রবিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

সাংবাদিকতা ও আমাদের দায়

নাদীম কাদির

সাংবাদিকতা ও আমাদের দায়

গত বছর অক্টোবরে যখন 'গণমাধ্যম না পাগলা গারদ' শীর্ষক প্রবন্ধটি লিখি, আমার মাথায় দুটো জিনিস ছিল। এক. কেউ দেখিয়ে না দিলে লেখাটি আমার প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের নজরে আসবে না। দুই. চোখে পড়লে হয় তারা একে এড়িয়ে যাবেন বা লেখাটি নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করবেন অথবা নিদেনপক্ষে আমাকে তারা বরখাস্ত করবেন।

মজার বিষয় হচ্ছে, আমি যেমনটা ভেবেছিলাম, সে রকম ঘটেনি। আমার কিছু 'শিক্ষিত' সহকর্মী লেখাটির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ তোলায় কর্তৃপক্ষ আমাকে এক মাসের ছুটিতে যেতে বলে। যেহেতু আমি আমার প্রতিষ্ঠানের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করিনি, তাই একে আমি আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখি ও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিই।

কিন্তু প্রবন্ধটির বিষয়ে আমার সহকর্মীরা ব্যাপক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অনেকে 'শেয়ার' করেন, প্রচুর মানুষ 'লাইক' ও 'কমেন্ট' করে সহমত প্রকাশ করেন, ফোন করেও জানান কেউ কেউ। 'নাদীম ভাই, আপনি একদম আমাদের মনের কথাটাই বলেছেন, আপনার সাহসের জন্য সাধুবাদ জানাই'- এমন কথাই ছিল বেশির ভাগ মন্তব্যের মূলভাব।

একাত্তর টেলিভিশনের বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা এক দৈনিকে লেখেন, 'ব্যবসা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য ধারণ করা মানুষে ভরে গেছে গণমাধ্যম।'

তিনি লেখেন, 'সাংবাদিকরা প্রতিষ্ঠান মালিক, বিজ্ঞাপনদাতা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এমনকি অগ্রজ সাংবাদিকদের দিক থেকেও বহুমুখী চাপে থাকেন। এই সমস্ত অভিজ্ঞ সাংবাদিকের কাছে দেশের বাস্তবতা উপস্থাপনের চেয়ে অন্যান্য উদ্দেশ্যই মুখ্য থাকে।'

'সামনের সময়ে সংবাদ মাধ্যম আরও চাপে পড়বে বলে মনে হয়, যদি না তারা শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। তাদের বোঝা দরকার প্রশাসন ও দায়িত্ববোধ স্লোগানের চেয়ে জরুরি।'

ওয়ান-ইলেভেনের আগে কেউ আমাকে কখনোই বলেনি কী লিখব আর কী লিখব না বা টেলিভিশন চ্যানেলে কী প্রচার করব আর কী করব না। একটি বহুজাতিক সংবাদ সংস্থায় ১৮ বছরের কর্মজীবনে একবারই বিএনপির অনুভূতি আহত না করার জন্য সামান্য সমস্যা হয়েছিল।

এই উদাহরণগুলো দিলাম পেশাগত জীবনের কিছু বিব্রতকর পরিস্থিতির সাপেক্ষে। তবে ২০০১ সালে এক ধরনের পরোক্ষ হুমকি ছিল। কোনো দৈনিকে কারও নাম এলে সমস্যা হতো... রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আপনাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। হিন্দুদের ওপর হামলা ও হিন্দু নারী ধর্ষণের বিষয়ে প্রতিবেদন লেখাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। বহুজাতিক সংবাদ সংস্থায় কাজ করতাম বলে আমি ছিলাম একটু বেশিই সাবধান।

আমরা এসব বিষয় এড়িয়ে যেতাম, 'দমবন্ধ' পরিস্থিতির মধ্যে ভীতি নিয়ে কাজ করে যেতাম।

ফলে আমি বেশ বিস্মিত হয়েছি, এমন কী হয়েছে যে সম্পাদকমণ্ডলীর এমন পুরনো প্রসঙ্গ তুলে বিবৃতি দিতে হলো, যা ২০০১ বা তার পরও দিতে হয়নি। সত্যি, ওই সময় সম্পাদকদের সংগঠন ছিল না, তবে বড় মানুষদের ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান তো সব সময়ই ছিল।

সম্পাদকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, পুরনো প্রসঙ্গ তুলে দেওয়া বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন আমার অতি শ্রদ্ধাভাজন একজন সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক জনাব মাহফুজ আনাম।

বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, আমি মনে করতে পারি না পিআইডি বা অন্য কেউ কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত বা টেলিভিশনে প্রচারিত কোনো বিষয়ে নিজেদের অসন্তোষ জানিয়েছে। এই যদি হয় নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরির অবস্থা, তাহলে গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোকে কী নামে ডাকা যেতে পারে!

যে ভাগ্যবান ব্যক্তি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি পান, তিনি জানেনই না সাংবাদিকতা কী বা একটি খবরের কাগজ/টিভি/রেডিও কীভাবে চলে। তিনি কোনো টাকা খরচ করার ঝুঁকিতে না গিয়ে কোনো এক বন্ধুকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়ে তার ওপর চাপিয়ে দেন দায়িত্ব।

তার কাছে থাকে টাকা আর সৌন্দর্যের প্রতি লোভ মানবিক এবং অমানবিক উভয় প্রকার। গণমাধ্যম বোঝাই হয়ে থাকে ভুলভাল মানুষ দিয়ে।

প্রতিষ্ঠানের আয় উন্নতি হলেও বেতন আটকে থাকে, তা নিয়ে কেউ কিছু বললেই হয় বরখাস্ত নয় নিন্দা।

কোনো কর্মচারী আরও ভালো চাকরির জন্য বা অন্য কোনো কারণে কাজ ছেড়ে চলে গেলে বেতন আটকে থাকে, অনেক সময় আদৌ দেওয়া হয় না।

সুন্দর সংবাদ বা অনুষ্ঠান উপস্থাপকদের অনেককেই 'বিশেষ চোখে' দেখা হয়। তারা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে কাজ ছেড়ে চলেও যান। সহকর্মীদের জানান তাদের অবস্থা।

প্রশাসন পাঁচতারা হোটেলে নৈশভোজ আর জমকালো অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত থাকে, কিন্তু যারা অবিশ্রাম পরিশ্রম করে কাজ তুলে দেন, তারা থাকেন অভুক্ত। তারা বাড়িভাড়া দিতে পারেন না, সন্তানকে স্কুলে নিতে পারেন না। চলতে হয় ধারদেনা করে। এটাই কি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু গণমাধ্যমের যথাযথ পরিবেশ?

অনেক সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে চলেন এবং যাদের প্রতিযোগী ভাবেন, তাদের হাত থেকে কোনোভাবে 'বাঁচার' চেষ্টা চালাতে থাকেন।

আমার এক বন্ধুকে একবার এক প্রতিষ্ঠানের 'প্রভাবশালী' সাংবাদিক সহকর্মী ডেকে পাঠান। আমার বন্ধু নতুন ধরনের একটি অনুষ্ঠান তৈরি করেন, যা বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে আগে দেখানো হয়নি। কিন্তু খুব ব্যক্তিগত কারণে কোনো এক উপরওয়ালার সুনজর থেকে বঞ্চিত হয়ে তিনি ক্রমাগত পরিহাসের পাত্র হয়ে ওঠেন, মুখোমুখি হন নিপীড়নের। এমনকি তাকে কাজ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়, যা ছিল অত্যন্ত অপমানজনক। আমার বন্ধু চাকরি ছেড়ে দেওয়াই ভালো মনে করেন।

আমার বন্ধুটি শুধু যে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন তাই নয়, তার জনপ্রিয়তাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আমার বন্ধু দুই মাস আগে জানান দিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার পরও তাকে দ্বিতীয় মাসের বেতন-ভাতা দেয়নি সেই প্রতিষ্ঠান।

আমরা কি এই পরিবেশকে যথাযথ কাজের পরিবেশ বলতে পারি? আমি সম্পাদকদের প্রতি আবেদন করব, আমার শেষ লেখাটা দেখুন, কিছু বিষয় গ্রহণ করুন, তাতে অমানবিক পরিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে সাংবাদিকরা 'যথাযথ পরিবেশ' পেতে পারে।

আমি বিস্মিত হয়ে ভাবি, বিরোধীপন্থি যে কোনো মানুষ যারা বলেন বা লেখেন, তারাই সরকারের জন্য 'চাপ' কিনা। ২০০১ সালের পর জামায়াতকে নিয়ে কিছু লেখাই ছিল ঝুঁকির বিষয়, কারণ তারা তখন সরকারের অংশ ছিল।

সামান্য কারণে ইটিভি বন্ধ করা, দিগন্ত টেলিভিশন বা আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করার বিষয়গুলো আজ আর না-ই বা আনলাম।

আমরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে একটু বেশিই আশা করি, কেননা তারা দোষত্রুটি নিয়েই বেশি যোগ্য। অনেকে আবারও বলতে পারে আমি সরকারের কাজ করি বলে সাফাই গাইছি। কিন্তু আমি কি ভুল বলছি?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রচুর টিভি চ্যানেল, এফএম রেডিও ও কমিউনিটি রেডিওকে অনুমোদন দিয়েছেন যারা রাজনৈতিক সংঘাতের প্রতিবেদন করতে গিয়ে ভুল করেছে।

টেলিভিশন, এফএম রেডিও বা কমিউনিটি রেডিওর অনুমোদন দেওয়ার আগে কিছু বিষয় বিবেচনা করা সরকারের জন্য জরুরি।

কিছু সুপারিশ এখানে দেওয়া হলো-

১) টেলিভিশন/রেডিওর অনুমতির আবেদনকারী ব্যক্তির আগাপাছতলা জানা। ২) সমাজে তার অবস্থান জানা।

৩) নিজের প্রতিষ্ঠানে তার কর্মদক্ষতা। ৪) কমপক্ষে টানা তিন বছর প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি আছে কিনা দেখা, অন্যথায় লাইসেন্স বাতিল করা। ৫) ব্যক্তি ও কর্মী হিসেবে তার চরিত্র জানা। ৬) লাইসেন্স পাওয়ার পর কাজ শুরুর জন্য সর্বোচ্চ ছয় মাসের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া। ৭) তথ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের কোনো সংস্থার কাউকে ওই প্রতিষ্ঠানে জুড়ে দেওয়া, যেন নতুন প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা যাচাই করতে পারে। ৮) নিয়োগবিষয়ক নীতিনির্ধারণ করা যাতে মেধাবীরা কিছু পক্ষের স্বার্থান্ব্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ছিটকে না পড়ে। ৯) মালিক ও কর্মীদের নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক হতে হবে।

১০) সাংবাদিকদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা। এখানে স্বল্পসংখ্যক সুপারিশ দেওয়া হলো, আমি নিশ্চিত গণমাধ্যমে কর্মরত বন্ধুরা আরও যোগ করতে পারবেন। গণমাধ্যম নিয়ে আরও অনেক বলার ও লেখার আছে, কিন্তু আমি সম্ভবত নিজের বরাদ্দকৃত স্থান নিঃশেষ করে ফেলেছি।

লেখক : সাংবাদিকতায় জাতিসংঘের ড্যাগ হ্যামারসোল্ড স্কলার ও লন্ডন হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার।

 

 

সর্বশেষ খবর