শিরোনাম
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

বাবার কাছে খোলা চিঠি

আজিজুস সামাদ ডন

অনেক দিন হয় বাবার সঙ্গে কথা হয় না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাজনৈতিক কোনো বিষয় নিয়েই কথা হয় না। পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিলেও বাবার পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হওয়া আমাকে সামনের দিকে এগুতে দিচ্ছে না। বাবার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ইতিহাস, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাদের অবস্থান নিয়ে বাবাকে বার বার বলতে চেয়েছি কিন্তু বলা হয়নি। আজ বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাকে বলতেই হচ্ছে না বলা কথাগুলো।

বাবা,

নয় বছর দেখা হয় না। কোনো পরামর্শ পাই না আপনার। ধৈর্য ধরতে ধরতে ক্লান্ত বাবা। আমরা সবাই ভালো আছি। আমাদের পারিবারিক ঐক্যে কোনো শত্রু এখন পর্যন্ত কোনো ফাটল ধরাতে পারেনি। তার প্রমাণ আমরা গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখেছি। আপনার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিবার (দু-চারজন স্বার্থপর নেতা বাদে) ও আত্দীয়স্বজন ঐক্যবদ্ধভাবে আমার সমর্থনে এগিয়ে এসেছে, প্রাণপণ কাজ করেছে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন বাবা আমি একটি নির্বাচন করেছি। দুঃখের সঙ্গে বলতেই হচ্ছে, সুনামগঞ্জে আপনার তৈরি করা নৌকায় আমি উঠতে পারিনি। নয় বছর অপেক্ষা করেছি নৌকায় ওঠার জন্য, প্রতিবারই সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে না বলা হয়েছে। কিন্তু এবার সেটা তো করা হয়নি, উল্টো সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে ডেকে নিয়ে বলা হয়েছে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করলে যেন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো না হয়। আমি স্বতন্ত্র থেকে মনোনয়ন দাখিল করে বড় আশা নিয়ে ১০ দিন ঢাকায় এসে বসে রইলাম, যদি উচ্চপর্যায় থেকে ডেকে অন্যবারের মতো কিছু বলা হয়। সে আশা নিরাশা হয়ে রইল। কারণ, হয়তো হরেক রকম ব্যস্ততা, হয়তো আরও অনেক কিছু। এ সময় ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ফিরে গেলাম এলাকায় নির্বাচন করতে। তবে নির্বাচনের মাঝামাঝি সময়ে আমাকে কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহসম্পাদক করে উৎসাহিত করা হয়। আমি ভেবেছি এটুকুই বোধ হয় দলের ও দেশের প্রতি আপনার অবদানের স্বীকৃতি। অবশ্যই আপনার রাজনৈতিক কর্মের দেনা-পাওনার হিসাব আপনি শেষ করেছেন। আপনার পরিবারের বিশেষ আর কিছু পাওয়ার আশা করা উচিত না। যদিও অন্যান্য রাজনৈতিক পরিবারের মানুষ আপনার দলের কাছ থেকে প্রচুর মূল্যায়ন পেয়েছে, তবু আপনি তাদের তুলনায় দেশের বা দলের জন্য এমন কিইবা করেছেন যে এর চেয়ে বেশি আশা করা যায়। শুধু '৭৫-পরবর্তী সময়ে যখন আওয়ামী লীগের নাম নিতে মানুষ ভয় পেত, আমরা সামাদ আজাদের পরিবার জানতে পেরে ঢাকা শহরে আমাদের কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে সাহস পায়নি, নেতারা সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে অথবা জেলে, যখন দলের ভেতরে প্রবল দ্বন্দ্ব যে দলের নাম বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ ইচ্ছা 'বাকশাল' হবে না পুরনো আওয়ামী লীগে ফিরে যাবে, তখন আপনি জেলে এবং নবগঠিত আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। জেলে থেকেও আপনার শক্ত অবস্থানের কারণে জহুরা তাজউদ্দীন শক্তি পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নামটি বেছে নিতে।

'৭৯ সালে আপনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে যখন আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন, তখন আমার সুযোগ হয়েছিল আপনার সঙ্গে ময়মনসিংহ, রাজশাহী যাওয়ার। আপনি ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন মরহুম নজরুল ইসলাম ও মরহুম কামরুজ্জামান সাহেবের বাড়িতে গিয়ে। আপনি পরে বিভিন্ন প্রসঙ্গে একথা প্রায়ই বলতেন, আওয়ামী লীগের জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করলেন অথচ আপনার আগে প্রায় চার বছর কোনো নেতাই তাদের পরিবারকে দেখতে যাননি সুতরাং আমার মৃত্যুর পর কি হবে জানা আছে। এর পর আপনার দৃঢ় অবস্থানের কারণে জননেত্রী শেখ হাসিনা আসেন দেশে, দলের হাল ধরেন। '৭৫-পরবর্তী দল বেশ কয়েকবার ভাঙলেও এবং দলের বড় নেতাদের মাঝে অনেকেই বিভিন্ন সময়ে দল ত্যাগ করলেও আপনি দলের পতাকা বয়ে বেড়িয়েছেন প্রায় এককভাবেই। শুধু অজপাড়াগাঁ নয়, একেবারে জনবিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে ১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করে মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদাভেদ, পরাধীনতা আর কৃষকের দৈন্যদশা দেখতে দেখতে আপনার বেড়ে ওঠা। সমগ্র ভাটি অঞ্চলের মানুষকে সংগঠিত করে একসময় হয়ে উঠলেন ভাটি বাংলার প্রাণপুরুষ। ১৯৪০ সালে বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি থেকে ১৯৪৬ সালে হলেন সমগ্র আসামের সভাপতি। রাজনীতিকে অভিজাত শ্রেণীর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে সাধারণ মানুষের কাতারে আপনিই প্রথম দাঁড় করালেন। তারপর ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনি ছিলেন সামনের কাতারে। ১৯৯১ ও '৯৬ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণে আপনার ভূমিকা ছিল সর্বজন গ্রহণযোগ্য। যখনই দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে তখনই আপনি সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এভাবেই দেশের মানুষের কাছে আপনার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আপনার সুনামগঞ্জের প্রায় প্রতিটি জনপদের মানুষই আপনার রাজনৈতিক জীবনের কোনো না কোনো সময় আপনাকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি আসন থেকেই কোনো না কোনো সময় আপনি জয়ী হয়েছেন। আর আপনার নিজ এলাকা সুনামগঞ্জ-৩ আসনের মানুষের তো কথাই নেই। আপনি যতটুকু না ভালোবেসেছেন তাদের, তার চেয়ে অনেক বেশিই তারা সম্মানিত করেছেন বার বার নির্বাচিত করে। আপনার গড়া দল যখন আমাকে ঠেলে দিল, তখন কোন মুখে আবার তাদের কাছে যাই। বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারণার মাত্র ২০ দিন আগে। যেখানে আমার না আছে দল, না আছে নেতা, না আছে সংগঠিত কর্মীবাহিনী, না আছে নির্বাচন পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা আর না আছে অর্থের জোগান। তারপরও কর্মীদের চাপে আপনার ভাটি বাংলার মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। অবাক-বিস্ময়ে দেখলাম আপনার ভাটি বাংলার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসার বিস্ফোরণ। যেখানেই যাই সেখানেই আবেগাপ্লুত মানুষের ঢল। যেদিন আপনার দুই নাতি আজমাইন আর রাইয়াইকে দেখলাম রাত ১১টার সময়ও হাজারো মানুষের মিছিলের নেতৃত্ব দিতে, সেদিন বুঝলাম, বাকিটুকু আল্লাহর ইচ্ছা। আপনার হাতে তৈরি কেন্দ্রীয় নেতারা ও আপনার সহকর্মীরাও বার বার আমাকে জানিয়েছেন, নেত্রী যেহেতু সরকার গঠনের জন্য যা প্রয়োজন তা পেয়েছেন, তাই কোথাও কোনো প্রকার প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ হবে না। বিশেষ করে আমার এলাকায় তো নয়ই। শুধু প্রচারাভিযানে মনোযোগ দিতে হবে। প্রচারাভিযানের শেষ দিকে হঠাৎ করেই দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করল। কারণ যে মানুষটি '৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছে, তার কাছ থেকে আর তার সমর্থনকারীদের কাছ থেকে মুক্তির নায়কদের জন্য কতটুকুই বা সম্মান আশা করা যায়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তার সমর্থকদের মুখে আপনার সম্পর্কে ও আপনার পরিবার সম্পর্কে উচ্চারিত খিস্তিখেউরগুলোর কথা বাদই দিলাম। বাবা আপনি তো জানেনই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পেছনের ইতিহাস। তার চাচা কিংবা ভাইয়েরা শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই করেনি, '৭১ সালে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। তিনি নিজেও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর নেতৃত্বে কাজ করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংসদীয় প্রতীক আর পতাকার পেছনে প্রশাসনিক ভিড়, তার আগে-পেছনে পুলিশের গাড়ি। নির্বাচন কমিশনকে জানানো সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া। নির্বাচনের দুই দিন আগে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক পরিবর্তন, নির্বাচনের আগের দিন রাতে প্রিসাইডিং অফিসার পরিবর্তনসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার মধ্য দিয়ে এলো নির্বাচনের দিন। এর মাঝে বিরোধী দলের হুমকির কারণে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম, জগন্নাথপুরে মাত্র ২৫%। তারপরও এই উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে প্রায় ১০ হাজার ভোট বেশি পাই আমি। আরেক উপজেলায় আমাদের হিসাবে ভোট পড়েছে ২০% এবং আমরা জিতেছি প্রায় দুই হাজার ভোটে কিন্তু নির্বাচনের ১২টি কেন্দ্র প্রতিপক্ষ দখল করে নেয়। আমাদের এজেন্টদের রক্তাক্ত করে বের করে দেয়। একটি কেন্দ্রে আমাকেও অপমান করা হয়। প্রশাসনকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বেলা ২টার দিকে আপনার তৈরি করা কেন্দ্রীয় নেতাদের জানানোর চেষ্টা করলাম, কেউ কথা কানেই তুললেন না। অবশেষে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দখলকৃত কেন্দ্রগুলোতে ৯০% থেকে ১০০% কাস্টিং করে সর্বমোট প্রায় ৪০% ভোট দেখিয়ে ফল ঘোষণা করে জানানো হলো, আমরা ৭ হাজার ভোটে হেরেছি। বুঝলাম, সামনের পথ অনেক বন্ধুর। তবে আশার কথা, যে পথ পাড়ি দিয়ে এসে এ জায়গায় পেঁৗছলাম সেটাও ফুলেল ছিল না। সেই কাঁটা বিছানো পথে যখন আপনার এলাকাবাসী সঙ্গী হয়েছে সুতরাং আগামী পথটা কোনো বিষয়ই নয়। আমরা সবাই প্রতীক্ষায় রইলাম সুন্দর একটি ভোরের সূর্যোদয়ের। আজ অনেক দিন পর আপনাকে চিঠি লিখলাম। সেই মেরিন একাডেমি আর জাহাজে থাকা অবস্থায় আপনাকে চিঠি লিখতাম বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। আজও লিখলাম সেই সিদ্ধান্তের আশাতেই। কারণ আজকাল শুধু আপনাকে অনুসরণের চেষ্টা আমি করি। চেষ্টা করি এ অবস্থায় আপনি কী করতেন সেটা খুঁজে বের করতে। কিন্তু একটা কথা আমার কাছে খুব পরিষ্কার নয়; আপনার পরিবারের প্রতি আপনার দলের হেন আচরণে দলেরই বা কী লাভ হলো আর সরকারেরই বা কী লাভ হলো!

আমার পিতার নবম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। আহা, এ চিঠিটা যদি সত্যিই বাবার কাছে পেঁৗছানো যেত। যদি বাবার কাছ থেকে একটা উত্তর চলে আসত। সবশেষে বাবার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।

লেখক : রাজনীতিক। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের পুত্র।

সর্বশেষ খবর