দেশকে গ্রাস করেছে অদ্ভুত এক যেন অাঁধার। পেট্রলবোমা, ককটেল ছুড়ছে দুর্বৃত্তরা, পুড়ছে সাধারণ মানুষ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের লাগাতার অবরোধের ৫০ দিন পূর্ণ হলো। এ সময় টাকার অঙ্কে ক্ষতি হয়েছে ৯১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তার চেয়েও বড় যে ক্ষতি হয়েছে তা পরিমাপের কোনো একক জানা নেই। প্রাণহানি হয়েছে ১০৬ জনের। আহত হয়েছেন হাজারো মানুষ। সর্বনাশা কর্মসূচির শেষ কোথায়? এখন পর্যন্ত যে ১০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে পেট্রলবোমায় পুড়ে জীবন হারিয়েছেন ৫৫ জন। আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে যানবাহনে দুর্বৃত্তের হামলায়। পিকেটারের ছোড়া ঢিলে নিহত হয়েছেন দুজন। এই ৬০ জনই সাধারণ মানুষ। যাদের রাজনীতির সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক ছিল না। ৩১ জনই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। পরিবহন চালক-শ্রমিক। নারী নিহত হয়েছেন ৯ জন। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বোমা হামলায় একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন প্রায় ৩০০। ভাঙচুরের শিকার হয়েছে পুলিশের শতাধিক যানবাহন।
অবরোধে যানবাহন পুড়েছে ৬১২টি। ভাঙচুর করা হয়েছে আরও অন্তত ৯০০টি। এতে ক্ষয়ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে সড়ক পরিবহন সমিতি। ট্রেনে হামলা হয়েছে ১১ বার। তবে এতে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেনি। সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক দিনের হরতাল কিংবা অবরোধে ২ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। প্রতিদিন শিল্প উৎপাদন সক্ষমতায় ২৫ শতাংশ ক্ষতি ধরলে এর পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। ঢাকা চেম্বার, এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির ১৬ খাতে গত ৫০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তবে এর বাইরের সব খাতের হিসাব করলে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রতিদিনের ক্ষতি অনুযায়ী হিসাব করলে অবরোধ-হরতালে গত ৫০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় রপ্তানি পোশাকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, পরিবহন ও যোগাযোগে ১৫ হাজার কোটি টাকা, কৃষিতে ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ও আবাসনে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ সময় পর্যটন খাতে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। পাইকারি বাজার, শপিং মল, শোরুম, ক্ষুদ্র ও ছোট দোকানে ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, স্থানীয় পোশাক খাতে ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও উৎপাদন খাতে ক্ষতি ৫ হাজার কোটি টাকা, বন্দর ও সেতুতে রাজস্ব হারানোর ফলে ক্ষতি ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা, সিরামিক শিল্পে ১ হাজার কোটি টাকা, পোলট্রি শিল্পে ক্ষতি ৯০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুত ও রপ্তানি শিল্পের ৯০০ কোটি টাকা করে ক্ষতি হয়েছে। দেশে বর্তমানে ৬০টি বীমা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এই বীমা খাতে ক্ষতি ৭৫০ কোটি টাকা। রাজধানীতে ছোট-বড় মিলিয়ে ভ্রাম্যমাণ এবং হকার ও অস্থায়ী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এতে হকারদের ক্ষতি ৭৫০ কোটি টাকা। বন্দরে আমদানি পণ্য খালাসে ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা ও হিমায়িত খাদ্যের ক্ষতি ৪০০ কোটি টাকা এবং আবাসন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।জীবিকার সন্ধানে পথে নেমে দগ্ধ মানুষের এত কান্না, এত আহাজারি, শান্তির জন্য নিপীড়িত মানুষের আহ্বান কানে তুলছেন না সহিংসতার রাজনীতির কুশীলবরা। বরং আরও লাশের রাজনীতির গোপন পরিকল্পনা প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে জনসমক্ষে। রাজনীতি লাশের নির্ভরতা ছেড়ে কবে জীবনের জন্য হবে, এ প্রশ্ন সচেতন বিবেকের। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও একাধিকবার আহ্বান জানানো হয়েছে সহিংসতা বন্ধের। যাদের প্রতি আহ্বান, তারা যেন অন্ধ, বধির, তাদের কানে কিছুই পৌঁছে না!
নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও বুঝে উঠতে পারছেন না কোন পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, কবে হবে অনিশ্চয়তার সমাধান? অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের দুশ্চিন্তা তীব্র হচ্ছে। খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষ কাজের আশায় সাত-সকালে বসে আছেন ফুটপাথে। সাধারণ মানুষের একটাই কথা, কীসের রাজনীতি, এই ঘৃণ্য রাজনীতি আমরা চাই না।
অমিত বণিক. উন্নয়ন কর্মী, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ।