সোমবার, ২ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

থামাথামির যত সমস্যা

আবু তাহের

থামাথামির যত সমস্যা

'হোয়েন কোয়ান্টিটি ইনক্রিজেস, কোয়ালিটি ডিক্রিজেস।' পরিমাণ বাড়লে মান কমে যায়। খুবই উপাদেয় কথা। দেশের মান রক্ষা বা মান বৃদ্ধির জন্য যাঁরা শয়নে-স্বপনে-নিশি জাগরণে বেচঈন, সেই অভিজাতরা এ জন্যই তো পরিমাণ বৃদ্ধির অনুমোদক নন। 'তাদের যে দিন দিন অর্থবিত্তের পরিমাণ বাড়ে তারা মন খারাপ করেন?' এ রকম প্রশ্ন যারা করে তারা নাকি কূটবুদ্ধির ধারক। কুবুদ্ধির প্রতি আমাদের কোনো অনুরাগ নেই।

পরিমাণ বৃদ্ধিরোধকদের পঙ্ক্তিভুক্ত এক মহাজনকে দেখলাম জেনারেল জিয়ার আমলে সরকারপন্থি নতুন দৈনিক পত্রিকার আবির্ভাবে মর্মাহত হয়ে আস্ত একটা নিবন্ধনই লিখে ফেললেন। নিবন্ধনের সারকথা হলো- 'দেশে রয়েছে অনেক দৈনিক পত্রিকা। এগুলোরই মান উন্নত করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে আরেকটি দৈনিক প্রকাশের কোনো মানে হয়!'

খুব মাথা ঘামিয়ে লেখা। কিন্তু প্রবীণ সাংবাদিক সাহিত্যিক আফলাতুনের মতে, মাথাটা অভিজাত মহাজনের নয়। আফলাতুন বলেন, 'গোয়েন্দা লাগিয়ে দে। কোন্ মুহুরিকে দিয়ে এই জিনিস পয়দা করা হয়েছে ধরা পড়ে যাবে।' নিবন্ধকার পেশায় ব্যারিস্টার। তাঁর যুক্তির বিরোধিতা করে নতুন দৈনিকটিতে সাংবাদিক মহিউদ্দিন খান লিখলেন- 'তাহলে কী আমরাও বিস্মিত হয়ে বলব, দেশে এত ব্যারিস্টার থাকতে আরও একজন ব্যারিস্টার কেন!'

পরিমাণ বৃদ্ধিজনিত উপকার শুধু যে টাকা থেকে আসে তা নয়। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আমার নানাজান বলতেন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুসরণ করলে কী বিশ্বকবি প্রাপ্তির সৌভাগ্য বাঙালির হতো? রবিঠাকুর ছিলেন তার পিতা-মাতার চতুর্দশ সন্তান।

রবীন্দ্রনাথকে নাড়াচাড়া করে দেখতে গিয়ে আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না যে, পরিমাণ বৃদ্ধি বিস্মৃতিও ঘটায়। উদাহরণটা হাতের মুঠোতেই। বাংলাদেশে এখন অনেক টিভি চ্যানেল। এগুলোর নাম কী? নাম থাক, এগুলো সংখ্যায় কত? চটজলদি উত্তর দেওয়া কঠিন। টিভি চ্যানেল মাশাআল্লাহ ২৯টি। সরকারি তিনটি, বেসরকারি ২৬টি। যেকালে এত চ্যানেল ছিল না, বিটিভি ছিল রাজা এবং রাজাধিরাজ, সেকালে স্বাস্থ্যবিষয়ক নিয়মিত একটা অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। এক রাতে ঘটনাক্রমে অভিজাত এক ক্লাবে বসে ওই অনুষ্ঠান দেখছি। দেখি, বিশেষজ্ঞ এক চিকিৎসক জ্ঞান দিচ্ছেন- 'মানবদেহে যত রগ আছে, সব রগের মূলে কানা। কানা কন্ট্রোল করবেন তো সুস্থ থাকবেন। ত্যালযোক্ত সুস্বাদু কানা বাদ দিতে অবে। ওরকম কাদ্যের লভ সংবরণ করতে না ফারলে কিন্তু বিফদ।'

আমার পাশে বসা দর্শক-শ্রোতা মহাবিরক্তির সঙ্গে বললেন 'স্টপ'! তিনি বলেন, 'শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে পারে না, এ আবার এক্সপার্ট! খাদ্যকে কাদ্য, লোভকে লভ, রোগকে রগ, তেলকে ত্যাল বলবার অধিকার তাকে কে দিয়েছে, য়্যা?'

এক্সপার্ট রয়েছেন মিনি পর্দায়। আপনি যে চিৎকার করে 'থামো' বললেন তা কী এক্সপার্ট শুনেছেন?- জানতে চাইলাম আমি। তিনি সলজ্জ হেসে বলেন, 'ভুল উচ্চারণ কানে ঢোকায় মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। স্যরি! আচ্ছা বিটিভি কী একটু থামতে পারে না। তার সমস্যা কোথায়?'

থামা মানে? তিনি বলেন, 'পচা অনুষ্ঠান বন্ধ করা আর কী।' বললাম, অ। তিনি বলেন, 'অ বললেই হলো? ডাইরেক্ট বলুন আমি ঠিক বলেছি নাকি অন্যায় বলেছি।' বললাম, 'শতভাগ ন্যায্য বলেছেন।' তিনি খুশি হয়ে আমায় কফি, নানরুটি প্লাস গ্রিল চিকেন খাওয়ালেন। খেতে খেতে পরিচয়।

যশোর জেলার সাগরদাঁড়ির সন্তান ইসরার আহমেদ চাকরি করেন লন্ডন। ব্যবসায়ী মামার সঙ্গে এই ক্লাবে এসেছেন। অন্য কামরায় মামা তাস খেলছেন। খেলতে যাওয়ার সময় বলে গেছেন, 'তুই বসে টিভি দেখ। আধা ঘণ্টা একটু তাস খেলে আসি।' ইসরার বলেন, 'হায়রে আমার আধা ঘণ্টা!'

ইসরার প্রতি ত্রিশ মিনিটে একবার 'ওঠো মামা, বাড়ি যাই' বলেন। মামা বলেন, 'এই আর দশ মিনিট!' সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে এই সিস্টেম চলছে, থামছে না। বিরাট কোনো গোপন সংবাদ দেওয়ার ভঙ্গিতে ফিসফিসিয়ে ইসরার বলেন, 'গুড্ডু মামার সব ভালো এক্সসেপ্ট দিস গ্যাম্বলিং। হি ইজ আ গ্যাম্বলার টু দ্য হাইয়েস্ট অর্ডার। মামির ধারণা, গুড্ডু মামাকে আজরাইল ছাড়া কেউ থামাতে পারবে না। সে জুয়া খেলেছে, খেলছে এবং খেলতেই থাকবে আমরণ।'

থামা, থেমে যাওয়া, থামানো, থামিয়ে দেওয়া সহজ কাজ নয়। সময় মতো থেমে যাওয়ার ক্ষমতা আমার কাছে ঐশ্বরিক মনে হয়। কবি শামসুর রাহমানের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তাকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেখানে কলিম শরাফী একটিমাত্র গান গেয়েছিলেন। যাকে বলে হৃদয় ভরানো প্রাণ জুড়ানো অতুল কণ্ঠের গান। দর্শকরা কত অনুরোধ করল মিনতি জানাল আরেকটি গাইবার জন্য। কলিম শরাফী বিনীতভাবে জানালেন, এ ধরনের অনুষ্ঠানে একটির বেশি গান তিনি গান না, কখনোই গাননি, আজও গাইবেন না।

ভারত জয় করার আগে মধ্য এশিয়ার ফারগানা রাজ্যে বাস করতেন জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। ওই রাজ্যের শাসক হোসেন উদি সংগীত রসিক। শাসকের দরবারে কণ্ঠশিল্পী এসেছে নতুন। তার গলা চমৎকার। সমস্যা হলো ঠোঁট বাঁকা করে দুই হাত সংকোচন-প্রসারণ করে গাইতেন, যা ছিল শাসকের খুবই অপছন্দের। এই ভঙ্গি দেখলেই গান-গাওয়া থামিয়ে দিতেন শাসক। বলতেন, 'সুন্দর ভঙ্গিতে গাও।' মুখে 'জী হুজুর' বলতেন শিল্পী। গাইতে গেলে আগের ভঙ্গিতেই গাইতেন। এতে অতি রুষ্ট হোসেন উদি একদিন শিল্পীর সংগীতচর্চার মাঝামাঝি অবস্থায় হস্তক্ষেপ করলেন, 'য়্যাই! তোরে না বলেছি এভাবে গাইবি না। থাম্!'

কীভাবে থামবেন শিল্পী! তিনি তো সুর মূর্ছনার অলৌকিক আনন্দে মগ্ন। রুষ্ট শাসক দিলেন পিটুনি। গান তো থামলই, শিল্পী হলেন শয্যাগত। হোসেন উদির সঙ্গে বাবরের ছিল রাজনৈতিক দুশমনি। তার কোনো কাজই বাবরকে তৃপ্ত করে না। কিন্তু আত্দজীবনীতে বাবর লিখেছেন- 'হোসেন উদি জীবনে ভালো কাজ বলতে এই একটিই করেছে।'

মিসরের বাদশাহ ফারুক 'পরামর্শক' নাম দিয়ে কিছু চামচা পুষতেন। এন্তোনিও পুলী ছিল বাদশাহর খুব প্রিয় চামচা। তার জন্ম ইতালিতে। বহুদিন থাকতে থাকতে মিসরীয় হয়েছে। প্রতাপশালী মিসরীয় আর কি। ফারুক তাকে মাথায় তুলতে তুলতে রাষ্ট্রীয় খেতাব 'বে' পর্যন্ত দিয়েছেন। 'পাশা' ছিল সর্বোচ্চ খেতাব, এরপরই 'বে'। মিসরীয়রা বিশেষত রাজধানী কায়রোর বাসিন্দারা জানতেন, এন্তোনিও পুলী বে'র কেন এত প্রতাপ। পুলী বে'র প্রধান কাজ 'বাদশাহর জন্য নারী সংগ্রহ।'

শক্তিমানের স্বার্থে নোংরা কাজ যে করে শক্তিমান তাকে কোলে নিয়ে আদর করবে। হাতে তুলে দেবে ফুলের তোড়া। এই নিয়ম ঐতিহাসিক। গোল পাকায় লাগামহীনতা। গোপন বিষয়ের কোন্ স্তর পর্যন্ত স্তাবককে জানতে দেওয়া যায় সেই সীমারেখার অভাব শক্তিমানের জন্য বিপজ্জনক। বাদশাহ ফারুক অনেক দেরিতে তা উপলব্ধি করেছিলেন। ততক্ষণে তিনি ইতালিতে নির্বাসিত। শাহীতন্ত্র উৎখাতের পর কর্নেল জামাল আবদুল নাসেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ফারুককে দেশত্যাগে বাধ্য করে।

ফারুক নোংরা-জঘন্য-বাজে কাজ করতেন। লোকে মনে করত তিনি কখনোই থামবেন না। কিন্তু তিনি থামলেন। আসলে থামতে বাধ্য হলেন। গদি চলে গেলে থামতেই হয়। গদি যে যাবে, গদিতে থাকলে সেই বোধ কাজ করে না। তখন মনে হয় 'রোজ কেয়ামত তক থাকব। দেখি কে আমারে নামায়!' ফারুক থেমে যেতেই তার প্রিয় এন্তোনিও পুলী বে সচল হলেন। খুবই সচল। ফারুকের যত কেলেঙ্কারি তা একের পর এক ফাঁস করতে থাকলেন সামরিক আদালতে।

ওই সময়টায় অভ্যুত্থান-উত্তর মিসরের সংবাদ সংগ্রহের জন্য বহু বিদেশি সাংবাদিক জড়ো হয়েছিলেন কায়রো নগরীতে। পুলী বে'র মুখে তার মনিব ফারুকের নষ্টামির অনুপুঙ্খ বিবরণ শুনে তারা চমৎকৃত। মার্কিন সাংবাদিক মাইকেল স্টার্ন লিখলেন, 'এ লোকটা কৃতঘ্ন ও নির্লজ্জ। প্রভুর অনাচারের কোনো কিছুই সে রেখে ঢেকে বলছে না। অনর্গল বলে চলেছে এন্তোনিও পুলী বে। বলছে তো বলছেই। লোকটা থামছে না। সে থামতে জানে না।'

কখন থামতে হয়, এটা জানা খুব দরকার। প্রশ্ন হলো, শেখাবে কে? মরহুম সাংবাদিক আতাউস সামাদ আমায় একবার বলেছিলেন, বক্তৃতার শোভন সময়সীমা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শেখা যায়। বঙ্গবন্ধু জনসভায় কখনোই ২০ মিনিটের বেশি ভাষণ দেননি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বহু জায়গায় সফরে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা হয় আতাউস সামাদের। তিনি জানান, একবার লাহোরে বঙ্গবন্ধু উর্দুতে তুমুল বক্তৃতা করছিলেন। ভাবলাম, আজ তো কম সে কম এক ঘণ্টা চালাবেন। ওমা! দেখি কী ঠিক উনিশ মিনিটের মাথায় মুজিব ভাই বলছেন, 'তো ভাইলোগ! ফির মোলাকাত হো গে, ফির মিলিংগে, আজ ইঁহা তক। আসসালামু আলাইকুম।'

বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল, আতাউস সামাদ জানান, বঙ্গবন্ধু ঘড়ি দেখে ভাষণ থামাতেন না। অটোমেটিক্যালি থেমে যেতেন। কিন্তু 'ডেবোনেয়ার' পত্রিকায় পড়লাম, এক নেতা বক্তৃতা দিচ্ছেন তো দিচ্ছেনই থামেন না। রাত গড়ায় তার খেয়াল নেই। শ্রোতারা শেয়ালের ডাক ছাড়তে থাকলে বক্তা বললেন, 'অনেক সময় নিয়ে ফেললাম। স্যরি, আমার সামনে কোনো ঘড়ি ছিল না।' বিচ্ছু এক শ্রোতা বলল, 'সামনে ঘড়ি নেই তো কী। পেছনে তো একটা ক্যালেন্ডার আছে।'

থেমে যাওয়া যে কী কঠিন তা জানার জন্য প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে উঁকি দেওয়া যাক। যোশেফ স্ট্যালিনের হাতঘড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি মস্কো পুলিশের প্রধান ল্যাবরেন্তি পারলোভিচ বেরিয়াকে বললেন, 'নিশ্চয়ই কেউ চুরি করেছে।' বেরিয়া বলেন, 'চবি্বশ ঘণ্টার মধ্যে ঘড়ি উদ্ধার করে দেব কমরেড।' এখনই শুরু করছি তদন্ত।

ঘণ্টাখানেক পরে ঘড়িটি নিজের বালিশের খোলের মধ্যে পেলেন স্ট্যালিন। নিজের ভুল বুঝলেন। ফোন করলেন, 'বেরিয়া। তোমার তদন্তের অবস্থা কী।' বেরিয়া বলেন, 'চলছে কমরেড।' স্ট্যালিন বলেন, 'তদন্ত থামাও।'

'তা তো এখন সম্ভব নয় কমরেড' বললেন বেরিয়া, 'পুলিশ সাত চোরকে পাকড়াও করেছে। তার মধ্যে পাঁচজন স্বীকার করেছে যে তারা আপনার ঘড়ি চুরি করেছে। এ অবস্থায় তদন্ত কীভাবে থামাই!'

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর