শনিবার, ৭ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

সেদিন যেভাবে মঞ্চে উঠেছিলাম

জিল্লুর রহিম দুলাল (বীরপ্রতীক)

সেদিন যেভাবে মঞ্চে উঠেছিলাম

৭ মার্চ বাংলাদেশের ও বাঙালির জীবনের এক গৌরবময় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্সে দিয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক ভাষণ। এ ভাষণেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপরেখা চূড়ান্ত করেছিলেন, দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। সেই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত হয়ে বাঙালি যুদ্ধ করেছে, আমাদের মুক্তিসংগ্রাম সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। একাত্তরের নয় মাস বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের উদ্দীপনাকে স্মৃতিতে ও শ্রুতিতে ধারণ করেই মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ যুদ্ধ করেছেন, স্বাধীন করেছেন এই বাংলাদেশকে। আমার সৌভাগ্য ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক দিনে, ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম রেসকোর্সের সেই মঞ্চে, বঙ্গবন্ধুর একেবারে পাশেই। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় সেই দিনটি, আমার শ্রেষ্ঠ অহংকারও।

সেই দিনটি ছিল উত্তেজনায় ভরপুর। ইয়াহিয়া খান গণপরিষদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণার পরপরই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ব বাংলা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতির সব সূত্রই ছিন্ন হয়ে যায় ইয়াহিয়ার সেই ঘোষণায়। রাস্তায় স্লোগান ওঠে- 'লাথি মারো পাকিস্তান, গাও বাংলার জয়গান'। শুরু হয়ে যায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন। ঘটনা খুব দ্রুতগামী হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উড্ডীন হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির মহড়া চলতে থাকে সর্বত্র। এ পরিস্থিতিতে ঠিক হলো বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন। রেসকোর্সের নাম তখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়নি।

সবার উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষা সেই দিন, সেই ক্ষণের জন্য। বঙ্গবন্ধুর ওপর তখন নানামুখী চাপ। পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্র তো ছিলই, স্বাধীনতাকামী বাঙালির আকাঙ্ক্ষার চাপও ছিল প্রবল। এসব সামলে নিয়ে তিনি রেসকোর্সে কী ঘোষণা দেবেন- এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। বাঙালিরা চেয়েছিল তিনি তৎক্ষণাৎ স্বাধীনতার ঘোষণা দিন। অনেকের মনে হচ্ছিল তার ঘোষণাতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু দীর্ঘদিনের রাজনীতির অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ বঙ্গবন্ধু ঠিকই জানতেন তার করণীয়। পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে কীভাবে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হয় তা তার অজানা ছিল না। তার নিজের দলের মধ্যেও তাৎক্ষণিকভাবে চরমপন্থা অবলম্বনের চাপ ছিল। এ পরিস্থিতিতে সবাই মুখিয়ে ছিলেন ৭ মার্চের ঘোষণা শোনার জন্য।

সেদিন সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথ ছিল স্লোগানে-মিছিলে মুখর। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'- এ স্লোগান দিতে দিতে সবাই মিছিল করে সমবেত হচ্ছিল রেসকোর্সে। দুপুরের আগেই ভরে গেছে সেই উদ্যান। স্মরণাতীতকালের ইতিহাসে এমন জনসমাগম আর কোথাও ঘটেনি- এ তথ্য দিয়েছিল বিবিসি। ঢাকা নয়, সমগ্র বাংলাদেশই তখন বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা শোনার জন্য চরম উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে। বাংলার শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে বেতারের সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেদিন বেতারে অবশ্য প্রচারিত হয়নি পাকিস্তানি শাসকদের নিষেধাজ্ঞার কারণে। প্রতিবাদে বেতার ও টেলিভিশনের কর্মীরা কাজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন রাস্তায়। সেও এক ইতিহাস।

আমি তখন পুরান ঢাকায় থাকি, পড়ি কলেজে। বাংলাদেশের সব তরুণের মতো আমার মনেও তখন বিদ্রোহের বহ্নি- চোখে স্বপ্ন স্বাধীন দেশের। কোনো বিশেষ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ছিলাম না, কিন্তু ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সত্তরের নির্বাচন- এসব ঘটনা আমাকে রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষার যে জোয়ার তাতে ভেসে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সকালে দেখি আমাদের পুরনো বাড়ি চকবাজারেও চরম উত্তেজনা। প্রসঙ্গত বলে রাখি, চকবাজারে উর্দুভাষীদের (বিহারি নয়) প্রাধান্য। ভাষা আন্দোলনের সময় এ এলাকার কিছু কিছু উর্দুভাষী এ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তারপর ২৪ বছর কেটে গেছে। ঢাকার উর্দুভাষীরাও তত দিনে বুঝে গেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া কারও মুক্তি হওয়ার নয়।

আমি চকবাজার থেকে বের হলাম রেসকোর্স উদ্যানের দিকে। মিছিলের পর মিছিল চলেছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে। আমিও মিশে গেলাম সেই মিছিলের একটিতে। যৌবনের সব শক্তি দিয়ে স্লোগান দিলাম- 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ'। স্লোগানমুখর সেই মিছিলের সঙ্গে কখন যে পেঁৗছে গেলাম মুক্তির সেই তীর্থভূমিতে বুঝতেই পারিনি। রেসকোর্সে তখন চলছে শিল্পীদের গণসংগীত, মাঝে মাঝে মুহুর্মুহু স্লোগান। সবার হাতে মাঝখানে মানচিত্রখচিত লাল-সবুজের পতাকা। আমার তখন একমাত্র লক্ষ্য মঞ্চে ওঠা, বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে তার ঐতিহাসিক ভাষণ শোনা। আমার বয়স তখন নিতান্তই কম। তবু রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হওয়ার কারণে অনেক নেতার সঙ্গেই পরিচয় ছিল। আমি যখন মঞ্চে ওঠার চেষ্টা করি, তখনই সেই নেতাদের সস্নেহ প্রশ্রয় পেয়েছিলাম। কাজটি সহজ ছিল না, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার কথা ভেবে মঞ্চে আরোহণ ইচ্ছুকদের প্রতি বেশ কড়া নজর রাখছিলেন। কিন্তু আমি অদম্য হয়ে উঠেছিলাম মঞ্চে ওঠার জন্য। মঞ্চে শেষ পর্যন্ত উঠলাম রাজ্জাক ভাইয়ের সহযোগিতায়। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা আধিকারিক মহিউদ্দীন ভাইও আমাকে চিনতেন।

সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু এলেন। চারদিক থেকে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে স্লোগান উঠল- 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বংলাদেশ স্বাধীন করো'। আমি দাঁড়ালাম তার বাঁ দিকে, মহিউদ্দীন ভাইয়ের কাছঘেঁষে। বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন মাইক্রোফোনের সামনে, আবেগঘন কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন- 'ভায়েরা আমার আপনারা সকলই জানেন এবং বোঝেন, আজ বড় দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি...'। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের ইতিহাস আজ সবারই জানা। তার ভাষণে আবেগ ছিল, দুঃখ ও বেদনা ছিল যেসব মানুষ স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকারের সামরিক বাহিনীর হাতে ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের জন্য। কিন্তু এসবকে ছাপিয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার আহ্বান। বক্তৃতার শেষ দিকে তিনি বলে উঠলেন- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা'। জয় বাংলা বলেই তিনি তার বক্তৃতা শেষ করেছিলেন। খন্দকার সাহেবের ভাষ্যানুযায়ী 'জয় পাকিস্তান' বলে নয়। আমি সেই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষ ও নিকট সাক্ষী, তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শোনার পর আমার কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছিলাম। প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেব। তাই ২৫ মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বাংলাদেশ ও বাঙালির ওপর চরম নৃশংসতায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি। যোগ দিলাম মুক্তিযুদ্ধে। ৭ মার্চের ভাষণের অনুপ্রেরণা ছিল বলে নির্ভীক মনে যোগ দিলাম ক্র্যাক প্লাটুনে। সে আরেক ইতিহাস।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।

 

 

সর্বশেষ খবর