শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিহীনতার ইতিবৃত্ত

সাইফুর রহমান

বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিহীনতার ইতিবৃত্ত

ইংরেজ মহাকবি জন মিল্টন জীবন সায়াহ্নে এসে লন্ডনের যে অঞ্চলটিতে বাস করতেন তার নাম বানহিল। ছিমছাম, মনোরম, গোছানো, পরিপাটি একটি বাড়ি। সামনে একটি সুন্দর বাগানসমেত উঠান। বাগানটিতে নানা রকমের গাছগাছালির সমারোহ- গ্রে উইলো, সাদা পপলার, হেমলক নানা প্রজাতির ইউ ছাড়াও হরেক রকমের বৃক্ষ। বাগানটি আলো করে ফুটে থাকে ব্লু-বেল্স, এলিপিনা, এগ্রিমনি ও সুগন্ধি বার্নেট গোলাপ। অন্ধ কবি মিল্টন এক চিলতে উঠানের এক পাশে বসে শ্বাস টেনে বুক ভরে ফুলের সুবাস উপভোগ করেন আর সেই সঙ্গে তার অনুলিখক ব্রুনেলকে নির্দেশ দেন কবিতাগুলোতে কোন লাইনের পর কোন লাইন লিখতে হবে। অনুলিখক ঠিক সেভাবেই লিখে চলেন মধ্যাহ্নভোজের পূর্ব প্রহর পর্যন্ত। মাত্র ১২ বছর বয়সেই চোখে আঘাত পেয়ে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায় মিল্টনের। পরিণত বয়সে ক্রমেই সম্পূর্ণরূপে অন্ধত্ববরণ করতে হয় তাকে। ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস লেখার কৃতিত্ব অর্জনকারী লেখক ড্যানিয়েল ডিফো বাস করতেন মহাকবি মিল্টনের বাড়ির কাছেই। ডিফোর লেখা 'দ্য রবিনসন ক্রসো (১৭১৯) উপন্যাসটি ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস। পাঠশালায় যেতে-আসতে ডিফো অন্ধ কবিকে প্রায়ই দেখতেন বাড়ির সামনের উঠোনটিতে রোদ পোহাতে। ডিফো অবাক বিস্ময়ে ভাবতেন একজন দৃষ্টিহীন মানুষ কী করে লিখে ফেললেন 'প্যারাডাইস লস্ট'-এর মতো কালজয়ী একটি মহাকাব্য। ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম মহাকাব্য লেখার কৃতিত্বটি তাহলে শেষ পর্যন্ত এই অন্ধ কবির কপালেই জুটল। সম্মানের দিক দিয়ে শেকস্পিয়রের পরই ইংল্যান্ডে এখন মিল্টনের নাম উচ্চারিত হয়। ডিফো মনে মনে ভাবেন তিনিও কি কখনো পারবেন মিল্টনের মতো করে লিখতে। ড্যানিয়েল ডিফোর জন্ম হয়েছিল ১৬৬০ সালের সেপ্টেম্বরে। চসার ও শেকস্পিয়রের মধ্যযুগীয় লন্ডন শহরে। এখানে ডিফোর প্রসঙ্গটি টানতে হলো এ কারণে যে, ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞজনেরা বুদ্ধিজীবী কথাটির ভাবগত উৎপত্তির ঐতিহাসিক তাৎপর্য আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন বুদ্ধিজীবী কথাটির সর্বপ্রথম প্রচলন শুরু হয় রাশিয়ায় ষাটের দশকে। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রদের সম্পর্কে এ বিশেষণটি প্রয়োগ করা হতো। ওইসব ছাত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল তারা সমাজের চিরাচরিত প্রথা বিশ্লেষণ করে তার যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করল। তারা নির্বিচারে ব্যক্তিপূজার বিরোধী ছিল এবং নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তুলেছিল। ছাত্রদের এসব মানসিকতার মূলে ছিল বিখ্যাত রাশিয়ান উপন্যাসিক ইভান তুর্গেনিভের কয়েকটি রচনা। তার মধ্যে অন্যতম A sportsman’s sketches (১৮৪৭-১৮৫১)। এর বিষয়বস্তু ছিল রাশিয়ার ভূমিদাসদের জীবনের করুণ কাহিনী এবং তা এমন হৃদয়স্পর্শী করে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেছেন লেখক তুর্গেনিভ যে, তরুণ ছাত্রদের মনে প্রশ্ন জাগল কেন একজন মানুষের জীবন এরূপ নির্মম অবস্থার মধ্যে অতিবাহিত হবে। প্রাসঙ্গিক আরও অনেক সামাজিক প্রশ্ন তাদের চিত্ত উদ্বেল করে তুলেছিল। কিন্তু আমার যতটুকু পড়াশোনা ও বিচার-বিশ্লেষণ তাতে আমি মনে করি, আসলে ইভান তুর্গেনিভ নন, বুদ্ধিজীবীদের মতবাদ ও এর কর্মপরিধির সূচনা সত্যিকার অর্থে প্রথম করেছিলেন জন মিল্টন ও তার ভাব শিষ্য ড্যানিয়েল ডিফো। ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের পর রাজা প্রথম চার্লসকে যখন মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয় সে ঘটনার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ১৬৪৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত মিল্টনের বিখ্যাত রাজনৈতিক পুস্তিকা The Tenure of kings and magistrates.
বইটিতে মিল্টন লেখেন- দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলো জনগণ। রাজা যদি জনগণের মতামত ও জনগণকে পদদলিত করার চেষ্টা করেন তখন তার পরিণাম যে এমন হবে তা তো সহজেই অনুমান করা যায়।

১৭০০ সালের দিকে সে সময়ের অজনপ্রিয় সরকার ও সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে ডিফো লিখলেন তার বিখ্যাত রাজনৈতিক পুস্তিকা 'দ্য শর্টেস্ট ওয়ে উইথ দ্য ডিসেন্টার্স (The shortest way with the decenters)। ডিফো তার সে বইটিতে লিখলেন- ডিসেন্টার্সদের শায়েস্তা করার সবচেয়ে সহজ পথ হলো তাদের সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া। অথচ ডিফো নিজেও ছিলেন ডিসেন্টার। কত মর্মভেদী তার এই লেখা, যেন ডিফো নিজেই নিজের ফাঁসি চাইছেন!

১৭০৩ সালের ২ জানুয়ারি ডিফোর বিরুদ্ধে 'দ্য শর্টেস্ট ওয়ে' লেখার জন্য অভিযোগ উত্থাপন করা হলো। ডিফো আগে থেকে খবর পেয়ে গাঢাকা দিলেন। প্রায় সাড়ে চার মাস আত্দগোপন করে রইলেন। তারপর ধরা পড়লেন, বিচার হলো। বিচারে ডিফোর জরিমানা হলো। সঙ্গে তিন দিন পিলরিতে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হলো। এর মধ্যে পিলরিতে দাঁড়িয়ে থাকাটাই সবচেয়ে কঠোর সাজা। খোলা জায়গায় কাষ্ঠস্তম্ভে হাত-পা এবং গলা এমনভাবে আটকে দেওয়া হয় যে নড়াচড়া করার উপায় থাকে না। অনেকটা ক্রুশের মতো, তবে হাত-পা পেরেক দিয়ে আটকানো হয় না। ফাঁকের মধ্যে হাত-পা ও গলা ঢুকিয়ে আটকে রাখার বন্দোবস্ত থাকে যন্ত্রটিতে। মাথার ওপর লিখে দেওয়া হয় অপরাধের বিবরণ। কৌতূহলী দর্শকের ভিড় জমে যায় তামাশা দেখার জন্য। তারপর মজা দেখার জন্য জনতা ঢিল ছুড়তে থাকে পিলরিতে আবদ্ধ বন্দীকে লক্ষ্য করে। রক্ষীরা বাধা দেয় না, এটা জনতার বহুদিনের অলিখিত অধিকার। কত বন্দী প্রাণ দিয়েছে ঢিলের আঘাতে, কত বন্দী জন্মের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছে। ডিফোর ভয় এই পিলরিকে। এক দিন নয়। তিন দিন দাঁড়াতে হবে। নিজেকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করলেন ডিফো। ভয়ে অন্য ডিসেন্টাররা তাকে ত্যাগ করেছেন, টাকা দিতে পারেননি বলে আইনজ্ঞরা সাহায্য করতে এলেন না; বন্ধুরা মুখ ফিরিয়েছেন; যে হুইগ দলের নেতাদের জন্য এত করেছেন তারাও তার আবেদনে বিন্দুমাত্র সাড়া দিলেন না। সুতরাং নির্বিকারচিত্তে শাস্তি গ্রহণ করা ছাড়া উপায় কী? কিন্তু আশ্চর্য, জনতা ত্যাগ করেনি তাকে। ভিড় কম হয়নি, দলে দলে নর-নারী এসে খোলা জায়গা ভরে ফেলেছে। পিলরিতে দাঁড়িয়ে ডিফোর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। দূর থেকে সব ভালো করে দেখতে পাচ্ছেন না। তবু দেখতে পেলেন হাজার হাজার কপি 'দ্য শর্টেস্ট ওয়ে' বিক্রি হচ্ছে। ক-মাস আগে সরকারের আদেশে এ বই প্রকাশ্যে পোড়ানো হয়েছিল। এখন নতুন করে ছাপানো হয়েছে, দর্শকরা সাগ্রহে কিনছে। অন্য সবাই ত্যাগ করলেও জনতা তাকে ত্যাগ করেনি। তাকে লক্ষ্য করে একটি ঢিলও ছুড়ল না কেউ। বরং সম্মান দেখিয়েছে তারই বই। কেউ কেউ পড়তে শুরু করল পিলরির চারপাশে। ওপরের বর্ণিত কাহিনীটি ইতিহাসের পাতা থেকে এ কারণে উল্লেখ করা হলো যাতে পাঠকসমাজ অতি সহজেই বুঝতে পারেন বুদ্ধিজীবীরা কেন এবং কীরকম প্রতিকূল পরিস্থিতি উপেক্ষা করেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সেই সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের মানুষের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে সব সময় প্রস্তুত থাকেন। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। বোধ করি আমার লেখালেখির জন্যই আমার অজস্র পাঠক আমাকে প্রতিনিয়ত অনুরোধ করেন দেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলোয় প্রচারিত প্রচলিত টকশোগুলোয় অংশগ্রহণ করতে। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম তখন এসএ টিভিতে সঞ্চালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। আমাকে একদিন বললেন, 'আপনাকে আর আপনার বন্ধু ব্যারিস্টার মীর হেলালকে ডাকতে চাই একদিন, বলুন কবে আসবেন?' আমি স্মিত হেসে বলি দেখা যাক। এই তো কিছু দিন আগেও ইটিভি থেকে দুই দফা ডাকা হলো আমাকে। আমি নানা অজুহাতে এড়িয়ে গেলাম সন্তর্পণে। আমার ইতস্তত করার কারণ হলো আমি বক্তা নই, লেখক। কথা আমি কলমের মুখ দিয়েই বলি, আর পাঠক তা চোখ দিয়েই আদায় করে নেয়, কান দিয়ে নয়। লেখক-পাঠকের সম্পর্ক নীরব। উপরন্তু আমার কণ্ঠস্বর চিরকালই ক্ষীণ আর বর্তমানে তা অধিকতর ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এর পরও দু-একটি টেলিভিশনের অনুরোধে দু-চারটি সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে। বিশেষ করে অনুজ বন্ধুবর ও বাংলাভিশনের মেধাবী সাংবাদিক ইমরুল কায়েসের অনুরোধ কখনো প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি।

একটা বিষয় আমার কাছে বেশ আশ্চর্য লাগে, টকশোগুলোয় সাধারণত যেসব লোক আসেন আমার ধারণা গুটিকয় ছাড়া তাদের বেশির ভাগেরই পড়াশোনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। নেই তেমন ইতিহাসবোধ। দেশের লাখো-কোটি দর্শকের সামনে কীভাবে অবলীলায় অসত্য, অসম্পূর্ণ কিংবা ত্রুটিপূর্ণ ইতিহাস বলে যান একের পর এক! দেখলে বেশ অবাক হতে হয় বইকি! একটি বেসরকারি টেলিভিশনের স্বত্বাধিকারীকে দেখি বিভিন্ন চ্যানেলের টকশোয় অংশ নিতে। তিনি যে কী বলেন তা সম্ভবত ঈশ্বর আর তিনি ছাড়া কেউ বোঝেন না। তোষামোদিরও তো একটা সীমা-পরিসীমা থাকা উচিত। আরেকজন আছেন কোনো এক ফাউন্ডেশনের কী যেন সভাপতি টবাপতি হবেন। সব সময় শুধু উন্নয়নের পরিসংখ্যান দেখান। উনি বোঝেন না যে দেশের মানুষ বোকা হতে পারে তবে মূর্খ নয়। উন্নয়ন যে একটি আপেক্ষিক বিষয় তা দেশবাসী ভালো করেই বোঝে। আর দেশে কী এমন উন্নয়ন হয়েছে? এখনো উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে দুই-আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়।

এটা ধ্রুব সত্য যে, বুদ্ধিজীবীরা কখনো সরকারের পক্ষে কথা বলতে পারেন না। আর এরকম কোনো রেওয়াজ পৃথিবীতে খুব একটা নেই। কারণ সরকার নিজেই একটা বিশাল প্রতিষ্ঠান। এত বড় একটা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের পক্ষাবলম্বন করলে প্রকারান্তরে জনগণের বিপক্ষেই অবস্থান নেওয়া হয় বলে প্রতীয়মান হয়। এজন্য আমরা দেখি জন মিল্টন, ড্যানিয়েল ডিফো থেকে শুরু করে কোলরিজ, ভলতেয়ার, রুশো পরবর্তীতে তুর্গেনিভ নতুন করে বুদ্ধিজীবীদের যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিলেন তা অনুসরণ করে দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, গোর্কি প্রমুখ লেখক তাদের বুদ্ধিজীবী মানসিকতাকে আরও দৃঢ় করেছিলেন। গোর্কি তো সে সময়ে জার সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র পুস্তিকা বিলি করতে গিয়ে রীতিমতো জেল খেটেছেন। দস্তয়েভস্কিকে সাইবেরিয়ায় কারাভোগ করতে হয়েছে সুদীর্ঘকাল। আজ যদি দেখা যায় বিখ্যাত মার্কিন লেখক ও বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি মার্কিন সরকারের পক্ষে কথা বলছেন তবে তা হবে একটা হাস্যকর বিষয়। কারণ সরকার সব সময় জনগণের জন্য কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক, এর জন্য তাকে বাহ্বা দেওয়ার কিছু নেই। আমরা সহজেই বুঝতে পারি তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নামধারী কিছু লোক কেন সরাসরি একটি পক্ষ অবলম্বন করে। কারণটি সহজেই অনুমেয়, সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক প্রাপ্তি। এ প্রসঙ্গে আমার একটি কৌতুক মনে পড়ে গেল। আমার এক অগ্রজ ও এ সময়ের একজন তারকা আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আমাকে ঠাট্টা করে একবার একটি প্রশ্ন করেছিলেন- 'বল তো একজন উকিল ও একটি বারবনিতার মধ্যে পার্থক্য কী।' আমি বললাম বলতে পারছি না। তিনি বললেন, 'পার্থক্য শুধু এতটুকুই একজন অঙ্কশায়িনী টাকা পেলে শুয়ে পড়েন আর একজন উকিল টাকা পেলে দাঁড়িয়ে যান।' কৌতুকটি শুনে বিশুদ্ধচিত্তে হেসেছিলাম খানিকক্ষণ। তবে এ কথা বলতেই হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমার সতীর্থ আইনজীবীদের দেখেছি তারা নিদারুণ পরিশ্রম করেন তাদের মক্কেলকে জেতানোর জন্য। তবে কাজল ভাইয়ের এ কৌতুকটি মনে হয় বর্তমান সময়ের কিছু বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। অথচ ব্রিটিশ লেখক রাজনীতিক ও ইতিহাসবিদ থমাস ব্যাবিংটন মেকলে বলেছিলেন, ইনটেলেকচুয়াল পার্সুট হবে সম্পূর্ণরূপে স্বার্থলেশহীন কিন্তু তা আজ আমরা দেখছি কোথায়? ইনটেলেকচুয়ালরা বামপন্থি বা দক্ষিণপন্থি হতে পারেন, আবার সম্পূর্ণরূপে দল-মতের ঊধের্্ব থাকতে পারেন। তবে যারা শুধু জনগণের মনোভাব বুঝে নিজস্ব যুক্তি ও বুদ্ধি অনুসারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে যাবেন তারাই আদর্শ ইনটেলেকচুয়াল। একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষ কিন্তু পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টিভিতে কথা বলার সুযোগ পায় না এজন্য বুদ্ধিজীবীরাই জনগণের পক্ষ হয়ে পত্রপত্রিকা ও অন্য গণমাধ্যমগুলোয় কথা বলেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমি এ বুদ্ধিজীবী দর্শনটার সঙ্গেই একমত নই। বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত হতে কিংবা আখ্যাত হতে আমরা বেশ গৌরববোধ করি। অথচ একটু ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যায় এর মধ্যে এমন কী গৌরবের বিষয় থাকতে পারে? জীবন ধারণের জন্য সবারই তো বুদ্ধির দরকার এমনকি মশা, গরু, কিংবা পিঁপড়েরও। একটি মশা তার শুঁড়টি মানুষের শরীরে ফুটিয়ে দেওয়ার আগে শুঁড়টি থেকে একরকম লালা নিঃসরণ করে চামড়ার ওই স্থানটি অসাড় করে নেয়। মাঠে প্রান্তরে উদোম গরুগুলো ঘাস-লতাপাতা চিবুনোর আগে শোঁক শোঁক করে শুঁকে দেখে ওগুলো বিষাক্ত কি না। তা না হলে হয়তো অধিকাংশ গবাদিপশু আতাফলের পাতা, ধুতরা কিংবা ফণিমনসার মতো বিষাক্ত পাতা খেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হতো। গরুর বুদ্ধি নেই বলে অপবাদ থাকলেও বিষাক্ত ঘাসপাতা চেনার ঘ্রাণশক্তি তার প্রকৃতিদত্ত। আগেকার বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের স্বার্থের কথা না ভেবে সমাজের মঙ্গলের জন্য যেভাবে কাজ করতেন আজকালকার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তা আর পরিলক্ষিত হয় না। ইতিহাস বলে, সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীকে অর্থ ও জাগতিক সুখ-সুবিধা থেকে দূরে থাকতে হয়। এজন্যই বোধ হয় বাটর্্রান্ড রাসেল বলেছেন, কোনো বিশেষ দলভুক্ত হলে তিনি কখনো সত্যিকার বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না। সত্যিকার বুদ্ধিজীবী শুধু আপামর জনমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো নিয়েই সব সময় সোচ্চার থাকবেন, সর্বোপরি এটাই তাদের কাছে প্রতিদিনের প্রত্যাশা।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর