শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

একাত্তরের এক ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ

প্রফেসর ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস

একাত্তরের এক ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ

অধ্যাপক মজিবুর রহমান দেবদাস

পত্রিকার মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারি এবার একুশে পদকে ভূষিতদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক মজিবুর রহমান দেবদাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর হলেও পাক বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসরদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের জন্য সর্বস্ব হারানো এক অকুতোভয় মানবতাবাদী শিক্ষক একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে স্মরণশক্তিহীন মজিবুর রহমান দেবদাসের কাছে এ স্বীকৃতি আজ মূল্যহীন কিন্তু তার আত্দীয়স্বজন আর সহকর্মীদের কাছে এর মূল্য অপরিসীম। মজিবুর রহমানের সঙ্গে দেবদাস, এমন নামে অনেকেই হয়তো অবাক হচ্ছেন। মজিবুর রহমান ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের এক মেধাবী শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর করাচির সেন্ট্রাল সরকারি কলেজে যোগদানের মাধ্যমে তার অধ্যাপনা জীবনের শুরু। '৬৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ফলিত গণিতে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করে করাচির নাজিমাবাদ কলেজে যোগ দেন। পরে তিনি '৬৭ সালের ১৬ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। আমি তাকে শিক্ষক হিসেবে পাইনি। তিনি ছিলেন আমার অনেক শিক্ষকের শিক্ষক। তাকে একবার দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল ১৯৯৮ সালের আগস্টে গণিত বিভাগে। সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। আর তখনই স্যারদের কাছে শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় তার দেবদাস হয়ে ওঠা ও তার ওপর পাক সেনাদের অত্যাচারের রোমহর্ষক কাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাত্তরের ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের খবরে আতঙ্কিত হয়ে অধিকাংশ শিক্ষকই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে গ্রামে-গঞ্জে আশ্রয় নেন। বিশ্ববিদ্যালয় তখন প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। তবে কয়েকজন শিক্ষক মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ক্যাম্পাসেই থেকে যান। যারা ক্যাম্পাসে থেকে যান তারা হলেন গণিত বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, একই বিভাগের অধ্যাপক মজিবুর রহমান, সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, ফলিত রসায়নের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম, অধ্যাপক অজিত রায় প্রমুখ। অধ্যাপক মজিবুর রহমান ছিলেন চিরকুমার, সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতা, খাঁটি বাঙালি, মানবতাবাদী ও মনেপ্রাণে একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। পাক হানাদার বাহিনী '৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে প্রগতিশীল ও হিন্দু শিক্ষকদের খোঁজ করে। জুবেরী ভবনে অবস্থানরত তিন শিক্ষক অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম, অধ্যাপক অজিত রায় ও অধ্যাপক মজিবুর রহমানকে পাক সেনারা ধরে ফেলে। তারা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে এখানে কোনো হিন্দু শিক্ষক আছে কি না? বর্বর পাক সেনাদের সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পুড়ে ছারখার হচ্ছে তা অধ্যাপক মজিবুর রহমান ভালো করেই জানতেন। তিনি অধ্যাপক অজিত রায়ের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে নিজের বিপদের কথা না ভেবে দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, 'না এখানে কোনো হিন্দু নেই'। পাক সেনাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম ও অধ্যাপক অজিত রায় সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যান। অধ্যাপক মজিবুর রহমান তার পরও ক্যাম্পাসে থেকে যান। ১৪ এপ্রিল সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে একমাত্র হিন্দু হওয়ার কারণে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে পাক সেনারা। তিনি রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। পরদিন গণিত বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে পাক সেনারা বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার ধারকবাহক। তাকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য পাকিস্তানপন্থি অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসায়েন মুক্তিবাহিনীর ভয়ে ভীত ছিলেন। তার ডাকেই পাক সেনারা প্রথমে ক্যাম্পাসে আসে এবং তখন থেকেই ঊনসত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহার নামাঙ্কিত জোহা হলে আস্তানা গাড়ে। পাক বাহিনী তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার ও শহরের বিভিন্ন বাসা থেকে স্বাধীনতাকামী প্রগতিশীল মানুষকে ধরে এনে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র অঙ্গনে মিনি ক্যান্টনমেন্ট বানিয়ে সেখানে দিনের পর দিন মানুষের ওপর চরম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার জন্য মজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। ১০ মে '৭১ তিনি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে এর লিখিত প্রতিবাদ করে সেনাবেষ্টিত ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি পত্রে ইংরেজিতে যা লেখেন তার সারমর্ম হলো : বিশ্ববিদ্যালয় যখন সেনামুক্ত হয়ে তার পবিত্রতা ও মর্যাদা ফিরে পাবে এবং 'বিশ্ববিদ্যালয়' হিসেবে আবার যাত্রা শুরু করবে তখনই তিনি ক্যাম্পাসে ফিরে আসবেন। আরও লেখেন : পাকিস্তানি মুসলমান সেনাবাহিনীর কীর্তিকলাপের প্রতিবাদে আপন নাম পরিত্যাগ করে তিনি বাংলা নাম 'দেবদাস' গ্রহণ করলেন। পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে জীবন বাঁচাতে সংখ্যালঘুদের অনেকে যখন বাবা-মায়ের দেওয়া বাংলা নাম পরিবর্তন করে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন তখন মজিবুর রহমানের এমন সিদ্ধান্তে সবাই অবাক। তিনি ধর্মান্তরিত হননি, বাঙালিত্বকে বুকে ধারণ করে বাবা-মায়ের দেওয়া নামের ভাবার্থ ঠিক রেখে বাংলা নাম দেবদাস গ্রহণ করেছিলেন। মজিবুর রহমানের বাংলা ভাবার্থ হচ্ছে দেবদাস। আসলে এটা অবাঙালি হানাদার বাহিনীর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক বাঙালির ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ, যা তাদের প্রতি তার চরম ঘৃণারই বহিঃপ্রকাশ। এ সংবাদ পাক সেনা কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছানো মাত্রই তারা ১২ মে অধ্যাপক মজিবুর রহমানকে তারই সহকর্মী অধ্যাপক সুব্রত মজুমদারের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি তখন ক্যাম্পাসের পূর্বপাড়ায় সুব্রত স্যারের রেখে যাওয়া ফ্ল্যাটে থাকতেন। রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রেখে প্রায় চার মাস বৈদ্যুতিক শক দিয়ে, রড দিয়ে পিটিয়ে, চোখের কোনায় সুচ ঢুকিয়ে নানাভাবে তার ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। একসময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। পাক সামরিক শাসকের সাধারণ ক্ষমার পরিপ্রেক্ষিতে ছাড়া পান '৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ছাড়া পেয়ে তিনি জয়পুরহাটের মহুরুলে তার গ্রামের বাড়িতে চলে যান। দেশ স্বাধীন হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে কাজে যোগদানের চেষ্টা করেন। স্মৃতিভ্রষ্ট ও দেবদাস নাম ধারণকারী মজিবুর রহমানকে নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন বিপদেই পড়ে। আবারও নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতেই যেন অভিমানী মজিবুর রহমান দেবদাস ৫ এপ্রিল, ১৯৭৩ রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়ে চাকরি থেকে সরে দাঁড়ালেন। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে অবস্থানের সুযোগ ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে সিন্ডিকেট সভায় এক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতীয় অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দিন আহমেদের (তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন) একান্ত চেষ্টায় শহীদদের পরিবারকে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা অধ্যাপক মজিবুর রহমান দেবদাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে এ মর্মে সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে থেকেই তাকে আখ্যায়িত করা হয় 'জীবন্ত শহীদ' বলে। আর তার বাসস্থানের ব্যবস্থা হয় জুবেরী ভবনে। অধ্যাপক মজিবুর রহমান দেবদাস কয়েক বছর জুবেরী ভবনে বাস করেন। তার আচরণ কখনো স্বাভাবিক আবার কখনো অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে সহকর্মীদের কাছে। তবে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার আচরণকে সব সময় অস্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার মানসিক রোগের চিকিৎসার নামে তাকে পাবনা হেমায়েতপুর হাসপাতালে ভর্তি করে। তিনি কোনো পাগল নন এ কথা বলে হেমায়েতপুরে চিকিৎসা নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার প্রতি সুবিচার করেনি। তার নামে বরাদ্দকৃত জুবেরী ভবনের বাসাটি চলে যায় অন্য শিক্ষকের দখলে। হেমায়েতপুর থেকে এসে তার বাসার দখল না পেয়ে তিনি চলে যান একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ তার খোঁজখবর জানতেন না। দৈনিক আজকের কাগজের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রতিনিধি বর্তমানে আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান তার খোঁজ পেয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন, যা ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১৯৯৮ সালের ২ আগস্ট তাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে এসে সংবর্ধনা দেয়। এবার তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হলেন। এ বছর ২০ মার্চ রাজশাহীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে চার গুণী ব্যক্তিকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো। তাদের মধ্যে অধ্যাপক মজিবুর রহমান দেবদাস অন্যতম। এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন হাসিবুল আলম প্রধান। অধ্যাপক মজিবুর রহমান দেবদাস প্রায় ৮৭ বছর বয়সে জয়পুরহাটের মহুরুল নামক নিজ গ্রামে স্মৃতিভ্রষ্ট অবস্থায় বিভিন্ন রোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত এই চিরকুমার অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার জীবনের শেষ দিনগুলো যেন অভাব-অনটন আর অবহেলা-অযত্নে না কাটে সেদিকে সরকারের লক্ষ্য রাখা উচিত।

লেখক : কোষাধ্যক্ষ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

 

সর্বশেষ খবর