শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
স্মরণ

প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক : প্রথম দর্শন

মো. আবদুল মান্নান

প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক : প্রথম দর্শন

সাদা ফতুয়া-লুঙ্গি পরিহিত ভিয়েতনামের হোচি মিন-এর মতো চেহারার এক বৃদ্ধকে দেখে আমরা মোটেও ভাবিনি তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। ক্লাসভর্তি সতীর্থ সবার দৃষ্টি পড়ে তখনই যখন প্রফেসর শামসুল হুদা হারুন বৃদ্ধকে সজোরে স্যার সম্বোধন করেন এবং কদমবুছি করতে থাকেন। বৃদ্ধ শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলেন, 'হারুন আপনে কী পড়াইতেছেন?' উত্তরে প্রফেসর হারুন বললেন, স্যার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি পড়াচ্ছি। 'ভালা বিষয়ই লইছেন, তবে ইনারা কী এশিয়ার ম্যাপ চিনেন, জিজ্ঞাসা কইরেন।' বৃদ্ধ আর কিছু না বলেই শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করলেন। প্রস্থানের পর হারুন স্যারের কাছে আমরা কৌতূহলভরে জানতে চাই বৃদ্ধ লোকটির পরিচয়। ১৯৮২ সালের শেষ দিকের ঘটনা। কলা ভবনের নিচতলার গ্যালারি কক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষ (সম্মান) শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে হারুন স্যার বললেন, তিনিই আমাদের জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। আমাদের বিভাগের প্রায় সব ছাত্র-শিক্ষকের শিক্ষক তিনি। পরবর্তী জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন সভা-সমিতি, সেমিনার- সিম্পোজিয়ামসহ বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রফেসর রাজ্জাক সম্পর্কে চমকপ্রদ অনেক গল্প ও জনশ্রুতির কথা শুনেছি। অকৃতদার এ মানুষটি মেধা-মননে, নীতি-আদর্শে, জ্ঞানে-গরিমায় ছিলেন আপনভুবনে ভাস্বর। স্রোতের বিপরীতেও একা দাঁড়িয়ে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার ছিল তার ব্যতিক্রমী চরিত্রে। তার নিজস্ব ভাষা, বাচনভঙ্গি, একগোছা দাড়ি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য তাকে অপর দশজন শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী থেকে অদ্যাবধি আলাদা করে রেখেছে। তার মুখের শ্মশ্রুর গোছাটি সম্পর্কে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় মাস তাকে কেরানীগঞ্জের নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল এবং ওই সময় গজিয়ে ওঠা দাড়ি তিনি আর কখনো বর্জন করেননি। চলি্লশের দশকেই প্রফেসর রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি করার উদ্দেশে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে তার গাইড ছিলেন ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিক হ্যারল্ড জে, লাস্কি (১৮৯৩-১৯৫০)। প্রফেসর রাজ্জাক সেখানে সুদীর্ঘ সময় পড়াশোনা করে তার গবেষণা কর্মের থিসিস ‘Political Party’ দাখিল করেন। অল্প কিছু দিন পর তার শিক্ষক ও Harold J Laski আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। প্রফেসর রাজ্জাক এতে গভীরভাবে হতাশ ও বেদনাহত হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে তার জমাকৃত 'থিসিস পেপার' ফেরত নিয়ে আসবেন এবং তিনি তা-ই করলেন। পিএইচডি ডিগ্রি না নিয়েই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। প্রফেসর রাজ্জাক সম্পর্কে অনেকেই গল্প করেন Prof. Laski-এর অবর্তমানে তার থিসিস যথার্থভাবে অনুধাবন করার মতো কোনো শিক্ষক লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না বলেই নাকি তিনি দেশে ফিরে আসেন। প্রফেসর রাজ্জাক ১৯৩১ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দশ বছর পর থেকেই ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে জাতীয় অধ্যাপকের বিরল সম্মানে অভিষিক্ত করেন। এটি তার জীবনকালের শ্রেষ্ঠ সম্মান বলে মনে হয় এবং সে পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই ছিলেন।

প্রফেসর রাজ্জাক খুব 'মুডি' স্বভাবের মানুষ ছিলেন। ঢাকাইয়া বুলিতে অসংখ্য তথ্যভিত্তিক মনমুঙ্কর আলাপচারিতায় যে কাউকে তিনি সহজেই আকৃষ্ট করতে পারতেন। অসাধারণ প্রজ্ঞা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই জ্ঞানতাপস কোনো বই লেখেননি, লিখতে তার ভীষণ অনিচ্ছা ও অনীহা ছিল এটা প্রায় সবাই জানেন। উল্লেখ্য, তার একটি মাত্র লেখা পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয় (Bangladesh : state of the nation) বা 'বাংলাদেশ : জাতির অবস্থা' শিরোনামে, যা প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত তার মূল্যবান বক্তৃতাগুলোও পুস্তকরূপে প্রকাশ পেলে জাতি উপকৃত হতো। তবে তার মানবিক মূল্যবোধ ও হৃদয়বান ব্যক্তিত্বের আলোয় অনেকেই উদ্ভাসিত হয়েছেন। তাকে কাছে থেকে যারা দেখেছেন, শিখেছেন এবং ক্রমাগত বিমোহিত হয়েছেন তাদের মধ্যে প্রয়াত অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, সাহিত্যিক আহমদ ছফা, শিল্পী মুহাম্মদ সুলতান ও শিক্ষাবিদ ড. সলিমউল্লাহ খানসহ আরও অনেকে। তার মানবিক গুণাবলীর দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রখ্যাত লেখক আহমদ ছফার বক্তব্য থেকে অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো- "আমি একটা প্রেস করেছিলাম। সেই প্রেস থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতাম। বত্রিশ নম্বর তোফখানা রোডে ছিল অফিস। তখন আমি মীরপুরে থাকতাম। একদিন স্যারকে বাড়িতে যেয়ে অনুরোধ করেছিলাম, তিনি যেন আমার প্রেসে এসে একবার পায়ের ধুলো দিয়ে যায়। পরের দিন অফিসে এসেই আমার প্রেসের ম্যানেজারের মুখে শুনলাম, একজন লুঙ্গি, চাদর এবং পাঞ্জাবি-পরা বুড়োমতো মানুষ বেলা ন'টার সময় এসে অনেকক্ষণ আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করেছেন। স্যার যে পরদিনই প্রেসে চলে আসবেন ভাবতে পারিনি। আমি ম্যানেজারকে জিগ্গেস করলাম, আপনি অফিস খুলে বসতে দেননি কেন? ম্যানেজার আমাকে জানালেন, আমি মনে করেছি প্রেসের মেশিনম্যান কিংবা কম্পোজিটরের চাকুরি চাইতে লোকটা এসেছিল। আমাদের কোনো মানুষের প্রয়োজন নেই। তাই বলে দিয়েছি আমাদের এখানে কোনো মানুষের দরকার নেই। শুনেই লোকটা চলে গেল। আমি ভীষণ শরমিন্দা হয়ে পড়লাম। দুপুরবেলাতেই স্যারের বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে সকালে তখন খেতে বসছেন। স্যার আমাকে দেখেই বললেন, এ্যাতো দেরি কইর্যা আইলে আপনের ব্যবসা চলব কেমন কইর্যা। আমি আমার কর্মচারীর খারাপ ব্যবহারের জন্য মাফ চাইতে যাচ্ছিলাম। স্যার আমাকে মুখই খুলতে দিলেন না। বললেন, হাত ধুইয়া বইয়া পড়েন, অনেকদিন আপনে আমাগো লগে খাইতে আহেন না" [সূত্র : যদ্যপি আমার গুরু]

জানা যায়, এ বছর ২০১৪ খ্রি. প্রফেসর রাজ্জাকের জন্মশত বার্ষিকী। ২৮ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে তিনি প্রয়াত হন। জন্মশত বার্ষিকী এবং প্রয়াণ দিবসে এই মহাত্দার প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।

লেখক : ডুপডা'র নির্বাহী কমিটির সদস্য।

 

 

 

সর্বশেষ খবর