শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক সমালোচনায় জেল!

ডক্টর তুহিন মালিক

রাজনৈতিক সমালোচনায় জেল!

এক. রাজনৈতিক বক্তব্য কি অপরাধের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে? সরকার বা সরকারপ্রধানের সমালোচনা করা কি দণ্ডনীয় অপরাধ হতে পারে? এ দেশে রাজনৈতিক মামলার কথা বহুদিন ধরেই আমরা শুনে আসছি। বিএনপি আমলে যেমন গণহারে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেছে, তেমনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও এটা রেকর্ড ব্রেক করে দিয়েছে। এতদিন আমরা রাজনৈতিক মামলা দেখেছি। আর এ সরকারের আমলে আমরা রাজনৈতিক বিচারের সংস্কৃতি চালু হতে দেখছি। এখন প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অপরাধে শুধু ফেসবুক ব্যবহারকারী, ছাত্র, শিক্ষক, গীতিকার বা সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার-রিমান্ড-জেল দেওয়া হচ্ছে না। বরং এখন এটা সীমানা ছাড়িয়ে রাজনৈতিক সমালোচনা বা রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের অপরাধে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা শুরু হয়েছে। এ তালিকায় সম্প্রতি এম কে আনোয়ার থেকে শুরু করে তারেক রহমান পর্যন্ত, এমনকি বেগম খালেদা জিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ এক ভয়ানক রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি চালু করেছে এ সরকার। রাজনৈতিক বক্তব্য বা সমালোচনাকে আইনগতভাবে অপরাধের আওতাভুক্ত করে এবং আইন-আদালতকে যথেচ্ছাচার অপব্যবহার করে এ হীনরাজনৈতিক খেলা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। আজ এই ফাঁদে বিএনপি পড়ছে, আগামীকাল নিশ্চিতভাবে একই ফাঁদে আওয়ামী লীগও পড়বে। এ খেলা চলতে দিলে হয়তো একসময় আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

দুই. আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের রাজনৈতিক বিরোধগুলোকে তারা সুকৌশলে আদালতের ঘাড়ে তুলে দিয়েছে। এতে আপাতদৃষ্টিতে তারা সফলও হয়েছে। একে একে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম বাতিল ঘোষণা, সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, সামরিক সরকারগুলোর আমলে জারিকৃত সব প্রজ্ঞাপন-বিধি-বিধানকে অবৈধ ঘোষণা, জিয়াউর রহমানকে কর্নেল তাহেরের হত্যাকারী সাব্যস্ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকা অবৈধ ঘোষণাসহ অসংখ্য রাজনৈতিক প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকার গত প্রায় ছয় বছরে তাদের রাজনৈতিক অভিলাষগুলোকে আদালতের মাধ্যমে হাসিল করেছে। এ ছাড়াও জিয়া চ্যারিটেবল ও অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা থেকে শুরু করে সরকারের বিশেষ দূত এরশাদের বিরুদ্ধে করা মঞ্জুর হত্যা মামলা কিংবা রাডার ক্রয়সংক্রান্ত মামলা পর্যন্ত- এগুলোর সবকিছুতেই আইনি ন্যায়তার চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থই বেশি মুখ্য বলে জনমনে প্রবল বিশ্বাস জন্মেছে।

তিন. ৫ মে শাপলা চত্বরের গণহত্যা ও বায়তুল মোকাররমে পবিত্র কোরআন শরিফ পোড়ানোর ঘটনায় বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ারের একটি রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে সম্প্রতি তথ্যপ্রযুক্তি আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অবশ্য একই বিষয়ে তার বিরুদ্ধে এক যুবলীগ নেতার দায়ের করা মানহানির আরেকটি মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এম কে আনোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের এক নেতাকে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন আসে, মামলাটা তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কেন হবে? উনি তো কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে এ বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। এ রকম রাজনৈতিক বক্তব্য তো হরহামেশাই আমাদের সরকারি দলের নেতারা বিরোধীদের বিরুদ্ধে আরও খারাপভাবে দিয়ে যাচ্ছেন। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। আর অন্যদিকে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি আইন মানুষের বাক-স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধক হিসেবে আবিভর্ূত হয়েছে। এ আইন এখন বিশেষ ক্ষমতা আইনের চেয়েও বেশি ভয়াবহ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের নামে এ দেশে এখন 'স্বৈরপ্রযুক্তি' আইনে মানুষকে জেলে নেওয়া হচ্ছে।

চার. আইনের ছাত্র হিসেবে আমরা এতদিন ধরে জানতাম যে, রাজনৈতিক প্রশ্ন আদালতের বিচার্য বিষয় হতে পারে না। আইনবিদদের পুস্তক পড়ে যতদূর জেনেছি যে, রাস্তার আন্দোলনের বিষয় কিংবা বিরোধী দলের দাবি প্রতিহত করার বিষয় কিংবা সমাজ ও রাষ্ট্রে বিবদমান রাজনৈতিক বিবাদীয় বিষয়গুলো কখনো আদালতের বিচার্য বিষয় হতে পারে না। এগুলো আদালতে নয়, বরং রাস্তায় বা রাজনীতির মাঠেই সমাধান করতে হবে। যদিও আমাদের সুপ্রিমকোর্ট এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রশ্নের সংজ্ঞা নিয়ে কোনো মতামত দেয়নি। তবে প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন (৩৩ ডিএলআর, এডি, ৩০) রায়ে বলেন- 'রাজনৈতিক প্রশ্নের জবাব দিতে আদালতের বিরত থাকা উচিত, যদি তার বৈধতা বা আইনগ্রাহ্যতা সম্পর্কে অন্যভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হয়।' এ ধরনের রাজনৈতিক প্রশ্নে আদালত পরীক্ষা করে দেখবে- (১) বিষয়টি আইনগত না রাজনৈতিক (২) রাজনৈতিক ক্ষমতা সংবিধান ও আইনসম্মতভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা।

পাঁচ. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিবদমান বহুবিধ রাজনৈতিক প্রশ্ন বিদ্যমান থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। একের নীতি আদর্শ অন্যের চেয়ে ভিন্ন হলে এটা দোষের কিছু নয়। একে অন্যের সমালোচনা করেই নিজ দলের নীতি আদর্শকে জনগণের সামনে নিয়ে আসে। এসব সমালোচনাকে আবার খণ্ডন করা হয় সমালোচনা দিয়েই। তীব্র থেকে তীব্রতর হয় এসব রাজনৈতিক বক্তব্য। অনেক সময় এসব রাজনৈতিক বক্তব্য যুক্তিতর্কের মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি বলেই বিবেচনা করা হয়। এভাবে রাজনীতিতে শত ফুলকে ফুটতে দেওয়া হয়। কিন্তু তাই বলে সরকারের সমালোচনা বা রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানকে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত করে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা কোনো সভ্য সমাজে চিন্তা করা যায় না। আইন আদালতকে রাজনৈতিক দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা আইনের শাসনের প্রতি চরম হুমকিস্বরূপ। আর গণতন্ত্রও এক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে বাধ্য।

ছয়. বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে আদালত নিজে থেকেই খুব সতর্কভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিবদমান রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে চলে। আদালতকে সুষ্ঠুভাবে ন্যায়বিচার করতে হলে তাকে রাজনীতি ও দলীয় প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়। রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির প্রচেষ্টা যেন মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে দাঁড়ায় সেটা নিশ্চিত করতে হয় আদালতকেই। অন্যদিকে শাসক দল বিভিন্ন কৌশলে আদালতকে তাদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। ন্যায়পরায়ণ আদালত তাদের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের এ কঠিন জায়গায় কখনো আঘাত করতে দেওয়া না। রাজনীতির খোলা হাওয়া রোধে আদালতের দ্বার থাকে খুবই সংকুচিত। কারণ রাজনীতির স্রোতে ভেসে যেতে পারে ন্যায়বিচারের নিক্তিটি। অনেক সময় হয়তো এ স্রোত আদালতের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। সে কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রধান বিচারপতি Waite সেই কবে ১৮৭৬ সালে বলে গেছেন, 'সংসদের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধের জন্য জনগণকে অবশ্যই নির্বাচনে যেতে হবে, আদালতে নয়।' বিচারপতি Holmes ৬১ বছর বয়স্ক আরেক বিচারপতি Stone-কে বলেন, 'হে যুবক,... জনগণ যখন একটা কিছু করতে চায় তখন সাংবিধানিকভাবে তা নিষিদ্ধ রয়েছে বলে আমি মানতে রাজি নই। আমি পছন্দ করি অথবা না-ই করি- আল্লাহর দোহাই তাদেরকে এটা করতে দাও।' তাই আমাদেরও এটা মনে রাখতে হবে যে, জনগণের ইচ্ছাশক্তিকে আইন কিংবা আদালতের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা সবার জন্যই বিপদের কারণ বয়ে আনবে। কারণ এ সরকারই শেষ সরকার নয়।

লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

e-mail: [email protected]

সর্বশেষ খবর