মঙ্গলবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

একটি নীলনকশার অপমৃত্যু...

সৈয়দ বোরহান কবীর

একটি নীলনকশার অপমৃত্যু...

১০ জানুয়ারির মধ্যে সরকারকে 'ফেলে' দেওয়ার নীলনকশাটি ভেস্তে গেল। তিন মাস ধরে নকশিকাঁথার মতো করে নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। লন্ডন থেকে এসেছিল এর ডিজাইন। কিন্তু নীলনকশার কথা ফাঁস করে দিলেন বিএনপিরই শীর্ষ নেতারা। সরকারের পতন হলো না বরং ব্যর্থতার বর্ষপূর্তি করতে হলো বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দল বিএনপিকে। লাগাতার অবরোধ কিংবা হরতাল করার মতো শক্তি এবং সাংগঠনিক বিন্যাস যে বিএনপির নেই তা বিএনপির নেতারাও ভালো করে জানেন। তারচেয়েও বড় কথা হলো, দেশের মানুষ এখন কারও আহ্বানে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘরে বসে থাকবে- সে অবস্থা নেই। যা হওয়ার তাই হলো, আবার একটি ব্যর্থতার আর্তনাদ। এর ফলে বিএনপিকেই প্রকারান্তে বেগম জিয়া অস্তিত্বের সংকটে ফেললেন।

২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল বিএনপি। নির্বাচন প্রতিরোধের জন্য ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩, 'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি' কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু খালেদা জিয়াকে তার বাসভবনে আটকে রাখে সরকার। বালুর ট্রাকে ভেস্তে যায় খালেদার আন্দোলন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিরোধে 'এরশাদ'কেও ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এরশাদকে চিকিৎসা বন্দী করা হয়। নির্বাচন যাই হোক, ৫ জানুয়ারির পর দেশের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হতে থাকে। জনগণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে মন্দের ভালো হিসেবে মেনে নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও দ্রুতই আসতে থাকে স্বীকৃতি। ফেব্রুয়ারি মাসেই বাংলাদেশ তার দুঃস্বপ্নের স্মৃতি মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম একটি ভঙ্গুর নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি সরকার এযাবৎকালের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক সম্মান নিয়ে আসে। বিএনপিও ব্যর্থতা এবং সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করে দল গুছিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচনের মাধ্যমে দুই যুগ পর বিএনপি সংসদে তাদের অবস্থান হারায়। '৯১ সাল থেকে বিএনপি হয় সরকারি দলে অথবা বিরোধী দলে ছিল। রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করেছিলেন, বিএনপি আরও সময় নেবে এবং সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতার ইস্যুকে নিয়ে ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে তুলবে। গত এক বছরে বিএনপি এরকম অনেক সুযোগ পেয়েছিল- নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস- এসব ইস্যুতে বিএনপি কার্যকর জনমুখী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। চেষ্টাও করেনি।

এ সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল খুব স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, খালেদা ও তারেক জিয়ার অনিষ্পন্ন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে একটি অনুকূল অবস্থা তৈরি করতেই বেশি মনোযোগী ছিল। বিপরীতে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র রুচিহীন, অবাঞ্ছিত কিছু মন্তব্য করে বিতর্কের সূচনা করেন। তার এসব মন্তব্য কেবল কুরুচিপূর্ণ নয় বরং বাঙালির চেতনার ভিত্তিমূলে আঘাত। বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাসী কোনো মানুষ তারেক রহমানের এই নোংরা কথা গ্রহণ করতে পারেননি। এমনকি বিএনপির নেতৃবৃন্দও এসব বক্তব্যে বিব্রত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক আলোচনায় আসেন ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে। অনেকে মনে করেন ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপির সাফল্যের মূলে ছিল তারেক রহমানের কৌশল। নির্বাচনের পরপরই তারেক বিএনপির রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হন। কিন্তু দ্রুতই হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, কমিশনবাণিজ্য ইত্যাদি কারণে তারেক নায়ক থেকে খলনায়ক হিসেবে জনগণের সামনে আবির্ভূত হন। দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে তারেক অসৎ, দুর্নীতিবাজ এক তরুণ। বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন, লন্ডনে অবস্থান করে তারেক রহমান নিজেকে পরিবর্তন করবেন। একজন পরিণত, প্রাজ্ঞবান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে উত্থানের সুযোগ নেবেন। কিন্তু তারেক লন্ডনে এমন সব মন্তব্য করলেন যাতে জাতির সামনে 'বখে যাওয়া' এক তরুণ হিসেবেই তিনি পুনঃস্থাপিত হলেন। সরকার পতনের 'নীলনকশা'র সূত্রপাত এখানেই। তারেক রহমান যখন দেখলেন আওয়ামী লীগ দ্রুতই তার এবং তার মা খালেদা জিয়ার বিচার সম্পন্ন করার দিকে এগুচ্ছে তখনই সরকার পতনের ছক কষলেন। অথচ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য জনগণের শক্তিকে সংগঠিত করার বিষয়টি উপেক্ষা করলেন।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো সরকার চিরস্থায়ী নয়। একটি সরকার ক্ষমতায় আসে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে। নির্দিষ্ট সময় পর আবার তাদের জনগণের কাছে যেতে হয়, জনগণ যদি তাদের ম্যান্ডেট না দেয় তাহলে তাদের ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হয়। উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এখন 'রিকল' পদ্ধতি চালু হয়েছে। এর ফলে একটি সরকার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেও বিদায় নিতে পারে। যদি একটি নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠী মনে করেন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ওয়াদা বরখেলাপ করছেন অথবা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না, তাহলে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নির্দিষ্টসংখ্যক ভোটার পুনঃনির্বাচনের আবেদন করলে ওই নির্বাচনী এলাকায় পুনঃনির্বাচন হয়। নরওয়েতে ২০১০ সালে এভাবে একটি নির্বাচিত সরকারের পতন হয়েছিল। সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমেও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একটি সরকারের পতন ঘটানো যায়। নব্য এবং ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণআন্দোলনের মাধ্যমেও নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দেওয়ার বহু নজির আছে। কিন্তু সেই গণআন্দোলনের অবয়ব হতে হবে স্বচ্ছ, স্পষ্ট। একটি সরকারের অন্যায্য এবং অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে সেই সরকারের পতন ঘটানোর নজির বিশ্বে কম নয়। জাপানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটেছে অন্তত তিনবার।

যেসব দেশ গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছে, সেসব দেশে সরকার পতনের প্রধান কৌশল গণআন্দোলন। কিন্তু দেখা যায়, গণআন্দোলনের লেবাসে যেখানে সরকার পরিবর্তন হয় এক ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে। ব্যর্থরাষ্ট্র পাকিস্তানে সব সময় সরকার পরিবর্তনের পেছনে সেনাবাহিনী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ ও ইন্ধন ছিল। আরব বসন্তের নামে মিসর ও লিবিয়ায় সরকার পরিবর্তন হয়েছে সরাসরি বিদেশি শক্তির ইন্ধনে। এ রকম উদ্যোগ ভেনেজুয়েলা এবং কিউবাতেও মার্কিনিরা বহুবার নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। '৯০-এ এরশাদের পতন হয়েছিল আপাতদৃষ্টিতে গণঅভ্যুত্থানে; কিন্তু গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর সমর্থন হারানোর পরপরই এরশাদকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়।

তাহলে প্রশ্ন আসে বিএনপি দেশে শাসন ব্যবস্থার স্তর নির্ধারণ করেই কি নীলনকশা প্রণয়ন করেছিল? বিএনপি কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চায়? একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে নাকি একটি অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে?

বিএনপি যদি বর্তমান সরকারকে একটি অবৈধ সরকার মনে করে তাহলে ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর পর থেকেই বিএনপিকে অসহযোগ আন্দোলন করতে হতো। যেমন থাইল্যান্ডে ইংলাকের বিরুদ্ধে নির্বাচনের পর থেকেই লাগাতার আন্দোলন করা হয়েছিল। যেমন মার্কোসের বিরুদ্ধে নির্বাচনের কারচুপির অভিযোগে 'অবিরাম' সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল কোরাজান একুইনোর নেতৃত্বে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে ১০১টা সমালোচনা আছে, ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, কাঙ্ক্ষিত হারে ভোট পড়েনি, কিন্তু এই নির্বাচনে জনগণের একটি 'নীরব সম্মতি' উপেক্ষা করার উপায় নেই। শান্তি, স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মকাণ্ডের আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষ ওই নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে। এটাই এই সরকারের ম্যান্ডেট। ৬ জানুয়ারি মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকুতি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বৈধতা। বিএনপিও ৬ জানুয়ারি তাদের সব কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করে কার্যত এই নির্বাচনকে মেনে নেয়। বিএনপি যে নির্বাচনকে মেনে নেয় তার বড় উদাহরণ হলো ২০১৪-তে বিএনপি ৯টি বড় সমাবেশ দেশের বিভিন্ন স্থানে করেছে। এসব সমাবেশের জন্য তারা বর্তমান সরকারের কাছেই অনুমতি নিয়েছে। এ সরকার যদি অবৈধই হবে তাহলে 'অবৈধ সরকারের' সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাবই বা কেন দেবে বিএনপি?

বিএনপি যদি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিত এবং সেই নির্বাচনে যদি কারচুপি হতো তাহলে বিএনপি হয়তো লাগাতার আন্দোলন অব্যাহত রাখতে পারত। কিন্তু সে পথে না গিয়ে বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েছে। প্রতিহত করতে না পেরে বিএনপি আন্দোলনের কর্মসূচি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। এর পর সাংগঠনিক শক্তি পুনর্গঠনের আগে বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়া কি বাস্তবসম্মত?

বিএনপি অথবা তারেক রহমান মনে করছে জিয়া অরফানেজ মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হবে। তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের সাজা হবে, তিনিও নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সরকার পতনই ছিল বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল জামায়াত। যারা ২০০৯ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন চায়। কারণ আওয়ামী লীগ থাকা মানেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে যাওয়া। পরিকল্পনা করা হয়, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে বিএনপি সমাবেশ করবে ঢাকায় এবং সারা দেশে। ঢাকার সমাবেশ করা হবে পল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে। এতে বিএনপি-জামায়াত যোগ দেবে। সমাবেশের পর তারা যেখানেই অবস্থান করবেন। আরেকটি 'জনতার মঞ্চ' তৈরি করবে। এখানে শ্রেণি-পেশার মানুষরা যোগ দেবেন সংহতি জানাবেন। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বিএনপিপন্থিরা এসে যোগ দেবেন। পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। '৯৬-এর 'জনতার মঞ্চ' এবং শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আদলে হবে 'গণতন্ত্র মঞ্চ'। দেশ অচল হবে। বন্ধু পীর হাবিবুর রহমানের রিপোর্ট অনুয়ায়ী ৩ জানুয়ারি রাতে দলের নেতা রিজভী আহমেদকে দেখার জন্য বেগম জিয়া নয়াপল্টনে যাবেন। সেখানেই অবস্থান করবেন। ৫ জানুয়ারি ২০১৫-এর সমাবেশে গণঅবস্থানের ঘোষণা দেবেন। শাপলা চত্বর বায়তুল মোকাররম থেকে জামায়াত-শিবির আসবে। প্রেসক্লাব থেকে পেশাজীবীদের ব্যানারে বিএনপি-জামায়াতপন্থি বুদ্ধিজীবীরা আসবেন। হাইকোর্ট থেকে আসবেন আইনজীবীরা। ব্যস। ঢাকা অচল। সচিবালয় থেকে বিএনপিপন্থিরা এসে জড়ো হবেন। এভাবে আরেকটি 'জনতার মঞ্চ' আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ডেকে আনবে। প্রসঙ্গত বলতে চাই, '৯৬-এর জনতার মঞ্চ নিয়ে খালেদা জিয়ার ক্ষোভের সীমা নেই। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে 'জনতার মঞ্চ' করার অভিযোগে একাধিক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। কিন্তু নীলনকশাটি সরকারের কাছে ফাঁস করে দেন বিএনপিরই কিছু নেতা। সেটা অন্য প্রসঙ্গ, আমার প্রশ্ন, এটা কি একটি বাস্তবায়নযোগ্য ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা? এই পরিকল্পনার এঙ্টি প্ল্যান কি? বিকল্প কি ছিল? ধরা যাক, বেগম জিয়া ৩ জানুয়ারি রাতে পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে থেকে গেলেন, সেখানে কি তিনি জনসভা বা গণঅবস্থান করতে পারতেন? যে বিএনপির নেতারা বোরকা পরে হাইকোর্টে যান, তারা কি গ্রেফতারের ভয় তুচ্ছ করে কর্মীদের নিয়ে পল্টনে আসতেন? কর্মীদের মধ্যে কি সেই মনোবল ছিল যাতে তারা লাগাতার সেখানে অবস্থান করতে পারে? সরকারের অবস্থান কি এতই দুর্বল যে সব ব্যারিকেড ভেঙে পল্টনে জনতার ঢল নামত? ইদানীং লক্ষ্য করছি, ৫ জানুয়ারি বিএনপির সমাবেশ করতে না দেওয়ায় গণমাধ্যমে সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে। টকশোবাগীশরা বলছেন, একটা সমাবেশ করতে দিলে কী হতো? আইনে 'আত্দরক্ষা'র ইনডেমনিটি দেওয়া আছে। আপনাকে কেউ হত্যার জন্য উদ্যত হলে নিজে বাঁচার জন্য তাকে আক্রমণ করাকে বলে ‘Right to self defenses (আত্দরক্ষার অধিকার)। কে নিজের মৃত্যু ডেকে আনে! কেন সরকার ২০ দলীয় জোটকে সমাবেশ করতে দিল না তার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করছে না। বলা হচ্ছে, 'বালুর বস্তা দিয়ে খালেদা জিয়াকে আটকে রাখা অমানবিক। সভ্যতার ইতিহাসে এটা নাকি নজিরবিহীন। একটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য গোপন ষড়যন্ত্র তাহলে কি? লন্ডনের ব্লপ্রিন্ট এবং খালেদার তার বাস্তবায়নের চেষ্টা কি বালুর বস্তার চেয়েও ভয়াবহ নয়?

পৃথিবীর কোনো আন্দোলন যেখানে জনগণের সমর্থন আছে তা কি বালু আর ইটের বস্তা দিয়ে আটকে রাখা যায়? সরকারের প্রতি যদি জনগণের তীব্র ঘৃণা এবং অনাস্থা থাকত, যদি বিএনপির সেরকম সাংগঠনিক শক্তি থাকত তাহলে লাখো জনতা গুলশান অভিমুখে গিয়ে বালির বস্তা আর ইটের বস্তাভর্তি ট্রাক উপড়ে ফেলত। আমরা ইতিহাসের দিকে যদি ফিরে তাকাই, ১৯৮৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ড. মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু জয়নাল, জাফর, দীপালী কাঞ্চনের রক্তের উচ্চতা ট্যাংককে ছাপিয়ে দিয়েছিল।

'৮৪-তে এরশাদ ছাত্র মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে হত্যা করেছিল সেলিম, দেলোয়ারকে; কিন্তু ওই ট্রাককে তছনছ করতে ছাত্র-জনতার সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। '৮৮-তে এরশাদ শেখ হাসিনাকে মহাখালীতে ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাসায় আটকে রেখেছিলেন, কিন্তু শেখ হাসিনা সেদিন হেঁটে মহাখালী থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এসেছিলেন পুলিশি ব্যারিকেড আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। খালেদা জিয়ার সরকার অসুস্থ ড. হুমায়ুন আজাদকে দেখতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যাওয়ার পথে তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রীর গাড়ি আটকে দেন। শেখ হাসিনা তখন হেঁটে সিএমএইচের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আন্দোলনে যদি জনগণের সম্পৃক্ততা থাকে, নেতৃত্ব যদি দৃঢ় চেতনার অধিকারী হয় তাহলে বালুর বস্তাভর্তি ট্রাক হয়ে যায় খরকুটো। বেগম জিয়া কি সেরকম ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন? খালেদা জিয়া কি তাহলে জনগণের শক্তি নয় অন্য কোনো শক্তির ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিলেন যে, এমন একটা পরিস্থিতি হবে যখন তার বন্ধুরা বাকি কাজটা করে দেবে?

৫ জানুয়ারি ২০১৫-এর নীলনকশা ছিল অনেকগুলো 'যদি' এবং অনুমানের ওপর নির্ভরশীল। কেউ তো আর নিজের হত্যাকারীদের দুধভাতে আদর করতে পারে না। খালেদা জিয়ার বাড়ির সামনে বালু ও ইটভর্তি ট্রাক যেমন গণতান্ত্রিক নয়, তেমনি একটি সরকারকে উৎখাতের জন্য ষড়যন্ত্রও রাষ্ট্রদ্রোহিতা। বিএনপি এবং বেগম জিয়া ৫ জানুয়ারি ২০১৪তে যেমন ব্যর্থ হয়েছিলেন ৫ জানুয়ারি ২০১৫তেও ব্যর্থ হলেন। গত বছরের ব্যর্থতা তাকে দিয়েছিল আত্দউপলব্ধি এবং শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার সুযোগ। আর এবারের ব্যর্থতা তার দলকে ঠেলে দিল অস্তিত্বের ঝুঁকির মধ্যে। ৫ জানুয়ারি অতিউৎসাহী গণমাধ্যম কর্মীরা তাকে দিয়ে বলিয়ে নিলেন অবরোধ চলবে। কিন্তু ৬ জানুয়ারি থেকে মানুষ অবরোধকে পায়ে ঠেলে জীবিকার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে আবার প্রমাণ করল জনগণ ক্ষমতা বদলের ক্রীড়নক নয়। জনগণের ইচ্ছাই হলো শেষ কথা। জনগণ যদি না চায় এ সরকার এক মুহূর্তও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। আবার জনগণের নামে আন্দোলনও বালুর ট্রাকে আটকে যাবে যদি জনগণ তাতে সম্মতি না দেয়। যারা বলেন, বালুর ট্রাকে গণতন্ত্রবন্দী, তাদের জানা উচিত জনগণের শক্তির কাছে এসব বালুর ট্রাক পাখির পালকের চেয়েও হালকা। তাই জনগণ কী চায় তা আগে অনুধাবন করতে হবে। জনগণ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অপশাসনকে যেমন হটিয়ে দেয়, তেমনি তাদের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া আন্দোলন, নৈরাজ্যও যে প্রত্যাখ্যান করতে জানে ৫ জানুয়ারির নীলনকশার মৃত্যু তারই প্রমাণ।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল :[email protected]

 

 

 

সর্বশেষ খবর