজাজেরই ছিল না, অত্যাচারীও ছিল! অন্যান্য প্রাণীদেরকে শুধু শাসনই করতো না শোষণও করতো! বাঘ ছাড়াও বনে হরিণ, খরগোশ, শিয়াল, বনবিড়াল ইত্যাদি প্রাণীর বসবাস ছিল। অত্যাচারী রাজা, অন্যান্য জীবজন্তুদেরকে ধরে এনে ওদের বুক ফাঁড়িয়ে কলিজা খাওয়া শুরু করে দিয়েছিল। মাংস খেত না, শুধু কলিজাটুকু ছিঁড়ে খেত, অবশিষ্ট পুড়ো দেহটা পড়ে থাকতো, যা বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ খেয়ে ফেলতো। শুধু কলিজা খেয়ে বেঁচে থাকতে এক রাজার জন্যই প্রতিদিন চার-পাঁচটা প্রাণীকে শিকার করা লাগতো।
এ অন্যায়ের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল, কিন্তু রাজার স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। ফলে বাঘ ছাড়া অন্যান্য জীবজন্তুগুলো বন ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল।
খুব মনোযোগ সহকারে দাদুর গল্প শুনছিল ডালিম। মায়ের ডাকে নীরবতা ভাঙে, কিছুটা বিরক্তির স্বরে গলা উঁচিয়ে জবাব দেয়, একটু পরে আসছি মা।
- বাকিটুকু পরে বলব, মা খেতে ডাকছে যাও এখন।
- না দাদু, একটু পরেই যাই। তুমি বলো তারপর কী হয়েছিল?
নাতির পীড়াপীড়িতে দাদু বলতে থাকে, তারপর আর কী হবে, যা হবার তাই হলো। অত্যাচারী রাজার আফসোসের সীমা রইল না। এক সময় যেগুলো না খেয়ে ফেলে দিত, এখন এর থেকেও বাজে খাবার জোটে না। ওদের শিকার হওয়ার মতো আর কোনো প্রাণীই রইল না বনে। সেই কারণে একসময় কঠিন খাদ্য সংকটে পড়েছিল। শুনেছি কিছু বাঘ পেটের ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে, নিজেদের দেহের মাংস নিজেরাই ছিঁড়ে খেত! শেষ পর্যন্ত জীর্ণশীর্ণ হয়ে এক এক করে সবগুলো বাঘ মরে পড়ে ছিল বনে।
- তারপর?
ওই মৃত বাঘগুলোকে খেতে দূরদূরান্ত থেকে অজস্র পিঁপড়া এসেছিল। তখন থেকে পিঁপড়ার দখলে পুরো বন। লাল পিঁপড়ার কামড়ের ভয়ে বনে কেউ বেড়াতে যায় না, আর সেই কারণেই ওই বনের নাম হয়েছে ‘পিঁপড়ার বন’।