শিরোনাম
বুধবার, ৪ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

মমতার আকস্মিক সফরের উদ্দেশ্য কী

কামাল লোহানী

মমতার আকস্মিক সফরের উদ্দেশ্য কী

এক খালেদা জিয়ার জ্বালায় অস্থির বাংলাদেশ, তাতে আবার 'মমতা দোসর'। পশ্চিমবঙ্গের বিতর্কিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় এলেন 'হাওয়াই হামলা' করার উদ্দেশ্য নিয়ে, সঙ্গে আনলেন তাদেরই যাদের তিনি নিজ হাতে 'রাজনীতির কুশীলব'-এর মেকআপ দিয়েছেন। ভাবখানা অনেকটা 'এলেন, জয় করলেন চলে গেলেন।' কতটা জয় করলেন তার হদিস মিলবে খুব শিগগিরই। সামনের লোকসভা অধিবেশনে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মজিয়ে গেলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, মন্ত্রী-সান্ত্রীদের। বিভিন্ন টকশোতেই তা তারা গ্যালগ্যালা ভাব নিয়ে প্রকাশও করেছেন। মনে হচ্ছে তাদের কথায় মমতা আর যাই করুন না কেন সবাইকে কথায় টেক্কা দিয়ে গেছেন, ফলে তারা হয়তো মমতার কথায় সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত এবং তিস্তায় 'বানভাসি'র আভাস পেয়েছেন। তা ছাড়া দেশের নেতৃবৃন্দ হয়তো ভাবছেন কমিউনিস্টবিরোধী মমতা তো পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ৩৪ বছর বয়সী সরকারকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতায় চড়ে বসেছেন, 'জনপ্রিয় নেত্রী' হিসেবে মার্কিন মদদ পেয়েছেন। শুধু কি তাই, সারদা অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-এমপিদের সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে উচ্চারিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের জামায়াতকে অর্থায়ন এমনকি বাংলাদেশের সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতায় তার নামও উচ্চারিত হওয়ায় তার ইমেজ এই বাংলাদেশে যা তৈরি হয়েছিল, তা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আবার তিস্তা চুক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করে ২০১১ সাল থেকে আমাদের দেশের সব মানুষের কাছে সমালোচিত হয়েছেন। কারণ তারই প্রিয়ভাজন নেতা ইমরান জামায়াতে ইসলামীর নামে এই অর্থ কেলেঙ্কারি এবং জামায়াত যোগাযোগের হোতা। তাকেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সফরসঙ্গী হিসেবে আনতে চেয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে ওকে বাদ দিয়ে আরেকজন মুসলিম সদস্যকে দলে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সেই সদস্য তেমন প্রাধান্য অবশ্য পাননি। পেয়েছেন নায়ক প্রসেনজিৎ, দেব, অভিনেত্রী মুনমুন সেন, গায়ক ইন্দ্রনীল প্রমুখ। তবে সম্প্রতি বামফ্রন্ট ছেড়ে আসা কবি সুবোধ সরকারের কদর মমতার কাছে বেশ একটু বেশিই। কারণ এই কবি সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে গলিত ভাষায় গালমন্দ করতে পারছেন। এটা আবার মমতার বেজায় পছন্দ। উপরে সিনেমা জগতের কুশীলবদের নামোল্লেখ করেছি কিন্তু নাট্য জগতেরও একজন মন্ত্রী হয়েছেন, তিনিও এসেছিলেন। নাম তার ব্রাত্যবসু। তবে ব্যবসায়ীদের দু-চারজনকে বোধহয় সঙ্গে এনেছিলেন। তার মধ্যে একজন তো ঢাকা থেকে কলকাতা ফিরে বিমানবন্দরেই মামলার কারণে গ্রেফতার হয়েছিলেন। মমতার সাক্ষী ছিলেন বলেই আবার রেহাই পেয়েছেন জামিনে। কবি, গায়ক, নায়ক, নায়িকা, নাট্যজনদের নিয়ে গঠিত সফরকারী দলের আগমনে শুনলাম সংস্কৃতিজনদের সঙ্গে মমতার বেশ কবারই দেখা হয়েছে। তবে সাংবাদিকদের তিনি এড়িয়ে গেছেন, কোনো সংবাদ সম্মেলন করার 'সাহস' তিনি দেখাননি। কলকাতা ছাড়ার সময় নাকি ওখানকার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কলকাতায় আপনাদের বললে ঢাকায় তাহলে কী বলব? আবার ফিরেও কলকাতায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু মমতা কেন ঢাকার সাংবাদিকদের এড়িয়ে গেলেন? এর পেছনে রহস্য বোধহয় একটাই, তা হলো ঢাকার সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলতেন। কী কথা বলতেন? কোন কথায় ফেঁসে যাবেন, এসব ভেবেই তিনি বেশ সতর্কতার সঙ্গে সামলে নিয়েছেন বিষয়টি। বাংলাদেশ সরকারও বোধহয় সংবাদ সম্মেলনের ব্যাপারে কোনো জোর দেয়নি। কূটনৈতিকভাবে তারাও এড়িয়ে গেছে। তাজ্জব হলাম, যে মমতাকে নিয়ে এত কথাবার্তা, তর্কবিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা এবং এই বাংলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী এবং উত্তরাঞ্চলীয় জনগণের দুর্ভোগের কারণ যিনি, তাকে কেন এভাবে ছেড়ে দিল বাংলাদেশ?

ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশে এলেন, তার শ্বশুরালয়ে গেলেন স্মৃতিতর্পণে এবং যোগ দিলেন সরকারের নানা অনুষ্ঠানে, সংবর্ধনায়। এমন অতিথি এলে সাধারণত তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার সূচিতে থাকে। প্রণব বাবুর সফরে বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাক্ষাৎকারও প্রোগ্রামে ছিল কিন্তু খালেদা জিয়া তাদের ডাকা হরতালের অজুহাতে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ করেছিলেন। কারণ বোধহয় প্রণব বাবু কংগ্রেসের নেতা ছিলেন এবং কংগ্রেস আওয়ামী লীগের বন্ধু। আর প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘনিষ্ঠ মিত্র। আবার যখন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিরোধীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে কংগ্রেসের নেতা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকায় এলেন তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা মনমোহনের সফরসঙ্গী হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে মমতা ব্যানার্জি বেঁকে বসলেন। প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য ছিল তিস্তাচুক্তি যেন না হতে পারে। তিনি তার প্রধানমন্ত্রীকে অপমানিত করে 'বেমক্কা' পরিস্থিতিতে ফেলতে দ্বিধা করলেন না। তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না দিলে আমাদের উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ একর জমি চাষ করা যাবে না, মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা সংকট দেখা দেবে- তাতে এতটুকু হৃদয়স্পর্শ করেনি মমতার; সেই মমতা হঠাৎ সদলবলে একাই বাংলাদেশ সফরে এলেন।

মমতা ব্যানার্জির আসার খবরে আমরা দেশবাসী খুব একটা খুশি হতে পারিনি। এমন সময় তিনি বেছে নিয়েছিলেন যে দিনগুলো ছিল ১৯, ২০, ২১ ফেব্রুয়ারি। তার কর্মসূচি শুনলাম মাঝরাতে তিনি যাবেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, শহীদ মিনারে মমতা গিয়েছিলেন সদলবলে, শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন ভাষা শহীদদের প্রতি। সংস্কৃতিজনদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটিও তিনি গেয়েছেন। একটি অনুষ্ঠানে মমতা সঞ্চালক হয়ে গিয়েছিলেন। ছিলেন বোধহয় সোনারগাঁও হোটেলে। তিনি উদ্বিগ্ন রেখেছিলেন নিরাপত্তা কর্মী ও সদস্যদের, কারণ হোটেলের সামনের খোলা জায়গায় তিনি পায়চারি করছিলেন যেটা তার স্বভাব। সভামঞ্চেও এই চঞ্চলতা লক্ষণীয়।

এ ধরনের অস্থিরচিত্ততা এবং গান গাওয়া আর কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি উপস্থিত জনগণকে মুগ্ধ করতে চেয়েছিলেন, পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে। কেউ তাকে বিব্রত করেনি তার অতীত অবস্থানের হঠাৎ পরিবর্তনে। তবে সবাই বোধহয় বুঝতে পেরেছেন, মোদি সরকার তার চেয়েও একগুঁয়ে এবং নিজেদের কৃতিত্ব ও সুসম্পর্ক প্রতিবেশীর সাথে বজায় রাখতে সামনের পার্লামেন্ট অধিবেশনে তিস্তার চুক্তি নিয়ে প্রণীত খসড়া উপস্থাপন করে পাস করিয়ে নেবেন, এটা প্রায় সুনিশ্চিত। ফলে মমতা তার কৌশল বজায় রাখার জন্য তার আগেই বাংলাদেশে এসেছিলেন তার ক্ষতিগ্রস্ত 'ইমেজ'টাকে মেরামত করতে। ২০১৬ সালে তার নির্বাচন। সুতরাং দুশ্চিন্তা তো কম নয়। কারণ তার নিজের দলেই অন্তর্কলহ এবং প্রচণ্ড বিরোধিতা ও ভাঙনের সুর বাজতে শুরু করেছে। তবে মমতা তার মনমোহিনী শক্তি দিয়ে কেউ বিরুদ্ধে গেলেও আবার ভজিয়ে ফেলেন। যেমন, মহাশ্বেতা দেবী কিংবা কবীর সুমন জাতীয় লোকেরা। এরা তো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, সে ক্ষেত্রে কী অবস্থা মমতার? ওইখানেই তার চিন্তা। তিনি কিন্তু তার চঞ্চল চরিত্রের আচরণ দিয়ে মনের দুঃখ ঢেকে রাখেন এবং জিঘাংসা মনে মনেই পুষে রাখেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিদির ক্যারিশমা কীভাবে টিকিয়ে রাখবেন, যখন দলের ভিতর যে লড়াই তার একনায়কসুলভ আচরণে, তার তো প্রমাণ মিলেছে বিগত নির্বাচনে। তিনি দলের তোয়াক্কা না করে এলাকার নেতা-কর্মীদের ইচ্ছাকে দমন করে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের বেশি পাত্তা দিয়ে জিতিয়ে এনেছেন। কারণ এদের জনপ্রিয়তা আছে। দলের জনপ্রিয়তায় তা কাজে লাগবে। কিন্তু উল্টো হয়েছে। এরা তো সিনেমার নটনটী, ব্যবসা বা উপার্জনের পথ খুঁজতেই নিজের যোগ্যতা নিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তারা কি নিজেদের রমরমা ব্যবসা রেখে 'ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক জীবন' গ্রহণ করবেন? নাকি মমতাও লোক সাধারণকে বোকা বানানোর চেষ্টায় ঢালাওভাবে ওদের দলে ভেড়াচ্ছেন?

আমার অন্যরকম মনে হচ্ছে, তিনি বোধহয় এখন আমাদের দিকে সতর্কতার সঙ্গে নজর দিচ্ছেন এ জন্য যে, মুসলিম ভোটাররা ভাববেন, মমতা প্রতিবেশী 'মুসলিম' দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুললেন। এ ভাবনা পরবর্তী নির্বাচনে কাজে লাগবে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সম্ভবত ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো। সেটাকেও ঝালাই করে গেলেন বোধহয়। একটা জিনিস পরিষ্কার, তিনি নিজে তো বলবেন না সারদা কেলেঙ্কারির কথা, কিংবা বর্ধমান বোম-ব্রাস্টের খবর; কিন্তু বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বাংলাদেশের জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত তৃণমূল ও তার নেত্রীকে হাতে পেয়েও ওই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রসম্পৃক্ত বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না কেন? নাকি সরকার চায়নি এই 'অতিথি'কে বিব্রত করতে? যদি তাই হবে তাহলে তাকে নেমন্তন্ন করে আনলেন কেন? কী লাভ হলো, তা পরিষ্কার হবে কদিন বাদেই। তবে মমতা তার রাজনীতিতে জিতে গেলেন। আমাদের কোটে এসে হাডুডু খেলে গেলেন, কাউকে মারলেন কিনা জানি না তবে তিনি এতবড় অপরাধ (তাও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে) কাঁধে নিয়েও নির্বিঘ্নে 'চাক্মা' দিয়ে চলে গেলেন।

কপটতার কতটা চূড়ান্ত তিনি দেখালেন যে, ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে সাংবাদিকদের ডেকে বললেন, 'আমার মনে হচ্ছে আমি নিজের দেশেই এসেছি।' নিজের দেশ যদি ভেবেই থাকেন তবে কোনো সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতি বা কমিটমেন্ট করলেন না কেন?... নাকি মোদি সরকার আঞ্চলিক 'রাষ্ট্রীয় শক্তিবলয়' সৃষ্টি ও নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশের সঙ্গে যদি সীমান্ত আর ছিটমহল বিরোধ মিটিয়ে ফেলে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব ওই তিস্তার পানিচুক্তি স্বাক্ষর করেই ফেলে, তার কৃতিত্ব যেন হাতছাড়া না হয়, এ সফর বুঝি তারই আগাম নমুনা। তা ছাড়া তিনি তিস্তা নিয়ে কোনো হ্যাঁসূচক ইঙ্গিত দেননি, আস্থা রাখতে বলেছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। আমরা কোনো কমিটমেন্ট আদায় করতে পারলাম না।

মমতার আকস্মিক 'ইলিশপ্রীতি' হয়তো মিটেছে, তবে আমাদের আকাঙ্ক্ষা যে মিটেনি এটা বলতে পারি। এবার আমাদের তাকিয়ে থাকা মোদির আসন্ন সফর এবং আগামী লোকসভা অধিবেশনের দিকে। বেচারা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় খুব একটা আশাবাদ প্রকাশ করতে পারেননি। মমতার গণ্ডিইবা কতটুকু? বোধ হয় আমাদের ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারছেন। অবশ্য সাংস্কৃতিক বিনিময় নিয়ে কিছু কথা হয়তো বলেছেন তারা সে তো আছেই, চলছে। কিন্তু টেলিভিশন সম্পর্কে কোনো পজিটিভ কিছুই বলেননি। এই চতুরালির প্যাঁচে পড়ে ভাবতে হবে কী পেলাম।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

 

সর্বশেষ খবর