সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

তারেক রহমান : মিথ ও বাস্তবতা

সাইফুর রহমান

তারেক রহমান : মিথ ও বাস্তবতা

পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষের একটি বইয়ের নাম 'জার্নাল'। এই বইয়ের একটি প্রবন্ধের নাম 'জীবনচরিত'। এতে তিনি ম্যাঙ্মি গোর্কির লেখা টলস্টয়ের জীবনচরিত সম্পর্কে সম্যক আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, এ ধরনের বই আমাদের দেশে লেখা হবে না কখনো। কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন, আমরা আমাদের লেখায় সাধারণত মানুষকে হয় দেবতা করে তুলি, নয়তোবা তাকে দেখাব পুরোদস্তুর একজন শয়তান হিসেবে। গোর্কি, তার বইয়ে টলস্টয়ের যে ছবি এঁকেছেন তাতে কখনো টলস্টয়কে মনে হয় একজন সাধারণ মাপের মানুষ, কখনো মনে হয় অপকৃষ্ট। গোর্কি অবাক হয়ে যান টলস্টয়ের অনেক ঐতরিক ব্যবহারে। কিংবা অনেক আঘাতকারী মন্তব্যে। টলস্টয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে ছেলেমানুষের মতো লুটিয়ে পড়েন গোর্কি। অথবা তার দিকে তাকিয়ে ভাবেন লোকটা হয়তো ঈশ্বর, যদিও গোর্কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এরকম করে যে লেখা যায়, আমাদের দেশে এই বোধটাই তৈরি হয়নি এখনো। কবি শঙ্খ ঘোষ তার এই জার্নাল বইটি লিখেছিলেন সম্ভবত ষাট কিংবা সত্তরের দশকে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে তিনি হয়তো তার নিজস্ব দার্শনিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী ৩০-৪০ বছরে আমাদের মনোজগতে ঘটে গেছে বিপুল পরিবর্তন। এখন আমরা আর কাউকে দেবতা হিসেবে ভাবতে পারি না। কিংবা কাউকে দেবতা হিসেবে মেনে নিতেও পারি না। এখন শুধু কেউ হয় অর্ধশয়তান। কিংবা কখনো পূর্ণ শয়তান। এখন আমরা আমাদের কথাবার্তা লেখায়, আলোচনা ও সমালোচনায় কাউকে অর্ধনগ্ন করি। কিংবা কাউকে করি সম্পূর্ণ নগ্ন। আর এই তালিকা থেকে বাদ যায় না নোবেলজয়ী ড. ইউনূস, আইনের দিকপাল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, বাংলাদেশের সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন কিংবা বঙ্গবন্ধুর পর যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিভূ হিসেবে চিহ্নিত করি সেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো বাংলাদেশের কালোত্তীর্ণ দেশবরেণ্য সন্তানরাও। এখন তারেক রহমান প্রসঙ্গে আসা যাক।

মাধ্যমিক পর্যায়ে তারেক রহমান লেখাপড়া করেন রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে। উচ্চ মাধ্যমিক আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে এবং স্নাতক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি তৃণমূল পর্যায় থেকে সুদীর্ঘকাল রাজনীতি করে ২০০২ সালের ২২ জুন বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। এ পর্যন্ত পৌঁছতে গিয়ে তাকে ঘিরে তৈরি হয় নানা বিতর্ক, বহু আলোচনা-সমালোচনা এবং তার সম্পর্কে তৈরি হয় কিছু কিংবদন্তি ও মিথ। সেই মিথের কতটা রিয়ালিটি সে বিষয়ে এখানে আলোচনা করব। তার আগে তারেক রহমানের শৈশবের একটি ঘটনা সম্পর্কে জানা যাক। ঘটনাটি বর্ণনা করেছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও ঢাকা বিষয়ে গবেষক নাজির হোসেন। তার 'কিংবদন্তির ঢাকা' নামের বইটিতে। পাঠকদের উদ্দেশে আমি লেখকের লেখা অংশটুকু এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি।

'শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার স্ত্রী-পুত্রদেরও সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত রাখতেন। এক দিন আজিমপুর গার্লস স্কুলে যুব রেডক্রস র্যালি উপলক্ষে রেডক্রস সদর দফতরে যুব রেডক্রস কর্মীদের নিয়ে সভা করছি। ঢাকা মহানগরীর রেডক্রস সভাপতির অনুপস্থিতিতে আমি সহ-সভাপতি হিসেবে সভার কাজ আরম্ভ করি। সভাকক্ষের সব আসন পরিপূর্ণ হয়েও অনেক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার অতি নিকটে পাতলা গড়ন একটি ফর্সা ছেলে সটান দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে বসতে বলাতে সে না বসে এটেনশন অবস্থায় দাঁড়িয়েই রইল। প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা র্যালি প্রোগ্রাম শেষ করে নাশতা দেওয়া হলো। পুনরায় বসে নাশতা করার জন্য বললাম। এবারও সে অস্বীকৃতি জানাল। নাশতা খেয়ে অনেকেই চলে গেলে, সে সামনে এসে আমাকে বলল, আব্বাকে আপনি বলবেন যেন আমাকে এ র্যালিতে আসতে দেয়। আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি তার দিকে। কার কথা বলছে? পেছনে দাঁড়ানো একজন বলিষ্ঠ পুরুষ বুঝতে পেরে আমাকে আস্তে আস্তে করে বলল, ইনাকে চেনেন না? ইনি তো রাষ্ট্রপতি সাহেবের বড় ছেলে। আমি ভরকে গেলাম। রাষ্ট্রপতির ছেলেকে দুই ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে রাখছি বলে। সে লোকটি জিয়ার ছেলের সিকিউরিটি গার্ড। সে চুপিসারে বললেন, আপনি রাষ্ট্রপতি মহোদয়কে কিছু বলবেন না। অগত্যা আমি মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তাকে বিদায় করলাম।' তাহলে এখন প্রশ্ন হলো যে, যিনি একটি আদর্শ কিংবা শৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, তিনি কেন আকস্মিক অপ্রত্যাশিত বিতর্কে নিপতিত হলেন। আমার মতে, এর দুটি দিক আছে। সেগুলোর একটি হচ্ছে মিথ এবং অন্যটি রিয়ালিটি। এখানে মিথ বলতে আমি জনগণের পারসেপশন অর্থাৎ জনগণের উপলব্ধি ও ধারণাকে বুঝাচ্ছি। আর রিয়ালিটি হচ্ছে মিথগুলো আদৌ সত্য কিনা, বা কতটা সত্য?

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, মিথ ও রিয়ালিটি দুটির কোনোটিকেই অগ্রাহ্য কিংবা অস্বীকার করার উপায় আমাদের কারোরই নেই। কারণটি অতি স্পষ্ট। একজন নেতা সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা সেটি জনগণের মন থেকে মুছে ফেলা সত্যি খুব দুরূহ। বর্তমান সরকার বিরোধী দলকে ঘায়েল করার জন্য সদাসচেষ্ট। তারা এই পাঁচ বছরে তারেক রহমানের একটি দুর্নীতিও প্রমাণ করতে পারেনি। আর এতেই আজ অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে এই মিথগুলো আদৌ সত্য কিনা?

এখন স্বভাবতই আরেকটি প্রশ্ন সামনে এসে যায়_ তাহলো মিথগুলোর জন্ম হলো কেন? এখানে দার্শনিক এরিস্টটলের একটি উক্তি বেশ প্রণিধানযোগ্য। একটি ভালো বন্ধু- সব সময় ঈশ্বরের পক্ষ থেকে একটি ভালো উপহার। এর পরের অংশটুকু যদিও দার্শনিক এরিস্টটলের নয়- উক্তিটি আমার নিজের- আর তা হলো_ একটি খারাপ ও পথভ্রষ্ট বন্ধু ঈশ্বরের পক্ষ থেকে একটি ভয়াবহ অভিশাপ। আর এই অভিশাপেরই শিকার হয়েছেন তারেক রহমান। বিষয়টি আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যা করছি। সেটি সম্ভবত ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাস হবে। এর কিছু দিন আগে আমি বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরেছি। তখনো প্র্যাকটিসে স্থিতু হতে পারিনি। এরই মধ্যে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের পুত্র ও আমার দীর্ঘদিনের সুহৃদ ব্যারিস্টার মীর হেলাল আমাকে এক প্রকার জোর করেই নিয়ে গেল হাওয়া ভবনে। উদ্দেশ্য আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে তারেক রহমানের সঙ্গে। আমি কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, জড়িত ছিলাম সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে। আমি বিএনপির রাজনীতির কি বুঝি? কিন্তু এক অজানা কারণে কেন জানি হেলালের মনে হলো আমারও কিছু করার আছে বিএনপির জন্য। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে হেলালের কাছে আমি বিভিন্নভাবে ঋণী। তাই তার কথাকে উপেক্ষা করার মতো সাহস ও শক্তি কোনোটিই আমার ছিল না। সেই সময় হাওয়া ভবনের তিনতলায় একটি ল'সেল খোলা হয়েছিল। হেলালই এক দিন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল তারেক রহমানের সঙ্গে। সন্ধ্যার পর তিন-চার মাস পালা করে বসতাম সেই ল'সেলটায়। যদিও তারেক রহমানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে কদাচিৎ এবং যৎসামান্যই। কিন্তু তাকে কাছ থেকে দেখার ও পর্যবেক্ষণ করার যথেষ্ট সুযোগ আমার ঘটেছিল। সদাহাস্যোজ্জ্বল এরকম বন্ধুবৎসল মানুষ সমাজে সত্যিই বিরল। তবে আজ বলতে দ্বিধা নেই-তার চারপাশে বিচরণ করত রাজ্যের অতি উচ্চপর্যায়ের চাটুকার, অযোগ্য ও অথর্ব সব স্তাবকের দল। অবশ্য হাতেগোনা কিছুসংখ্যক মানুষ যেমন- অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, নওশাদ জমির, আতিকুর রহমান রুমনসহ আরও বেশকিছু মেধাবী যাদের সবার নাম এ মুহূর্তে অবশ্য আমি মনে করতে পারছি না। তারা ব্যতীত বেশির ভাগ লোকই ছিল মেধাশূন্য ও মগজহীন। তাদের সবাই বাংলাদেশের একেক অঞ্চল থেকে আগত রাজনীতির বেশধারী দাপুটে ও মারকুটে শ্রেণীর মানুষ। তাদের নামগুলোও বেশ অদ্ভুত ধরনের। মাঝে মাঝে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করত আপনার আশপাশের ওই মেধাশূন্য মগজহীন মানুষগুলো রাজনীতির কি বোঝে? কারণ আমি জানি, রাজনীতি মানে, মাঠ, ঘাট, হাট দখলে থাকা নয়। রাজনীতি মানে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা নয়। শতসহস্র লোক সঙ্গে নিয়ে এলাকা টহল কিংবা চষে বেড়ানোও নয়। রাজনীতি মানে অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়। রাজনীতি মানে জনতার সামনে প্রথাগত কিছু বুলি আওড়ানোও নয়। আমি মনে করি, রাজনীতির দেশ-কাল-স্থান পাত্রভেদে সর্বজনীন একটিই অর্থ- সেটি একক ও অদ্বিতীয়। আর সেটি হচ্ছে- নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য কিছু করা, সমাজের পরিবর্তন ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন। কেউ হয়তো বলবেন, কেন আমি এসব কথা তার সামনে উচ্চারিত করতাম না। আমি একজন অন্তর্মুখী মানুষ। এটি আমার বিনয় নয়। এটি আমার নিরহঙ্কারতার জন্যও নয়। এটা আমার যথার্থই এক সঙ্কোচ আর এক স্নায়ুদৌর্বল্য, যা আমাকে সব সময় চেপে ধরে রাখে। আর আমি এটিও জানি যে, ভাষা দিয়ে কিংবা ধ্বনি দিয়ে সব সময় সব অনুভূতি প্রকাশ কিংবা বোঝানো যায় না। তবে আমি এসব নিয়ে আলোচনা করতাম একটি মানুষের সঙ্গে। আমার ভাব কিংবা অদার্শনিক চিন্তা প্রকাশের একমাত্র অবিকল্প আশ্রয় বন্ধু হেলালের সঙ্গে। হেলাল কিছুটা আক্ষেপের সুরে জবাব দিত- ভাই আপনি কি চাইলেই রাতারাতি দেশের রাজনৈতিক এই কুপ্রথাগুলো পরিবর্তন করতে পারবেন? তা ছাড়া আমাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলেরও তো অভয়াশ্রম সেই কুখ্যাত মারকুটে শ্রেণীর লোকজনই। এসব লোক ছাড়া তাদের মোকাবিলাই বা আপনি কীভাবে করবেন? কথা সত্য সন্দেহ নেই, তবে আমি সারা জীবন সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালোই বলি। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারেক রহমানের লিডারশিপের যে পরিস্ফুটন ঘটেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেটি সম্ভবত ছিল তার সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই, যা তিনি তার পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। আমি দৃষ্টান্তে বিশ্বাসী তাই দুটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি।

২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে চ্যানেল আইকে দেওয়া তারেক রহমান তার জীবনের প্রথম টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ জিয়াউর রহমানকে সঠিক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে এবং অতীতের সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি তাহলে নিশ্চয়ই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ে তুলতে পারব। তারেক রহমান শুধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যথাযথ মূল্যায়নের কথাই বলেননি, তিনি ২০০৪ সালে সম্ভবত জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে, গোপালগঞ্জ স্টেডিয়ামে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের একটি অনুষ্ঠান শেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেছিলেন। আমাদের দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি বিরল ঘটনা। কারণ আওয়ামী লীগের কোনো একটি মাধ্যম সারির নেতাও এরকম একটি ঔদার্য দেখানোর যোগ্যতা রাখেন বলে আমার মনে হয় না। আগেই বলেছি, তারেক রহমানকে নিয়ে কিছু মিথের অস্তিত্ব রয়েছে। কিংবা বিতর্কের ধূম্রজালও সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও বলব_ তার ঘুরে দাঁড়ানোর কিংবা সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সময় ও সুযোগ এখনো তার রয়েছে। এ পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষেরই কিছু না কিছু অন্ধকার দিক থাকে। আর সেই তালিকা থেকে বাদ যায় না বিশ্বখ্যাত মনীষীরাও। যেমন- সক্রেটিস, রুশো, আব্রাহাম লিংকন, জনএফ কেনেডি, বিল ক্লিনটন কিংবা বুশ জুনিয়রের মতো আরও বহু মনীষী।

প্রথমেই বলি সক্রেটিস সম্পর্কে : জ্ঞানের সমার্থক শব্দ বলা হয় সক্রেটিসকে। বেশির ভাগ পাঠকই হয়তো জানেন না, এই সক্রেটিসই ছিলেন দুই মলাটের যে বই আমরা আজ পড়ি তার বিরুদ্ধে। প্রাচীন পৃথিবীর আরও অনেক জ্ঞানতাপসের মতো তিনিও মৌখিক পরম্পরায় বিশ্বাস করতেন। মনে করতেন মানুষ বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হলে তাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পাবে। তারা মস্তিষ্কের ব্যবহার ভুলে যাবে। মোজেয, বুদ্ধ কিংবা যিশুর মতো তিনিও ছিলেন বাক্পতি। তিনি তার শিষ্য যেমন প্লেটো কিংবা জেনোফানদের বইয়ের ওপর নির্ভরশীল না হতে বার বার সাবধান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার শিষ্য-প্রশিষ্যরাও সক্রেটিসের এই ভুল পরামর্শ মেনে চলতে পারেননি। বিখ্যাত কানাডিয়ান লেখক ও গবেষক আলবার্তো মাঙ্গোয়েলের মতে এরিস্টটল ছিলেন প্রাচীন পৃথিবীর প্রথম পুঁথি সংগ্রহকারী। একটু ভাবুন তো সক্রেটিসের মতো জ্ঞানতাপস বইকে অস্বীকার করেছিলেন। এবার আসা যাক সপ্তদশ শতাব্দীর এক অন্যতম সেরা দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো সম্পর্কে। তিনি জন্মেছিলেন এক অতি দরিদ্র পরিবারে। দরিদ্রতার কারণেই অতি অল্প বয়সেই তাকে একটি ধনী ও অভিজাত পরিবারে গৃহভৃত্যের কাজ করতে হয়। রুশো তার আত্দজীবনমূলক গ্রন্থ দ্য কনফেশন্সে বলেছেন_''গৃহভৃত্য থাকাকালীন সময়ই আমার চুরি বিদ্যায় হাতেখড়ি হয়। প্রথম ছোটখাটো জিনিস দিয়ে চুরির অভ্যাস শুরু হলেও আস্তে আস্তে কিছু দিনের মধ্যেই আমি একজন পাক্কা চোর হয়ে উঠলাম।'' তাছাড়া নিজে চুরি করে বাড়ির অন্য গৃহকর্মীর ওপর দোষ চাপাতেও রুশোর জুরি ছিল না। অন্যদিকে তার চারিত্রিক স্খলন ছিল সীমাহীন। ফ্রান্সের বিভিন্ন গণিকালয়ে ছিল তার অবাধ বিচরণ। কিন্তু আজ পৃথিবীর মানুষ রুশোর সেই অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে ভাবেন না। তার সৃষ্টিকর্ম অতিক্রম করে গেছে তার খারাপ দিকগুলোকে। এবার কয়েকজন রাজনীতিবিদের অন্ধকার জগৎ নিয়ে একটু আলোচনা করি।

প্রথমেই বলি আব্রাহাম লিংকনের কথা : পাঠকবৃন্দ একটি বিষয় শুনে আঁতকে উঠবেন যে, লিংকন ছিলেন একজন সমকামী। লিংকন গবেষক ও জীবনীকার ডেভিড হাবার্ড ডোনাল্ড ও থমাস চেম্বারলিনের মতে কমপক্ষে তিনজনের সঙ্গে লিংকনের সমকামিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ডেভিড ডেরিকসন যিনি ছিলেন সুদীর্ঘকাল লিংকনের দেহরক্ষী। লিংকনের দীর্ঘদিনের রুম সঙ্গী যশোয়া ফ্রে স্পিড ও উইলিয়াম গ্রিন। লিংকনের এই সমকামিতার বিষয়গুলো অনেক আগে থেকেই অনেকের জানা ছিল। কিন্তু লিডারশিপ দক্ষতায় লিংকন এত উচ্চে আহরণ করেছিলেন যে, সেগুলো নিয়ে এতদিন কেউ উচ্চবাচ্য করতে আগ্রহী হয়নি। অন্যদিকে বিল ক্লিনটন অঙ্ফোর্ডে পড়ার সময় গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে জর্জ বুশ জুনিয়র ছিলেন একজনের মদ্যপ ব্যক্তি। যিনি মদ্যপ অবস্থায় বহুবার সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলেন। আর, জনএফ কেনেডির নারীপ্রীতি কিংবা মেয়েদের প্রতি দুর্বার আসক্তি তো সর্বজনবিদিত। তারপরও লিডারশিপ দক্ষতা দিয়ে তারা তাদের অন্ধকার দিকগুলো ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। খ্যাতি পেয়েছিলেন অসামান্য রাজনীতিবিদ হিসেবে। বাংলাদেশের কোটি মানুষের প্রত্যাশা শত প্রতিকূলতা ও অন্ধকার ভেদ করে তারেক রহমান একদিন আবির্ভূত হবেন বাংলাদেশের অন্যতম ত্রাণকর্তা হিসেবে।

লেখক : সাহিত্যিক ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী

ই-মেইল : [email protected]  

 

 

সর্বশেষ খবর