সোমবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

বিএনপির মূল সংকটটি কোথায়?

আমীর খসরু

বিএনপির মূল সংকটটি কোথায়?

বিএনপির জন্ম সামরিক শাসনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে হলেও বাস্তবে এই দলটির পুনঃজন্ম হয়েছিল সামরিক শাসনবিরোধী তীব্র আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই। আর এর মাধ্যমে বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে এবং বেড়ে উঠতে শুরু করে। মধ্যপন্থার বা মধ্যবর্তী অবস্থানের রাজনৈতিক দল হিসেবে দলটির যাত্রা শুরু হলেও ৯০ দশকের শুরুর দিক থেকেই এক্ষেত্রে বিচ্যুতির লক্ষণগুলো দেখা যেতে থাকে। বিএনপির উদারপন্থি, মধ্যপন্থি এবং এককালের বামপন্থি নেতারা ক্রমাগত কোণঠাসা হতে থাকেন এবং দলটি ক্রমান্বয়ে ডানদিকে সরতে থাকে অর্থাৎ সোজা কথায় এর মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী লক্ষণগুলো ক্রমবিস্তারী ভূমিকা পালন করে। দলটির জন্মের যে কারণ তাহলো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া- যা আগেই বলা হয়েছে। প্রধান প্রতিক্রিয়া ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ শাসকদের স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপক্ষে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা। যারা ওই সময় ওই সরকারটির বিপক্ষে কার্যকরভাবে সমবেত হতে পারছিলেন না কোনোভাবেই, তাদের নতুন এই দলটিতে জড়ো করা হয়েছিল। এর মধ্যে তৎকালীন বামপন্থি ও প্রগতিশীল নেতাদের সংখ্যাধিক্য ছিল। তবে ডানদের সমবেত হওয়ার সংখ্যাও কম ছিল না। কিছু উগ্র ডানও ওই সময় দলটিতে ঢুকে পড়ে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, এই দলটির জন্মের পেছনে ওই সব পক্ষেরই যেখানে ঐক্য ছিল তা হলো- রাজনৈতিকভাবে আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী শক্তির বিরোধিতার একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম খুঁজে পাওয়া। কিন্তু মধ্যপন্থা ছেড়ে ক্রমান্বয়ে দলটির মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থানের ফলে রাজনৈতিকভাবে ওই আধিপত্যবাদী শক্তির বিরোধিতা ধর্মীয় কারণে বিরোধিতায় রূপ নিতে থাকে। আর তখন থেকেই এই দলটির মূল সংকটের শুরু। যারা আধিপত্যবাদী ওই শক্তিটিকে প্রতিহত বা প্রতিবাদ করাকে রাজনৈতিক ইস্যু বিবেচনা না করে ধর্মীয় ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করার ভয়ঙ্কর ভুল পথ গ্রহণ করেছিল- বিএনপির বেশ কিছু নেতা এক্ষেত্রে মুখ্য এবং প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা পালন করে। দলের মধ্যে তারা ক্রমাগত দলকে ডানদিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। এদের কারণেই মধ্য ৯০-এ এর সমর্থক দৈনিক 'ইনকিলাব' বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করার পর্যায়ে চলে যায়।

আর এসব কারণে মধ্যপন্থার রাজনৈতিক দলটি ক্রমাগত ডানে সরতে এবং এর জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা মূলত মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনায় আচ্ছন্ন হতে থাকে। এ কারণে অল্পকালেই সত্যিকারের উদার জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী দলটির সমর্থক গোষ্ঠীর অনেকের মনেই সন্দেহ, শঙ্কা এবং কারও কারও মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে। আধিপত্যবাদী শক্তিটির শক্তি এবং চাপ প্রয়োগের বিপক্ষে এই দলটি ক্রমাগত দুর্বল হতে শুরু করে। আর এটা এমনই এক প্রতিক্রিয়ার চক্র- যা ক্রমশ ভ্রান্তির জন্ম দেয়- এই দলটির ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এখানে বলা প্রয়োজন, এ দলটির সমর্থক ও ভোটাররা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে সবল-সতেজ জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ড ওই দলটির কাছ থেকে আশা করেছিল- সে আশা পূরণে দলটি ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিতে থাকে। এ কারণে ভ্রান্তি, দোদুল্যমানতা এবং দুর্বলচিত্ততার কারণে সৃষ্ট দুর্বলতার জন্য ওই শক্তিটিকে তারা ভয়ের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে ক্ষমতার স্বার্থে। তারা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে জনগণের শক্তিতে। জনগণের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার কারণে দলটি এখন লোকদেখানো হুংকার দিতে পর্যন্ত ভয় পায়। সবল বিকল্প কোনো জাতীয়তাবাদী শক্তি থাকলে অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো শক্তি নেই বলেই তাদের উপরে জনআস্থা না থাকলেও নেতিবাচক ভোটের কারণে দলটি নিজেদের শক্তিমান ও বলশালী বলে মনে করে।

মধ্যপন্থা থেকে ডানে সরে যাওয়া এ দলটিতে অন্যান্য নানা বিচ্যুতি এবং ভ্রান্তিও দেখা দিতে শুরু করে, বলতে গেলে প্রায় একই সঙ্গে। কারণ মূল জায়গায় গলদ থাকলে অন্যত্র এর সংক্রমণ হতে বাধ্য। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত যদিও দলটি নিজেদের শক্তি সম্পর্কে অবহিত বা অবগত ছিল না। কিন্তু নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্ষমতাশ্রয়ী দল হিসেবে তাদের কলাকৌশল প্রণয়ন করতে থাকে এবং নিশ্চিতভাবে ক্ষমতার প্রচণ্ড মোহ ও এ কারণে সৃষ্ট ভুল-ভ্রান্তির মধ্যে দলটি পড়তে থাকে। তবে ক্ষমতায় থেকে জন্ম নেওয়া দল হলেও নানা মত, নানা পথকে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান এক পথে, এক মতে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে বহু মত, বহু পথের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি কর্ম-সম্পর্ক (ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ) তৈরি হয়েছিল। ক্ষমতায় আসার পরে তা আবার শিথিল হতে শুরু করে।

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় অভ্যস্ত ও মানসিকভাবে প্রস্তুত বিএনপি সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার মধ্যে এই দফায় যাত্রা শুরু করে। ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদীয় পদ্ধতির নামে কার্যত দেশে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা কায়েম হয়। এ কারণে বিএনপির প্রধানকে এই ব্যবস্থায় খাপ খাইয়ে নিতে খুব একটি বেগ পেতে হয়নি। বরং সীমাহীন ক্ষমতার কারণে আরও ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

বেসামরিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রথম দফার শাসনকালে বিএনপি এবং এর নেত্রী ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতি শুরু করলেও বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য কিছু কারণে তাদের মধ্যে সব সময় প্রথমবারের ভীতি যেমন কাজ করেছিল, তেমনি অনভিজ্ঞতাও তাদের জন্য না জেনে হলেও আশীর্বাদ এবং সহায়তা হিসেবে আবির্ভূত হয়। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিক থেকেই দলটি আওয়ামী লীগ, জামায়াত এবং সদ্য ক্ষমতা হারানো জাতীয় পার্টির প্রবল বিরোধিতা মোকাবিলা এবং অনভিজ্ঞতার কারণে ওই দফায় বিএনপি খুব বেশি একটা দুর্দমনীয়, দুর্বিনীত হয়ে উঠতে পারেনি। এখানে দুটি বিষয় অবশ্য কাজ করেছে। আর সেটি হচ্ছে বিএনপি তার একক শক্তির ওপর ভর করেই শাসন কাজটি করছিল। এর ওপরে জামায়াত এবং তারেক ফ্যাক্টর তখন অনুপস্থিত ছিল। এরপরও একদলীয় একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে বিএনপির গায়ে কালো দাগ লাগলেও ১৯৯৬-এর পরে আবারও বিরোধী দলে যাওয়া বিএনপি বেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করল নিশ্চিতভাবে, তারা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসবে- কারণ দ্বিদলীয় রাজনীতির ধারার সূচনা এর আগেই আমজনতার মনোজগতে জাগ্রত হতে শুরু করে। বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসবে এবং এটি আওয়ামী লীগের কার্যকর বিকল্প_ এ কারণে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তি ধীরে ধীরে এ দলটিতে ভিড় করতে শুরু করে। এরশাদ একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেকে দাঁড় করানোর এবং নিজের বৈধতার চেষ্টায় সব সময় রত থাকলেও তাতে কামিয়াব হতে পারেনি। রাজনৈতিক কর্মসূচির দিক থেকে এবং রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনার প্রকাশ্য চেষ্টার পরেও তার পক্ষে এটা সম্ভব হয়নি। বিএনপিই বিকল্প শক্তি হিসেবে টিকে যায়। আর এ কারণেই ওই সব বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী এবং ব্যক্তি এ দলটিকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যৎ ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার মনোবাসনা মনে লালন করতে থাকে। বিএনপি যেহেতু আগে থেকেই তার মধ্যপন্থার অবস্থান থেকে ডানে সরছিল সে কারণে স্বল্পকালেই জামায়াত তার সঙ্গে জুটে যায়। তাছাড়া জামায়াতের ওই সময় যেসব অভ্যন্তরীণ বিতর্ক এবং বিশ্লেষণ চলছিল তাতে তাদের অনেকেই মনে করতে শুরু করে বিএনপি তাদের স্বাভাবিক মিত্র- যা আওয়ামী লীগ নয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে একসঙ্গে ১৯৯৬ এবং এর আগে আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও জামায়াত তার অতীতকে মুছে ফেলতে পারেনি। বরং জামায়াতের উদারপন্থি অংশ বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ছে বা পড়তে পারে- এমন একটা ভীতি জামায়াত নেতাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল। আর এ কারণেই বিএনপির দিকে জামায়াত ঝুঁকতে থাকে এবং বিএনপিও জামায়াত ঘেঁষা হয়ে পড়ে। ২০০১ সালের আগে এ ঐক্য এমন একপর্যায়ে চলে যায় যাতে বিএনপির মধ্যে আরও ডানে ঝুঁকে পড়ার কর্মকাণ্ডগুলো চলতে থাকে। বিএনপির ভেতরে ইতোমধ্যে থাকা এবং পরে ঢুকে পড়াদের মধ্যে অনেকেই এমন এক তথ্য হাজির করল যে, নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রে জামায়াত ছাড়া বিএনপির চলবে না। যে বিএনপি একক শক্তির ওপরে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত শাসন কাজ করেছে, এর আগে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, সেই বিএনপিই ক্ষমতার কারণে বিশ্বাস হারিয়ে এককভাবে চলতে পারার বিশ্বাসটুকু হারিয়ে ফেলে। যদিও এককালের বাম ও প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তারা প্রথমদিকে এই প্রবণতা প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা সফল তো হনইনি বরং দলীয় ক্ষমতার মূল বলয় থেকে ছিটকে পড়তে থাকেন। আর আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, তরিকুল ইসলামসহ যারা সরব ছিলেন তারা হয় এটা মেনে নেন অথবা চুপ থাকার নীতি গ্রহণ করেন। ২০০০ সালের দিকে বিশ্লেষক নাজিম কামরান চৌধুরী ৩০০ আসনের আসনওয়ারী এক বিশ্লেষণে দেখিয়েছিলেন, জামায়াতকে সঙ্গে নিলে বিএনপি কীভাবে ব্যাপক সংখ্যক আসন নিয়ে জয়লাভ করবে। কিন্তু এই বিশ্লেষক জনগণের মনের বাস্তব অবস্থাকে চেপে গিয়েই এমন একটা বিশ্লেষণ হাজির করেন।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। কিন্তু দীর্ঘকাল পরে ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ অতিমাত্রায় যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা তারা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় জনগণ খুবই বিরক্ত ছিল। আর এ কারণে নেতিবাচক বা বিকল্পের কারণে ভোট প্রদানের মনোভাব তাদের মধ্যে তৈরি হতে থাকে এবং এর পুরোটা লাভ গিয়ে পড়ে বিএনপির দিকে। নেতিবাচক ভোট প্রদান বাংলাদেশে কম-বেশি সব সময় বিদ্যমান থাকলেও এই প্রথম এটি স্থায়ীভাবে রূপ নেয়। তা ছাড়া একনাগাড়ে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হতে না দেওয়ার জনগণের সৃষ্ট ভারসাম্য জনগণই কার্যকর করে ফেলে। এ দুটি বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। ২০০১-এর অক্টোবরে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য এর বহু আগে থেকে বিএনপির আপ্রাণ চেষ্টার অংশ হিসেবে এবং অতিমাত্রায় ক্ষমতা-প্রিয়তার কারণে যা কিছু করণীয় সবকিছুই করতে থাকে। এখানে দলটির অতীত যেসব আপসহীনতার বিষয়গুলো ছিল, তা তারা বিসর্জন দিতেও কোনো আপত্তি করল না। বিএনপি ওই সময় জেনারেল এরশাদের সঙ্গেও হাত মেলায়, যদিও শেষ পর্যন্ত ওই ঐক্য কার্যকর থাকেনি। বিএনপির আপসহীন অবস্থান আগে থেকেই খসে পড়তে শুরু করলেও এরশাদের সঙ্গে ঐক্য করার মধ্য দিয়ে ওই অবস্থান পুরোপুরি ভেঙেচুড়ে তছনছ হয়ে যায়। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল বিএনপিকে এমন আত্দবিশ্বাসী করে তোলে- যা অচিরেই তাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুই-তৃতীয়াংশ আসন প্রাপ্তির পেছনে যে বিশাল জনপ্রত্যাশার সৃষ্টি হয় বিএনপি তা যেমন উপলব্ধি করতে পারেনি, তেমনি ওই ফলাফল ক্ষমতার অহংকার তাদের মনের মধ্যে সৃষ্টি হতে শুরু করে। অল্পকালেই এ দলটি জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙতে থাকে এবং ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সুশাসন নির্বাসনে যেতে থাকে এবং দুঃশাসন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দুর্নীতির কথাটি ব্যাপক মাত্রায় শোনা যেতে থাকে এবং জনগণের মধ্যে এ ধরনের একটি ধারণা বিশ্বাসে পরিণত হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে তৎকালীন বিরোধী দলের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা সফল হয়েছিল। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- জনগণের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি অথবা তারা যা বিশ্বাস করে। এই দফায় জনগণের এ মনোভাব এবং বিশ্বাসের কারণে বিএনপি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিএনপির এ দফার শাসনামলে এ কারণে জন-মনোভাব ক্রমাগত নেতিবাচক হয়ে ওঠে।

২০০১ সালের আগে গড়ে ওঠা তারেক রহমানের নির্বাচনী অফিসটি ক্ষমতায় আসার পরপরই ক্ষমতার অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। আর এ কারণে ক্ষমতার নানা আনুষ্ঠানিক উপকেন্দ্র এবং অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র গড়ে ওঠায় জটিলতা বাড়তে থাকে। আনুষ্ঠানিক কেন্দ্রের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগির হিস্যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র বেশি শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর হয়ে পড়ায় পুরো সরকার ব্যবস্থার ভারসাম্যে জটিলতা দেখা দেয়। এ জটিলতা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপরও প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এ জটিলতা এবং সংকটটি নানা টানাপড়েনের সৃষ্টি করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আনুষ্ঠানিক কেন্দ্রের ক্ষমতা কমে গিয়ে অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রটি বেশি ক্ষমতাধর হয়ে পড়ায় প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে থাকে। এমন এক সংকটের সৃষ্টি হয়, যা থেকে মূল সরকারটি শেষ দিন পর্যন্ত আর বের হতে পারেনি। অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রের কারণে নানা অনানুষ্ঠানিক উপকেন্দ্রের এবং সুযোগসন্ধানীর জন্ম হয়। এ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি এবং অনিয়মকে চূড়ান্ত পর্যায়ে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হতে থাকে। এই জটিলতা এবং সংকটটি দলকেও মারাত্দক ক্ষতির সম্মুখীন করেছে। তাদের অধিকাংশ সমর্থক এটা মেনে নেয়নি। এর ফলে দলের বিশাল অংশের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে হতাশা ও দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। বিএনপি এই সংকটটি থেকে আজ পর্যন্ত বের হতে পারেনি। আর তাদের সমর্থকদের বিশ্বাসে ও আস্থায় যে ধস নেমেছিল তা কাটিয়ে ওঠাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আগেই বলা হয়েছে, ক্রমাগত ডানে সরতে থাকা একটি দলের যে সংকট তা আরও তীব্রতর হয় জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠনে। এটা চূড়ান্ত রূপ পায় ক্ষমতার অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রের কার্যক্রমে।

এমন একটি পরিস্থিতি দুই কারণে দলটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে- এক. ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দলেও নানা বিভক্তি ও উপদলীয় কোন্দল দেখা দিয়েছে। অনানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক কেন্দ্রের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে সরকারের সংকটটি দলকে বরং বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দুই. দলের সমর্থক এবং সাধারণ ভোটারদের সহানুভূতি তারা অনেকাংশে হারিয়েছে।

এ ধরনের নানা সংকটের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন বিরোধী দলের আন্দোলনে বিএনপি কার্যকর তো দূরের কথা সামান্য প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারেনি। এ সময়ে জামায়াতকে যতটা কাছে পাবে বলে বিএনপি আশা করেছিল, বাস্তবে তা তারা পায়নি। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, সরকারে থাকাকালীন অবস্থায় জামায়াত নিজেদের দলকে সংগঠিত করা ও গুছিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে যতটা মনোযোগী ছিল এবং ক্ষমতাকে তারা এ কারণে যতটা কাজে লাগিয়েছে, বিএনপি করেছে ঠিক তার উল্টাটি। এ পর্যায়ে বিএনপির জামায়াতনির্ভরতা আরও বেড়ে যায়। তবে জামায়াত বিএনপির ব্যর্থতার দায় নিতে চায়নি বলে ২০০৭-০৮ সালের সেনাসমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ইচ্ছাকৃত একটি দূরত্ব তৈরি করে- যা দীর্ঘকাল বজায় ছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে সেনাশাসনে বিএনপিই কার্যত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পেছনে নানা দেশি-বিদেশি কারণও অবশ্য আছে। নানাবিধ সংকটে সংকটাপন্ন দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালের ধকল আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এরপরে ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনোবলকে ব্যাপক মাত্রায় দুর্বল করে ফেলে।

রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে টেনে তোলার দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক ক্ষমতাসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাবের কারণে বিএনপি কার্যকরভাবে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন থাকার কারণে ক্ষমতাসীনতার খোঁয়ারি থেকে ওই দলটির অনেকে এখনো বের হতে পারেনি বলে দলে অনেক নেতা থাকলেও দলের দুঃসময়ে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিএনপিতে অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রের প্রভাবটি এখন প্রকাশ্য হয়েছে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দলের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে এখনো তাদের তাকিয়ে থাকতে হয়, যতদূর না দলের নেত্রী তার চেয়েও বেশি ওই কেন্দ্রটির দিকে। ফলে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া জনবিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে না পারলেও বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের দৃশ্যমান দুঃশাসন, স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব ও জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে এ সরকারের প্রতি জনগণের নেতিবাচক মনোভাব বিএনপিকে লাভবান করেছে। ওই প্রতিক্রিয়ার কারণে তারা নেতিবাচকভাবে বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু এ ভোটারদের ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে তিক্ত মনোভাব ও ক্ষোভের কারণে সৃষ্ট নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মন্দের ভালো হিসেবে বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়াকে দলটি নিজেদের প্রতি জনগণের ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে বলে যে হিসাব কষছে- তা একটি মস্তবড় ভুল। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সমর্থন বা ভোট পাওয়া ইতিবাচক কোনো বিষয় নয়। বিএনপি এ হিসাবটিতেও ভুল করে বসে আছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর পরে বিএনপির শীর্ষ এবং উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের মনের মধ্যে এ ধারণাটি বদ্ধমূল হয়েছে যে, তারা জনগণের ইতিবাচক মনোভাবের কারণে বিজয়ী হয়েছেন।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ নানা কর্মকাণ্ডে জনগণ ত্যক্ত-বিরক্ত। এই জনগণই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সরকারের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সন্দিহান। জনগণ সরকারের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দিন দিন ক্ষুব্ধ হলেও প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ বিভিন্ন গ্রুপ এবং ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ এবং পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগসহ কোনো বিষয়েই প্রধান বিরোধী দল কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। এমনকি করিডর, বন্দর ব্যবহার, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, রাজনীতি এবং অর্থনীতির বিষয়ে আধিপত্যবাদী শক্তির প্রবল ও ক্রমবিস্তারী কার্যক্রম- ভূমিকার ব্যাপারেও এ দলটি সব সময় চুপচাপ থাকার নীতি গ্রহণ করেছে। দলটি জনবিচ্ছিন্নতায় ভোগার কারণে বরং ওই শক্তিসহ অন্যান্য শক্তির সঙ্গে আপসরফার নীতি গ্রহণ করেছে। সংসদে তারা যত ছোটই হোক না কেন, কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। জনবিচ্ছিন্নতার বিষয়টি প্রকট হয়ে পড়েছে এ কারণে যে, রাজপথে যে আন্দোলন-সংগ্রাম যাই কিছু হয়েছে- তা হয়েছে প্রধানত ব্যক্তি এবং পরিবারকে কেন্দ্র করে, জনদুর্ভোগ বা জনআকাঙ্ক্ষার কারণে বলতে গেলে দলটি চুপচাপই ছিল।

কিন্তু এতসবের মধ্যেও নেতিবাচক সমর্থনের বিষয়টিকে বিএনপির ইতিবাচক বলে ধরে নেওয়া এবং সে ভিত্তিতে হিসাব-নিকাশ করতে থাকার কারণে ওই জনবিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এবং এখন আর এর সময় নেই। বিএনপির মধ্য থেকেও নেতা-কর্মী সমর্থকরা এমনটা বলে থাকেন, সুযোগ থাকতেও সুযোগ হারানোর দলে পরিণত হয়েছে বিএনপি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও অন্তর্গত ক্রনিক দুর্বলতার কারণে এ পথ গ্রহণে তারা বাধ্য হয়েছে। মানুষ ভোট দেবে কিন্তু তা ইতিবাচকভাবে অর্জনের কোনো উদ্যোগ বিএনপির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি।

একটি প্রশ্ন বারবার উত্থাপিত হচ্ছে_ জনগণ প্রস্তুত, বিএনপি শেষ সময়ে রাজপথে, কিন্তু জনগণ তাদের সঙ্গে রাস্তায় নামছে না কেন? জনগণ রাস্তায় নামছে না কারণ- বিশ্বাস এবং আস্থার সংকট রয়ে গেছে ওই দলটির পর। এরপরও আগামীতে কোনো নির্বাচন হলে এ দলটির জয়ের সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু তাও হবে নেতিবাচক ভোটের কারণে। ফলে বিএনপি যদি ওই নেতিবাচক সমর্থনদানকে ইতিবাচক সমর্থন হিসেবে ক্রমাগতভাবে গণ্য করতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে দলটির অস্তিত্বই বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির কারণে সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ওপরে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশলগত এবং সামগ্রিক রাজনীতির কারণে উদার জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থানপর্ব জনগণ দেখতে চায়। এবং এ জন্য তারা অপেক্ষা করছে। বিএনপি সে আকাঙ্ক্ষা আদৌ পূরণ করতে পারবে কিনা সে প্রশ্নটি অচিরেই মীমাংসা হয়ে যাবে।

লেখক : সম্পাদক, আমাদের বুধবার

[২৪.১১.২০১৩]

 

 

সর্বশেষ খবর