শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

চারটি ঘাঁটি অতিক্রমের পর নাজাতের স্থান

মাওলানা মাহ্‌মূদুল হাসান

চারটি ঘাঁটি অতিক্রমের পর নাজাতের স্থান

নাজাতের স্থানে পৌঁছার আগে চারটি ঘাঁটি অতিক্রম করতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে- মৃত্যু, দ্বিতীয়টি কবর, তৃতীয়টি হাশরের ময়দান আর শেষটি হচ্ছে পুলসিরাত। এরপর হয় জাহান্নামি না হয় জান্নাতি। তবে শেষ তিনটি আমাদের বুঝে আসতে চায় না। কারণ আমরা দেখি না। আর মৃত্যু যে চরম সত্য তা আমরা বাস্তবে দেখতে পাই। মুমিন-কাফির, বড়-ছোট, যুবক-বৃদ্ধা, ধনী-গরিব, আলেম-জাহেল, পীর-মুরিদ সবাই এটা দেখি, জানি এবং বিশ্বাস করি। তাই এর জন্য তৈরি হওয়া প্রয়োজন। আর অবশিষ্ট তিনটির কথা পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে বিদ্যমান রয়েছে। অবিশ্বাসের কিছুই নেই। যারা হেদায়েত লাভে ধন্য হয় তাদের জন্য এসব ঘাঁটি পার হওয়া কঠিন ব্যাপার নয়।

এই হেদায়েত লাভের জন্য অন্তরে গোনাহর প্রতি ঘৃণা এবং নেক আমলের প্রতি আকর্ষণের প্রয়োজন। কেননা ঘৃণা গোনাহ বর্জনে আর আকর্ষণ নেক আমল করার জন্য সহায়ক হয়। যাদের অন্তরে গোনাহর প্রতি ঘৃণা বিদ্যমান এবং নেক আমলের প্রতি আকর্ষণ বিদ্যমান তারা কোনো দিন গোনাহ করে না বরং নেক আমলই করে থাকে। এর দৃষ্টান্তস্বরূপ দুজন সাহাবির দুটি ঘটনা শুনুন। উভয় সাহাবির নামই হচ্ছে হানজালা। ইবনে হাজার (রহ.) 'ইসাবাতে, ইবনে কাছীর (রহ.) 'বেদায়া নেহায়া' এবং আবু নায়িম (রহ.) 'হিলিয়তে' এই দুজনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন।

ক. একজন হচ্ছেন হানজালা ইবনে রবি। তিনি একদিন অত্যন্ত অস্থির অবস্থায় রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে হজরত আবু বকর (রা.)-এর সঙ্গে দেখা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- 'হে হানজালা! কি ব্যাপার, এত অস্থির কেন? কোথায় যাচ্ছ? হানজালা বললেন, হানজালা মুনাফিক হয়ে গেছে, তাই রসুলেপাকের কাছে অবস্থার সংশোধনের জন্য যাচ্ছি। হজরত আবু বকর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মধ্যে নেফাকের কী পেয়েছ? হানজালা বললেন, আমি যখন রসুলেপাকের মজলিসে থাকি আর জাহান্নাম ও জান্নাত সম্পর্কে রসুলের উপদেশ শ্রবণ করি তখন এ সম্পর্কে স্বচক্ষে দেখার মতো বিশ্বাস হয়, অন্তরে নূর অনুভূত হয়। আর যখন মজলিস থেকে ফিরে পরিবার-পরিজন এবং দুনিয়ার কাজে নিমগ্ন হই তখন আর সেই ভাব থাকে না। হজরত আবু বকর (রা.) বললেন, 'আমারও একই অবস্থা, সুতরাং চল দুজনেই যাই এবং আমাদের অবস্থা সম্পর্কে রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করি।' এরপর দুজনই দরবারে হাজির হয়ে নিজ নিজ অবস্থান বর্ণনা করেন। তাদের অবস্থা শুনে রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- 'আমার কাছে থাকাকালে যে অবস্থা হয়, এটা যদি তোমাদের সবসময় বহাল থাকত, তাহলে ফেরেশতারা চলার পথে ও বিছানায় তোমাদের সঙ্গে মুসাফাহা করত। হে হানজালা, এরূপ অবস্থা মাঝে মাঝে হবে।'

খ. এরূপই আর একটি হচ্ছে হানজালাতুল গাসিলের ঘটনা। নামের সঙ্গে গাসিল শব্দটি অত্যন্ত রহস্যপূর্ণ। গাসিল অর্থ যাকে গোসল করানো হয়েছে। জানাজার নামাজের আগে মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া হয়ে থাকে। রসুলের যুগে তো অনেক মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া হয়েছিল। তো কাউকেই গাসিল উপাধি দেওয়া হয়নি। শুধু হানজালাকে গাসিল কেন বলা হয়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আপনাদের বিস্তারিত ঘটনা শোনাতে হবে। তবে এর আগে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মাসআলা শোনাতে চাই। কারণ এ নিয়ে আমাদের দেশে ভুল বোঝাবুঝি আছে।

যে কোনো মানুষ, হতে পারে শরাবি, বেনামাজি, ঘুষখোর, ব্যভিচারী, আত্দহত্যাকারী, গোনাহগার, ফাসিক; যদি সে মুমিন হয় তাহলে তাকে মৃত্যুর পর অবশ্যই সুন্নত মোতাবেক গোসল দিতে হবে, তার জানাজার নামাজ আদায় করে কাফন-দাফন করতে হবে। এরূপ প্রসিদ্ধ পাপী ব্যক্তির জানাজার ইমামতি কোনো প্রসিদ্ধ আলেম দ্বারা না করে সাধারণ মানুষের দ্বারা জানাজার নামাজ পড়ানো উত্তম, কিন্তু যদি এরূপ লোক না পাওয়া যায় অথবা ফিতনার আশঙ্কা হয় তাহলে প্রসিদ্ধ আলেম দ্বারাই জানাজার ইমামতি এবং কাফন-দাফনের কাজ সমাধা করবে। জানাজা ব্যতীত কাফন-দাফন করলে এলাকার সবাই গোনাহগার হবে।

আমাদের দেশে মৃত ব্যক্তিকে কবরে চিৎ করে শোয়ানো হয়, শুধু চেহারাকে কেবলামুখী করা হয়, এটা ঠিক নিয়ম নয়, বরং চেহারার সঙ্গে সঙ্গে ইমানের স্থান বক্ষসহ সব শরীরকেই কেবলামুখী করে ডান কাতে শোয়াবে। আমরা যখন নামাজ পড়ি তখন চেহারা এবং ইমানের স্থান বুককেও কেবলামুখী করি। রাতে যখন ঘুমাই তখনো ডান কাতে ঘুমানো সুন্নত। ঘুম হলো মৃত্যুর ভাই। সুতরাং কবরেও এভাবেই রাখা সুন্নত। কোনো অসুবিধা হলে ভিন্ন কথা আর অসুবিধা না হলে এটাই সুন্নত তরিকা। কবর কেবলার দিকে একটু বেশি খনন করা চাই, যাতে লাশের পিঠ ঠেকানো যায়।

আমাদের দেশের মানুষের স্বভাব হলো যদি কোনো নতুন আবিষ্কারের কথা শোনানো যায় তাহলে সবাই তার প্রশংসা করে, আবিষ্কারকের জ্ঞানের স্তুতি গায়। আর যদি দীনি কোনো মাসআলা শোনানো হয়, যা তাদের জানা নেই তাহলে সমালোচনায় লেগে যায়। নানা ধরনের কথা বলাবলি করে। জানাজার আমল খুব কম হয়। ফলে বর্ণিত মাসআলাটি না জানা থাকা অসম্ভব কিছু নয়। তা ছাড়া মাসআলা মাসায়েল নিয়ে আমাদের আলোচনা-পর্যালোচনাও কম হয়, তাই অনেক মাসআলা জানা বাকি থাকে। আমি যে মাসআলা বর্ণনা করলাম তা যাচাইয়ের জন্য বড় বড় আলেম ও মুফতিকে জিজ্ঞাসা করুন এবং সুন্নত মোতাবিক আমল করুন। অনর্থক সমালোচনা করে গোনাহগার হবেন না, বরং মাসআলা সঠিক হলে আমল করে রসুলের সুন্নত জিন্দা করুন।

রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় স্ত্রী খাদিজার পুত্র হজরত ইবরাহীম, শাশুড়ি হজরত আয়েশার আম্মা উম্মে রুম্মান এবং হজরত আলীর মা জননীর কবরে নিজে অবতরণ করে তাদের ডান কাতেই দাফন করেছেন। ফাতওয়ায়ে শামীসহ বিভিন্ন ফতোওয়ার কিতাবে বলা হয়েছে- এর দ্বারা ডান কাতে রাখাই সুন্নত প্রমাণিত হয়। আল-হামদুলিল্লাহ, এখন অনেক জায়গাতেই মাইয়েতকে এভাবে কবরে রাখা হচ্ছে। যাই হোক বলছিলাম যে, ওই সাহাবিকে গাসিল বলা হয় কেন? ইবনুল আসির 'উসদুল গাবা' কিতাবে লিখেছেন যে, ওই সাহাবি তার যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের আহ্বান শুনতে পান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যুদ্ধে শহীদ হলে জান্নাত লাভ করা যায়। তাই তিনি আর মুহূর্ত কাল বিলম্ব না করে তলোয়ার হাতে নিয়ে শাহাদাতের কামনায় যুদ্ধের দিকে দৌড় দেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, তার স্ত্রী তাকে পেছন থেকে ডাকলে তিনি বলেন, 'ইনশাআল্লাহ তোমার সঙ্গে জান্নাতে দেখা হবে।' অতঃপর তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাতবরণ করেন।

লেখক : খতিব, গুলশান সেন্ট্রাল জামে মসজিদ, ঢাকা।

 

 

 

সর্বশেষ খবর