শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
স্মরণ

একজন আবদুর রউফ

ডা. মোস্তফা মঈন

একজন আবদুর রউফ

দেখতে দেখতে তিনটি বছর চলে গেল। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন ষাটের দশকের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ। ঐতিহাসিক ১১ দফার অন্যতম প্রণেতা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা। যিনি নিজ হাতেই সেদিনের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের দাবির খসড়াটি চূড়ান্ত করেছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য। ১৯৭১-এ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। ১৯৭২-এ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর পার্লামেন্টে ডেপুটি চিফ হুইপ। নীলফামারীর ডোমারের কৃতী সন্তান আবদুর রউফ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহছায়ায় রাজনীতিতে উঠে এসেছিলেন।

আমার পিতা আবদুর রউফ। পেশায় আমি একজন চিকিৎসক। জন্ম-মৃত্যু দেখা আমার কাছে নতুন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। কিন্তু জীবনের শেষপ্রান্তে আইসিইউ'র বেডে নাকে-মুখে নানা রকম নল নিয়ে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার অব্যক্ত যন্ত্রণার অনুভূতি প্রকাশের জন্য এই লেখা।

এরশাদের আমলে আমাদের শৈশব এবং কিছুটা কৈশোর কেটেছে। তখন একমাত্র টিভি ছিল বিটিভি। ২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বরে একঘেয়ে সুরে বলে যাওয়া 'হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে...' পাকিস্তান শব্দটিও সে সময় উচ্চারিত হতো না। সন্ধ্যা বেলায় যখন মোবারক স্যারের কাছে পড়ছি তখন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী চাচার ফ্ল্যাগ তোলা গাড়ি নিয়ে আগমন। রউফ, মিজান ভাই তোমাকে ডাকছেন যে পদ চাও, দেবেন।

আম্মা তখন একমাত্র ইঁদুরে কাটা সোফাটির ভাঙা পায়ে দশ ইঞ্চির ইট ঠেক দিয়ে উপরে কাপড় দিয়ে ঢাকতে ব্যস্ত। আমার ছেঁড়া স্কুলব্যাগে এক টাকার সুঁই দিয়ে অনভ্যস্ত-প্রাণপণ জোড়াতালি, বই যেন না হারায়। আব্বার উত্তর, না, ইউসুফ ভাই, বঙ্গবন্ধুর কাছে রাজনীতি শিখেছি। নিজেকে পরিচয় দিয়েছি As a political son of Bangabandhu, আদর্শের সঙ্গে আপস নয়।

৮৬'র আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তার প্রাণান্ত ছোটাছুটি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। একটা সম্মানজনক প্রেসিডিয়াম সদস্য পদের জন্য। কিন্তু বিধিবাম। ৮৬'র সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতিতে আমরা হেরে গেলাম। '৭১-এ পুড়ে যাওয়া গ্রামের বাড়িটিতে নির্বাচনের পর দিন ২৭ মার্চ সকালে তসর আলো ঠিকরে পড়ছিল ছেঁড়া কাঁথায়। বলতেন, আদর্শকে ধরে রাখতে গেলে ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।

আমার জন্মেরও আগে, '৭৫-এর পর সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারিতে জানজেরবার। আমার আম্মা সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য আশা রউফ ঈদের দিনে বেড়াওয়ালা বাসার সামনে সাদা পোশাকের পুলিশকে গিয়ে অনুরোধ করছেন, যান তো ভাই, আজকে ঈদের দিন, ঈদ করতে দেন। চাকরি-বাকরি নেই, ব্যবসা নেই, সব সময় পেছনে গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি, স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে অসহায় একজন ৩৪ বছর বয়সী সাবেক এমএনএ আবদুর রউফ। বলতেন, বেটা, ওই সময়ে বালুর কন্ট্রাকটারি পর্যন্ত করেছি। রেশনের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি চাল-তেল-চিনির জন্য। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে আট আনায় আসতাম মালিবাগ পর্যন্ত। তারপর কিছুটা হেঁটে পকেটের তিন টাকায় যখন নয়াটোলা পর্যন্ত রিকশাওয়ালা মানতো তখন উঠতাম।

আশির দশকে চিরচেনা হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনার ট্রিপিক্যাল ছবি ছিল আমাদের জীবন। ২০০৭ সালে প্রিয় সহধর্মিণীর অকাল প্রয়াণে বিমর্ষ হয়ে গেলেন বাবা।

যেন সাথী-হারা, পথ-হারা একজন নাবিক। মাঝে মাঝে নিজ মনে শেকস্পিয়রের ম্যাকবেথ আবৃত্তি করতেন, Out, out, brief candle! Life’s but a walking shadow, a poor player That struts and frets his hour upon the stage And then is heard no more! It is a tale told by an idiot, full of sound and fury, Signifying nothing.

যাওয়ার সময় হয়তো খুঁজে ছিলেন কাউকে। শেষ কোনো কথা বা ক্ষমা প্রার্থনার জন্য। যখন দেখলেন সে আশায় গুড়েবালি, তখন আকাশের উদারতায় চোখ বুজলেন। মুখচ্ছবিতে এক আশ্চর্য নির্লিপ্ততা।

রাষ্ট্র কর্তৃক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য শেষ সম্মানটুকু তাকে দেওয়া হয়েছিল। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আল্লাহতায়ালা তার রুহের মাগফিরাত দান করুন।

লেখক : চিকিৎসক।

 

 

 

সর্বশেষ খবর