সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

মির্জা সাহেবদের গাত্রদাহ কেন?

সুনীল শুভরায়

মির্জা সাহেবদের গাত্রদাহ কেন?

ঐতিহাসিক সত্য কথা বলার মধ্যে ইমান-বেইমানের কি সম্পর্ক থাকতে পারে তা বোধগম্য হলো না বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেবের কথায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীকারী শাহ আজিজকে জেনারেল জিয়াউর রহমান তার সরকারের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন- এই ঐতিহাসিক সত্যকে সহস্রবার বলাৎকার করেও কি এর সতীত্বহানি ঘটানো যাবে? গত ১২ নভেম্বর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের সমাবেশে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছিলেন, 'জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন এটা সত্য, কিন্তু পরে তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন- স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে তিনি প্রধানমন্ত্রী করেছেন।' এই সত্যটা শুনে মির্জা সাহেবের এতই অাঁতে ঘা লাগল যে, তিনি তার পিতার নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বেইমান অভিহিত করে ব্যঙ্গাত্দক ভাষায় বললেন, দেশে একজন নতুন মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব ঘটেছে! মির্জা সাহেবের কাছে জিজ্ঞাসা, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কি কস্মিনকালেও বলেছেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি? কিন্তু এ কথা সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে এরশাদ যা করেছেন- আর কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান করেননি। তিনি অন্তত ৩৮টি কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে। অতি সংক্ষিপ্তভাবেও যদি বর্ণনা করা হয়, তার মধ্যে এসে যাবে একটি কথা, 'মুক্তিযোদ্ধারা এ দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান।' একজন রাষ্ট্রপতির মুখে এত বড় স্বীকৃতির চেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর কি বড় পাওয়া থাকতে পারে! মির্জা সাহেবরা বলুন, এরশাদ সাহেবের এই উক্তির সঙ্গে আপনারা একমত নন।

সজীব ওয়াজেদ জয় বিএনপিকে রাজাকারের দল বলেছেন। অকাট্য সত্য কথা। এতে আরও বেশি অাঁতে ঘা লেগেছে। বিএনপি রাজাকারের দল না হলেও পৃষ্ঠপোষকতাকারী দল তো বটে। ইমানদার মির্জা সাহেব, আয়নায় নিজেদের মুখটা একটু দেখেন, কীভাবে রাজকারদের নিয়ে আপনারা রাজনীতি করেছেন। আপনাদের প্রয়াত নেতা জিয়াউর রহমান শুধু স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বা রাজাকার আবদুল আলীমকে মন্ত্রী বানিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, নিষিদ্ধ জামায়াতকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছেন। জিয়াউর রহমান যখন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তখন জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অবতীর্ণ হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য তো জন্মলগ্ন থেকে চলে আসছে। জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও শুধু জামায়াতই নয়, বহুদলীয় গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী সব দলকেই রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন এবং তাদের সংসদে নিয়ে আসারও ব্যবস্থা করেছেন। তারপর ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করা, স্বাধীনতাবিরোধী আবদুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি বানানো কিংবা হুমায়ুন খান পনি্নকে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে অভিষিক্ত করা, নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া- এসব কি বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহিঃপ্রকাশ, নাকি তার বিপরীত? আর জামায়াত তো প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছে, তাদের ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না। সুতরাং, এটা তো অঙ্গে অঙ্গে অঙ্গাঙ্গি থাকার কথা। জামায়াত-বিএনপির এত বড় প্রেম দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য নয়, এ প্রেম পরিণয়ে পরিণত করার মতো প্রেম। জামায়াত মানে বিএনপিরই অঙ্গ বা তার উল্টোটা। এখন দেখার বিষয়, কুত্তায় লেজ নাড়ে, নাকি লেজে কুত্তা নাড়ে। এত কিছুর পরও মির্জা সাহেবরা যদি বলেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের শুধু নির্বাচনী ঐক্য রয়েছে, আর কিছু নেই- তা কী বিশ্বাসযোগ্য? এসব বলে কি শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে? যাদের সঙ্গে এত প্রেম- তাদের নিয়ে এত রেখে-ঢেকে চলা কেন? রক্ষিতা যতই প্রিয় হোক, তাকে একটু আড়ালেই রাখতে হয়, ঘটনাটা তেমন নয়তো?

মির্জা সাহেবরা এখন মাঠে-ময়দানে সরব না থাকলেও টিভি ক্যামেরার সামনে খুব গরম। এ দেশে বাকস্বাধীনতা যদি কেউ ভোগ করে থাকেন, তাহলে তিনি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং তার দলের লোকেরা। তিনি প্রতিনিয়ত যেসব অভিযোগ করে থাকেন, বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধে- তার সত্য-মিথ্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। আমি শুধু আয়নায় তাদের নিজেদের মুখটা দেখতে বলব। দেশবরেণ্য কবি শামসুর রাহমানও বিএনপির মুখ নিয়ে একটি কবিতা লিখে গেছেন। তার কয়েকটা পঙ্ক্তি এখানে উল্লেখ করতে চাই। তার কবিতার শিরোনামটি হচ্ছে- 'তোমাদের মুখ'। তাতে কবি লিখেছেন- 'তোমরা কি এখনো দেখতে পাচ্ছ না/তোমাদের মুখ? পাঁচ বছরে কী কদাকার আর বীভৎস/হয়ে উঠেছে তোমাদের মুখ/তা কি চোখে পড়ছে না এখনও?/এত অন্ধ তোমরা যে/নিজেদের কদর্যতা, হিংস্রতা, স্বেচ্ছাচারিতা,/নগ্ন বর্বরতা- সব কিছুই এখনও/পরম মোহনীয় ঠেকছে।/মানুষের ভোটাধিকার তোমরা/কেড়ে নিয়েছ। তামাশা বানিয়েছ/গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে/তোমাদের নির্লজ্জ জালিয়াতি/সংসদকে রূপান্তরিত করেছ সার্কাসের তাঁবুতে...।' বিএনপি আমলের শাসন চিত্রের বর্ণনার জন্য কবি শামসুর রাহমানের 'তোমাদের মুখ'- পূর্ণ কবিতাটিই যথেষ্ট। ১৯৯২ সালের কথা। তখন আমি একটি দৈনিকের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। দেশে তখন মিডিয়ার সংখ্যাও সামান্য। বেসরকারি টিভি চ্যানেল চালু হয়নি। '৯০-পরবর্তী বিএনপির প্রথম আমলটা অর্থাৎ ১৯৯১ থেকে '৯৫ পর্যন্ত সময়ে সবচেয়ে বিপজ্জনক বিটের আমি রিপোর্টার ছিলাম। অর্থাৎ জাতীয় পার্টির বিট। বিএনপির এ পাঁচ বছরে জাতীয় পার্টির ১৪২টি বড় জনসভা ও মহাসমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি করে বানচাল করা হয়েছিল। প্রত্যেকটি সমাবেশে হামলা চালিয়েছে পুলিশ আর বিএনপির ক্যাডার বাহিনী। তার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রিপোর্টিংয়ের কাজ করতে হয়েছে। অন্তত দুবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পড়েছিলাম। দেখেছি বিএনপির বর্বরতা কাকে বলে। ১৯৯২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারির কথাই বলতে চাই। জাতীয় পার্টি সমাবেশের জন্য ভেন্যু চেয়েছিল বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট। কিন্তু অনুমতি দেওয়া হলো সায়েদাবাদে। সেদিন সায়েদাবাদে জনতার যে ঢল নেমেছিল, যদি সমাবেশ চলতে দেওয়া হতো তাহলে ওই সমাবেশটি একটি ইতিহাস হয়ে থাকত। কিন্তু সায়েদাবাদ এলাকা মানুষে মানুষে পূর্ণ হতে না হতেই বিনা উসকানিতে আকস্মিকভাবে পুলিশ আর বিএনপির শত শত ক্যাডার বাহিনী একযোগে হামলা চালায়। সে হামলা বর্ণনার কোনো ভাষা নেই। নাৎসি বর্বরতা আমরা ইতিহাসে পড়েছি আর বিএনপির বর্বরতা সেদিন চোখে দেখেছি। পুলিশ হাজার হাজার টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে সভাস্থল ফাঁকা করে দিয়েছে আর অলিগলিতে ওঁৎপেতে থাকা বিএনপি ক্যাডাররা দা-লাঠি-ছোরা-তরবারি নিয়ে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। সেদিন কত লাশ লুকিয়ে ফেলা হয়েছে- তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। রাজধানীর হাসপাতালগুলো আহত জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীতে পূর্ণ হয়ে গেছে। ওই দিন আমি প্রাণে বেঁচেছিলাম অল্পের জন্য। টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যে পালাতে গিয়ে একটা নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টের খাদে পড়ে গেলাম। খাদটি ছিল প্রায় ৩০ ফুট গভীর। পড়ে গিয়ে বুঝলাম- আমার আগে সেখানে আরও শতাধিক মানুষ পড়ে আছে। ওই খাদে জমে থাকা পচা পানি চোখে দিয়ে চোখের জ্বালা কমানোর চেষ্টা করেছি। তার মধ্যে কিছুক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। জ্ঞান যখন ফিরেছে তখন উপরে উঠে তাকিয়ে দেখলাম বিএনপির গণতান্ত্রিক শাসনের কদাকার আর বীভৎস চিত্র। বিএনপির সরকার গঠন থেকে পতন পর্যন্ত দেখেছি তাদের এই রূপ। সেই বিএনপি এখন গণতান্ত্রিক আচরণের তালিম দিচ্ছে। স্বৈরাচার চিনাচ্ছে, অন্যায় অবিচারের কথা বলছে, বৈধতা-অবৈধতা দেখাচ্ছে- নীতিবাক্যও শুনাচ্ছে। গণতান্ত্রিক আচরণ কেমন দেখিয়েছিলেন, তা দেখার জন্য বেশি দূর যেতে বলছি না। ওনাদের দলে ভিড়েছেন মওদুদ আহমদ। তার কালো কোর্তাটা খুলে পিঠের দিকে তাকিয়ে দেখুন, বিএনপির গণতন্ত্রের সিল লাগানো আছে। মনিরুল হক চৌধুরীর নাকটা নেড়েচেড়ে দেখুন, সেখানে গণতান্ত্রিক হাড় গজিয়েছে কিনা। ১৯৯৩ সালের ১৩ জুন তারিখে শাপলা চত্বরের জনসভা ভেঙে দেওয়ার সময় মঞ্চ থেকে পড়ে গিয়ে শাহ মোয়াজ্জেমের গায়ে কোথায় বিএনপির গণতান্ত্রিক পেরেক ঢুকেছে- একটু পরখ করে দেখুন। আর এখন জনসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, এই সরকার সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না- এরা নব্য হিটলার, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সরকার নব্য হিটলার কিনা সে আলোচনায় যেতে চাই না। তবে এ সরকার নব্য হিটলার হলে, বিএনপি ছিল বনেদি হিটলার। তারপরও আরও কিছু কথা আছে। আসল হিটলার যা করেছে, সেটা ছিল তার নিজস্ব শক্তি, বল ও বুদ্ধিপ্রসূত। অন্তত জামায়াতের মতো আর কোনো অপশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত হয়ে হিটলারি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়নি- যা বিএনপি করেছে।

পরিশেষে- কবি শামসুর রাহমানের 'তোমাদের মুখ' কবিতার আর একটি অংশ উল্লেখ করতে চাই- সেখানে বিএনপি যা করেছে, তার আরও কিছু চিত্র পাওয়া যাবে। তিনি লিখেছেন- 'তোমরা লাল শাপলার ফুল, দোয়েল/কোকিল আর কৃষ্ণচূড়াকে পদদলিত করেছ/কবুতরদের টুকরো টুকরো করে/ফেলে দিয়েছ আবর্জনার স্তূপে,/কবির হৃদয়কে করেছ রক্তাক্ত, তোমাদের/তাণ্ডবে শান্তি গা ঢাকা দিয়েছে/ভূতলবাসী রাজনীতিকের মতো,/সুন্দর গ্যাছে নির্বাসনে।'

লেখক : রাজনীতিক

 [email protected]

সর্বশেষ খবর