শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

মান্না ভাইয়ের কিশোরী মেয়েটির জন্য!

গোলাম মাওলা রনি

মান্না ভাইয়ের কিশোরী মেয়েটির জন্য!

আমার পোড়া চোখ আর অবুঝ মনকে নিয়ে হয়েছে যত্তসব জ্বালা। সামান্য দৃশ্য দেখলেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ে আর সমানতালে হৃদয়ের রক্তক্ষরণও হতে থাকে একইভাবে। এ নিয়ে আপন পরিবারে প্রায়ই আমি ঠাট্টা-মশকরার শিকার হই। টেলিভিশনে কোনো ভালো নাটকের আবেগঘন দৃশ্য আসার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে-মেয়েরা সুর করে বলবে, এই তোমরা সবাই চুপ কর! আমাদের বোকা বাবা এখনই কেঁদে দেবে। আমি বালক-বালিকাদের কথা শুনে মুচকি হাসার চেষ্টা করি। তারপর ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করে বসি অর্থাৎ কেঁদে দিই। আমার সেই অসহায় অবস্থা দেখে ওরা যে কী মজাটাই না পায় তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। নিজের এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতার জন্য আমি ইদানীং সপরিবারে টিভি নাটক, সিনেমা, বিয়েবাড়ির কন্যা বিদায়ের অনুষ্ঠান, মৃত ব্যক্তির কবরযাত্রা এবং অত্যাচারিত ব্যক্তির হাহাকারসংক্রান্ত দৃশ্য এড়িয়ে চলি। এভাবেই চলছিল বেশ। কিন্তু ৭ মার্চ রাতের একটি খবরের দৃশ্য দেখে পুরনো রোগটি আবার পেয়ে বসল। খবরে দেখলাম রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্নার কিশোরী মেয়েটি ঢাকার সিএমএম কোর্ট চত্বরে বহু মানুষের মধ্যে গড়িয়ে ইয়াতিম এবং অসহায়ের মতো ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে জনাব মান্না সম্পর্কে কিছু বলে নিই।

মান্না ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় মূলত আওয়ামী লীগ করার কারণে। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য হই মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, নেত্রী তাকে খুবই ভালোবাসতেন এবং দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ১/১১-এর কারণে জনাব মান্না আওয়ামী লীগের আরও অনেক রথী-মহারথীর মতো ক্ষমতার রাজনীতি থেকে দূরে ছিটকে পড়েছিলেন। কিন্তু দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তায় তেমন হেরফের যে হয়নি তা আমি বুঝেছিলাম ২০০৮ সালের গোড়ার দিকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের একটি অনুষ্ঠানের কল্যাণে। নেত্রী তখন কানাডায়। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের বড় অডিটোরিয়াম তখন কানায় কানায় পূর্ণ। আমি এবং সাভারের মুরাদ জং পাশাপাশি বসে অনুষ্ঠান দেখছিলাম। সংস্কারবাদী বলে অভিযুক্ত কেউ সেদিন সভাস্থলে আসতে পারেননি কেবল মান্নান ভাই অর্থাৎ কালা মান্নান এবং মান্না ভাই ছাড়া। মান্না ভাই যখন বক্তব্য দিতে উঠলেন তখন সমবেত নেতা-কর্মীরা তাকে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে স্বাগত জানাল এবং তার হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য শুনে বার বার হর্ষধ্বনি দিয়ে বক্তব্য দীর্ঘায়িত করার জন্য আওয়াজ তুলতে লাগল।

২০০৯ সালের পর মান্না ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো টেলিভিশনের টকশো, সভা-সমিতি, সেমিনার এবং পত্রপত্রিকার অফিসগুলোয়। বয়সের ব্যাপক ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও মূসা ভাই-মান্না ভাই অনেক কথাই গল্পচ্ছলে আমাকে বলতেন। তাদের স্মৃতিজুড়ে থাকা নানা প্রসঙ্গের বেশির ভাগই ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে, তাদের নানা কর্মকাণ্ড, সুখময় সময় এবং আস্থা ও বিশ্বাসের পর্বগুলো। তারা নেত্রীর সঙ্গে তাদের সুসম্পর্কগুলো স্মরণ করে তৃপ্তি পেতেন এবং লোকজনকে সে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আমি একদিন বলেই ফেললাম, তাহলে দলের সঙ্গে আপনাদের এত দূরত্ব হলো কেন। তারা অবিশ্বাস্য শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে হাসলেন এবং ততোধিক সরলতা নিয়ে বললেন, রনি সুখের সময়গুলোতে যেমন বুঝতে পারিনি কেন নেত্রী আমাদের এত ভালোবাসেন, নির্ভর করেন এবং স্নেহ করেন তেমনি এখনো বুঝতে পারছি না কেন তিনি এতটা ঘৃণা করেন। তিনি তো কোনো দিন ডেকে একবারও বললেন না এই কারণে তোমাদের অপছন্দ করলাম!

আরেক রাতের ঘটনা। অনুষ্ঠান শেষে আমরা বাংলাভিশন টিভির লিফটের গোড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। সেদিন মূসা ভাই খুব কড়া কড়া কথা বললেন। সেই প্রসঙ্গে মান্না ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ওরে বাপরে। মূসা ভাইয়ের মতো আমার অত সাহস নেই। তা ছাড়া উনার বয়স ৮০ বছরের বেশি হয়ে গেছে। ফলে উনার মরার ভয়ও অন্য রকম। আমি বাঁচতে চাই, আরও বহুদিন বাঁচতে চাই। চলনে-বলনে মান্না ভাই খুবই সাদাসিধে হলেও আত্দমর্যাদার বিষয়ে ছিলেন একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ, যাকে আমরা সরল বাংলায় নাক উঁচু প্রকৃতির বলে থাকি। উপযাচক হয়ে কোথাও যেতেন না, কারও কাছে নিজের অভাব, প্রয়োজন কিংবা ভালোলাগা-মন্দলাগার বিষয়গুলো শেয়ার করতেন না। কেউ প্রশ্ন করলে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেন না। এমনকি ঘরোয়া আড্ডায়ও প্রশ্ন করলে উত্তর দিতেন, না হয় চুপচাপ থাকতেন। তার ভাবসাব দেখে মনে হতো তিনি তার চারপাশের লোকজন সম্পর্কে তেমন খোঁজখবর রাখেন না। অন্যদিকে তার সম্পর্কে লোকজন কতটুকু জানে তাও হিসাব করতেন না। তবে তার একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং ঢাকায় সিটি নির্বাচন করলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র হতে পারবেন।

মান্না ভাইয়ের আরেকটি অভ্যাস ছিল সচরাচর কাউকে ফোন না করা। তবে তাকে কেউ ফোন করলে তিনি ফোন ধরতেন এবং নিশ্চিন্ত মনে কথা বলে যেতেন ফোনকারীর আবেগ ও ইচ্ছা অনুযায়ী। তার কাজকর্মও ছিল অনেকটা অগোছালো প্রকৃতির। নিজের চাপা স্বভাবের কারণে তার স্ত্রী বা পরিবারের আপনজন তার কাজকর্মের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানত বলে আমার মনে হয় না। নাগরিক কমিটি, ড. কামাল, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, আসিফ নজরুল, নূরুল কবীর প্রমুখের সঙ্গে তার সম্পর্কগুলো মনে হতো ফেস বাই ফেস। অর্থাৎ একটি বিশেষ পথসভা, সেমিনার বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে তারা মাঝেমধ্যে জনসম্মুখে একত্রিত হতেন বটে কিন্তু কোনো কমন ইন্টারেস্ট, রাজনৈতিক স্বার্থ বা পরিকল্পনা নিয়ে তারা একত্রে পথচলা তো দূরের কথা নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনাটুকুও করেননি। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো আমি না জানলেও তাদের চলাফেলার ধরন দেখে আমার তা-ই মনে হতো।

একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষাপটে মান্না ভাইকে আমি একান্ত কাছ থেকে দেখার এবং বোঝার সুযোগ পাই। একদিন তিনি হঠাৎ করেই আমাকে ফোন করে জানতে চাইলেন আমি অফিসে আছি কি না। এরপর তিনি অফিসে চলে এলেন। হাতে একগাদা কাগজ। বললেন, বহু আগে ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বগুড়ায় একটি কোল্ডস্টোরেজ করেছি। লাভ তো দূরের কথা এখন মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে গেছে। মূলত একজন পার্টনারের উৎসাহে ব্যবসাটি শুরু করেছিলাম। কোনো দিন কাগজপত্র দেখিনি। যখন যেভাবে বলেছে সেভাবেই স্বাক্ষর করেছি। পার্টনারই ব্যবসা-বাণিজ্য দেখত। সম্প্রতি খবর পেলাম সে গোপনে আরেকটি কোল্ডস্টোরেজ কিনেছে। এ অবস্থায় আমার কী করা উচিত কিংবা কোম্পানিতে আমার আইনগত অধিকার কতটুকু তা বোঝার জন্য তোমার পরামর্শ দরকার। আমি হেসে বললাম, আমি তো প্রাকটিসিং ল ইয়ার নই! তা ছাড়া অনেক নামকরা আইনজীবীর সঙ্গে তো আপনার পরিচয় রয়েছে। তিনি বললেন, আমি বিষয়টি এ মুহূর্তে কারও সঙ্গে শেয়ার করে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। কথাবার্তায় মনে হয়েছে তোমার লিগ্যাল কনসেপ্ট এবং জুডিশিয়াল মাইন্ড অনেকের চেয়ে ভালো। তাই বিষয় সম্পর্কে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করে আমি বুঝতে চাচ্ছি কাগজপত্রে আমার অধিকার বা দায়দায়িত্ব কতটুকু। আমি সবকিছু দেখলাম এবং বোধবুদ্ধি অনুযায়ী পরামর্শ দিলাম। এ বিষয় নিয়ে আরও দু-তিন বার মান্না ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আলোচনার সময় লক্ষ্য করলাম তিনি কিছুতেই প্রসঙ্গের বাইরে যেতে চান না। আমি চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগ, কিংবা দলটির কোনো নেতা-কর্মী সম্পর্কে তার কোনো মন্তব্য বের করতে পারলাম না। নিতান্ত ভদ্রভাবে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললেন, ওসব প্রসঙ্গ থাক না! আমার কারোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

মান্না ভাইয়ের সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয় সেদিন বেলা ১১টার দিকে যেদিনের আগের রাতে তার টেলিফোন সংলাপটি ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বুঝলাম তিনি বিষয়টির জন্য তেমন চিন্তিত কিংবা অনুতপ্ত নন। কেবল জিজ্ঞাসা করলেন আচ্ছা রনি! সরকার কি আমাকে গ্রেফতার করবে? আমি আন্দাজে বললাম সম্ভবত করবে না। আন্দাজ হলেও আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি নিশ্চয়ই কিছু যুক্তি খুঁজে পেয়েছিল। প্রথমত, আমি কোনো দিন প্রধানমন্ত্রীকে একান্ত আলাপচারিতায় মান্না ভাই সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলতে শুনিনি। দ্বিতীয়ত, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, কেউ যদি তাকে মান্না-খোকার টেলিফোনের অডিওটি শোনাতেন তাহলে প্রথমে তিনি এক দফা হাসতেন এবং পরে তা ময়লার বাক্সে ফেলে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতেন।

যে রাতে মান্না ভাই গ্রেফতার বা নিখোঁজ হলেন সে রাতের সন্ধ্যাবেলায় সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইনগুলোর খবর এবং টেলিভিশনের টকশোর ধরন দেখে মনে হলো হায়রে মিডিয়া! বিষয়টিতে কিছু স্পর্শকাতরতার ছোঁয়া লাগিয়ে এমনভাবে প্রচার-প্রপাগান্ডা করা হলো যাতে কর্তৃপক্ষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল মান্না প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া। আমি আশঙ্কা করলাম তিনি হয়তো শিগগিরই গ্রেফতার হবেন। সকালে উঠে খবর পেলাম, মান্না ভাই নিখোঁজ। বর্তমানে তিনি ডিবির হেফাজতে রিমান্ডে আছেন এবং বিষয়টি বিচারাধীন বলে এ ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগত কোনো মতামত দিচ্ছি না।

তবে তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর তার আশপাশের নিকটজনের যে চরিত্র আমি দেখলাম তাতে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। আদালত প্রাঙ্গণে আমার মেয়েটির প্রায় সমবয়সী মান্না ভাইয়ের মেয়েটির কান্নার দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো এই বিপদের দিনে আমার উচিত মিসেস মান্না বা তার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে একটু কথা বলা। আমার বিপদের সময় যেসব মানুষ আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন কিংবা যেসব মানুষ কথা বলেননি তাদের সম্পর্কে আমার হৃদয়ে স্থায়ী একটি মানচিত্র তৈরি হয়ে গেছে। জেলখানায় বসে যখন শুনতাম, অমুক ফোন করেছিল তখন মনে হতো আমি হয়তো বেঁচে আছি। অন্যদিকে যখন শুনতাম, অমুকে ফোন ধরেনি তখন বেঁচে থাকার সার্থকতা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়তাম। মিসেস মান্নার ফোন নম্বরের জন্য প্রথমেই ফোন দিলাম তার এক রাজনৈতিক শিষ্যের কাছে। এরপর দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ এক অধ্যাপকের কাছে। তারা আমার কথা শুনে এমনভাবে অাঁতকে উঠলেন যাতে মনে হলো হয়তো আজরাইল (আ.) তাদের হলকমে হাত রেখেছেন। তারা টেলিফোনে মান্না নামটি উচ্চারণ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। তড়িঘড়ি করে লাইন কেটে দেওয়ার আগে শুধু এটুকু বললেন যে, তারা জনাব মান্না সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তবে একজন ছোট্ট করে একটি এসএমএস দিয়ে বললেন, হয়তো সুলতান মোহাম্মদ মনসুর জানতে পারেন।

আমি আর কাউকে ফোন দিইনি। ফোন দেওয়ার মতো রুচি হয়ে ওঠেনি। মনের গহিন থেকে বার বার নাড়া দিচ্ছিল ঘটনার দিনের সাত-আট সেকেন্ডের ছোট্ট ভিডিও ফুটেজটি। দ্বিতীয় দফা রিমান্ডের আবেদন করার জন্য পুলিশ সেদিন জনাব মান্নাকে কোর্টে নিয়ে গিয়েছিলেন। শখানেক পুলিশ তাকে কর্ডন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দুজন সামর্থ্যবান কর্তা পুলিশ শক্ত হাতে জবাব মান্নার দুই হাত দুই দিক থেকে চেপে ধরে এগোচ্ছিলেন গন্তব্যের দিকে আর গ্রেফতার ব্যক্তি মলিন কাষ্ঠহাসি চোখে-মুখে ফুটিয়ে তুলে আশপাশ চাতক পাখির মতো তাকাচ্ছিলেন প্রিয়জনের কোনো প্রতিচ্ছবি দেখার জন্য। পুলিশ বেষ্টনীর বাইরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে। অসহায় ভঙ্গিতে বার বার খোঁজ করছিল বন্দী পিতার প্রতিচ্ছবি। ও সম্ভবত কোনো দিন কোর্টে যায়নি কিংবা তার পিতার ওমন পরিণতি কোনো দিন কল্পনা করেনি। ও হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল পিতাকে নিয়ে তার ছোটবেলার মধুর স্মৃতিগুলো। কথায় কথায় ও হয়তো পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আবদার করত। আবার কখনোসখনো গাল ফুলিয়ে অভিমান করত। হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক দিন হয়তো পিতার বুকে তার মাথা রাখা হয়নি কিংবা রাতদিন বাইরে থাকার কারণে পিতার প্রতি তার একটি বিশেষ অভিমানও ছিল। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হয়তো ভাবছিল, আহা! বাবা যদি আজ মুক্তি পেত তাহলে সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদত আর বলত, আমার সোনা বাবা! আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।

বিচ্ছিন্ন চিন্তা নিয়ে কিশোরী মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন পিতার জন্য অপেক্ষা করছিল ঠিক তখনই পুলিশবদ্ধ হয়ে জনাব মান্না চলে যাচ্ছিলেন। মেয়েটি মুখ দিয়ে কিছু বলছিল কি না তা আমি শুনতে পাইনি। কিন্তু পিতাকে দেখার পর সে যে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলাম। সে পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে সামনে এগিয়ে পিতাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। জনাব মান্না বেকুবের মতো ফ্যালফ্যাল চোখে কন্যার দিকে তাকাতে চেষ্টা করলেন। তারপর চেষ্টা করলেন একটি হাত পুলিশমুক্ত করে কন্যাকে পিতৃস্পর্শ দেওয়ার জন্য। কিন্তু পারলেন না। কিশোরী মাথা নিচু করে শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে অনেকটা বেপরোয়া গতিতে হাত বাড়িয়ে দিল পিতার হাতটি একটু ছোঁয়ার জন্য। কিন্তু সে পারল না। কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ অনাহূত কিশোরীকে সরিয়ে দিল। মান্না কী যেন বলতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। তিনি আসমানের দিকে তাকালেন। অন্যদিকে, কিশোরীটি প্রত্যাখ্যাত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তার সেই ছোট বালিকা বেলার মতোন করে গাল ফুলিয়ে গোল গোল দুটি চোখ অশ্রুতে ভরে ফেলল এবং মাটির দিকে তাকিয়ে অঝরে বারিবর্ষণ করতে লাগল।

লেখক : কলামিস্ট।

 

 

সর্বশেষ খবর