বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

সংকট নিরসনে উদ্যোগী হতে হবে

শায়রুল কবির খান

দেশের রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। সচেতন জনসমাজের প্রাগ্রসর অংশটি বেশিরভাগ এ অচল অবস্থার বিষয়টিকে কখনো দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত বিবাদ বা দুই বা ততোধিক দলের মতাদর্শগত সংঘাত হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু সংকটের উৎস আরও গভীরে। গোটা দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে জনগণের কোনো অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে তা নিছক ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। ব্যাপক জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার যে অশুভ কর্মতৎপরতা, সেটা জনগণের নামে চালালেও তাতে জনগণের সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নেই। গণতন্ত্রের জন্য জনগণের লড়াইকে দাবিয়ে রেখে ক্ষমতাসীন দল শক্তি দেখাতে গিয়ে যে সংকটের জন্ম দিচ্ছে সে সংকট নিরসনের কোনো উপায় তাদের হাতে আর থাকছে না। ৫ জানুয়ারির একতরফা ভোটারবিহীন বিতর্কিত নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো রাজনৈতিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মহাসচিব পর্যায়ের প্রতিনিধি এবং অন্যান্য দলের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। জনগণ দৃশ্যত দেখেছে তারনকো ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত থোতা মুখ ভোতা করে ফেরত গেছেন। জনগণের ধারণা যেখানে সংকটের উৎস সেখানে যাওয়ার সদিচ্ছা, মানসিক প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা একেবারে নেই বলেই সংকট সমাধান করতে গিয়ে অধিকতর বড় সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সরু গলিতে বিপরীত দিক থেকে দুটি ট্রাক এসে মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো। ক্ষমতাসীনরা সংবিধান রক্ষার দোহাই দিয়ে বিগত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ডাক দিলেন। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিজ বাসভবনে আটক করে, বাড়ির দুই পাশে বালুভর্তি ট্রাক রেখে শত শত পুলিশ, র্যাব বাহিনীকে দিয়ে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ঘিরে রাখে। শীর্ষ নেতাদের নামে শতাধিক মামলা দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিন্দ্বিতায় ও বাকি আসনগুলো একতরফা ভোটারবিহীন বিতর্কিত নির্বাচন কর্মটি সমাপ্ত করতে হলো। নির্বাচন সাঙ্গ করে আওয়ামী লীগ সাড়ম্বরে ঘোষণা করল তারা সংবিধান রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। নিজেদের কণ্ঠস্বর নিজেদের কানে বিদ্রূপের মতো শোনল। যেখানে পাঁচ ভাগ মানুষ ভোট দিতে আসেনি সেখানে আওয়ামী লীগ এবং তাদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন বলছে ৪৫ ভাগের বেশি মানুষ ভোট দিয়ে তাদের বিজয়ী করেছে। দেশি-বিদেশি সব পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে অস্বীকৃতি জানাল। দেশে-বিদেশে সবার চোখে এ নির্বাচন চূড়ান্ত প্রহসন বলে চিহ্নিত হয়েছে। কোনো দেশ এখন পর্যন্ত এ সরকারকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বস্তুত এ সরকারের দেশ শাসন করার আর কোনো আইনগত নৈতিক অধিকার নেই। জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা চরম সীমায় ঠেকেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ থেমে গেছে। কর্মসংস্থান নিম্নমুখী। দেশ সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অচল হয়ে পড়ছে। স্থানীয় সরকারসহ অন্য সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই বললেই চলে। যেসব সৎ নাগরিক ক্ষমতা, যোগ্যতা এবং দক্ষতা দ্বারা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারতেন তারা একেবারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছেন।

দেশের প্রজ্ঞাবান এবং বিবেকবান মানুষ যারা আপাদকালে সমাজকে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন তাদের অসহায় দর্শকের ভূমিকা পালন করে যেতে হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট উত্তরণে জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল সে ব্যাপারে তারা কিছুই করছেন না। বরং সরকার দেশের জনগণকে অধিকতর সংকটের মুখে ছুড়ে দিচ্ছে। দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে সংকট সে সংকট সমাধানের প্রত্যাশা দূরাশায় পরিণত হতে চলছে। সাম্প্র্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে সরকারপ্রধান বলেছেন বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। তিনি দাম্ভিকতার সঙ্গে আরও বলেছেন, ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচনও নয়। সরকারের এ বক্তব্য রাজনৈতিক সংকট সমাধানে অন্তরায় সৃষ্টি করছে, নতুন নতুন সংকট জন্ম দিচ্ছে, যেগুলো আরও ভয়াবহ এবং মারাত্দক। বাংলাদেশের সংকট সংবিধান রক্ষা করার সংকট যেমন নয় তেমনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার সংকট নয়। মূল সংকট হচ্ছে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দাবিতে বিরোধী দলের আন্দোলনকে সরকার দমন করার যে নিষ্ঠুর খেলায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে তাতে দেশ চূড়ান্ত অরাজকতার দিকেই ধাবিত হবে। দেশের সংকট উত্তরণের জন্য সব জনগোষ্ঠী যদি জাগ্রত হয়ে তার মৌলিক অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়ে উঠতে পারে তখনই এ সরকারের সৃষ্ট নৈরাজ্য প্রতিহত করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী এবং প্রাতিষ্ঠানিক দীর্ঘজীবিতা দিতে হলে এখনই দল মত নির্বিশেষে অধিকতর কর্মতৎপরতা, অধিকতর অঙ্গীকারসম্পন্ন, অধিকতর সুসংগঠিত, অধিকতর সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। তা না করে জনগণের দাবিকে পাশ কাটিয়ে যে কোনো রকমের জোড়াতালি, যে কোনো ধরনের সরকার হোক না কেন, সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্য কোনো সরকার সবকিছুই হতাশার স্বরূপ।

সর্বশেষ খবর