রবিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
মুক্তিযুদ্ধ

ফুলতলার প্রতিরোধ যুদ্ধের শহীদ রফি

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার

ফুলতলার প্রতিরোধ যুদ্ধের শহীদ রফি

মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণের জনপথ খুলনার ফুলতলার সাধারণ মানুষের অবদান অবিস্মরণীয়। ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামসহ প্রতিটি গণআন্দোলনে এই অঞ্চলের মানুষ নিঃসঙ্কোচিত্তে অংশগ্রহণ করেছে। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকাসহ সারা দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এই দেশীয় দোসর আল-বদর, আল-শামস, রাজাকাররা যে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল তার বিরুদ্ধে ফুলতলাবাসী প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা করে। যশোর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী খুলনা শহরে প্রবেশ করে হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠতে না পারে সেই লক্ষ্যে খুলনার প্রবেশপথ ফুলতলাতেই নিরীহ গ্রামবাসী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওই প্রতিরোধ যুদ্ধের এক সাহসী সৈনিক ছিলেন শহীদ শেখ মো. রফি।

তিনি ১৯৪০ সালে ফুলতলার দামোদর গ্রামে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রজব আলী শেখ ও আমেনা বেগমের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান রফি ফুলতলা মাদ্রাসা থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে ফুলতলা হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও অর্থাভাবে একাডেমিক শিক্ষা শেষ করতে পারেননি। তিনি শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই পরিবারকে সহায়তা করতে পিতার ক্ষুদ্র ব্যবসায় যুক্ত হন। শৈশব থেকে যৌবনে পা রাখতেই তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। খুলনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কালীপদ ঘোষের প্রভাবে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হন। পার্টির নির্দেশেই তিনি ১৯৬৬-৬৯ পর্যন্ত এই অঞ্চলের শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী, সদালাপী ও তেজদ্দীপ্ত এই যুবক সদ্য বিকাশমান পাটকলগুলোতে (ইস্টার্ন, আফিল, আলিম জুট মিল) হয়ে ওঠেন শ্রমিকদের অবিসংবাদিত নেতা। নূর খান মজুরি কমিশনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ন্যায্য দাবির আন্দোলনে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন। ওই আন্দোলনের সময় শাসকগোষ্ঠী পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে তাকে বহুবার গ্রেফতারের চেষ্টা করলেও শ্রমিকদের প্রবল বাধার মুখে শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। শুধু শ্রমিক আন্দোলন নয়; '৬২-র হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

তবে রফি সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক গণআন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সামরিক শাসক আইয়ুব খানবিরোধী গণআন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তার জোরালো ভূমিকা জনগণকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হলে তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ইস্টার্ন ও আলিম জুটমিলের শ্রমিকরা যশোর-খুলনা রোডের ফুলতলায় অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন; যাতে পাকিস্তানি বাহিনী খুলনা শহরে প্রবেশ করতে না পারে। তার ওই উদ্যোগ সফল হওয়ার আগেই পাকিস্তানি বাহিনী ফুলতলাতে প্রবেশ করে গণহত্যা শুরু করলে তিনি শ্রমিকদের নিয়ে রুখে দাঁড়ান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র প্রতিরোধ ধোপে টেকেনি। অতঃপর মো. রফিসহ তার সহযোদ্ধারা পালিয়ে ভৈরব নদী পার হয়ে পেরুলি গ্রামে অবস্থান নেন।

ইতিমধ্যে পাকিস্তানিদের সহযোগিতায় সরোয়ার মোল্লার নেতৃত্বে ফুলতলাতে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। ওই রাজাকার বাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। দেশপ্রেমিক রফির পক্ষে তার জন্মভূমিতে রাজাকারদের আস্ফালন সহ্য করা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি সাধারণ মানুষকে রাজাকারদের হাত থেকে রক্ষা করতে সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাজাকার কমান্ডার সরোয়ার মোল্লাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। কালাম ভূঁইয়া, সাখাওয়াত হোসেন সাকু, হাফিজুর রহমান ভূঁইয়াসহ ২০ জন সহযোদ্ধা নিয়ে তিনি রাজাকারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। ওই অভিযান সফল হয় এবং রাজাকার কমান্ডার সরোয়ার মোল্লা নিহত হয়। রফির এই সফল অভিযানের ফলে ফুলতলাসহ পুরো খুলনা অঞ্চলের রাজাকাররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় রফিকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা রফিকে গ্রেফতার করতে পেরুলি গ্রামে যায়। কিন্তু রফিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনে সহযোদ্ধাদের নিয়ে নাউলি বিলে আত্দগোপন করেন।

রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেলেও শেষ পর্যন্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজ দলের এক সদস্যের বিশ্বাসঘাতকতায় রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। রফির সহযোদ্ধা গোবিনাথপুরের বাসিন্দা মাজেদ রাজাকার কমান্ডার সুলতান মলি্লকের (রফি কর্তৃক নিহত রাজাকার কমান্ডার সরোয়ার মোল্লার আত্দীয়) কাছে রফিকে ধরিয়ে দেয়। সুলতানসহ অন্য রাজাকাররা রফিকে সরোয়ার মোল্লার বাড়িতে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং রফির ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। কিন্তু নির্মম নির্যাতনের পরও রফি তার সহযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য রাজাকার বাহিনীকে অবহিত করেননি। ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজাকার কমান্ডার সুলতান মলি্লকের নির্দেশে রফিকে হাটের দিন ফুলতলা বাজারে নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। দেশ মাতৃকার এই সাহসী সন্তান জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও সাধারণ মানুষের কথা ভুলে যাননি। তিনি রাজাকারদের অনুরোধ করেন তাকে যেন কোনো নির্জন জায়গায় নিয়ে গুলি করা হয়; যাতে তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া গুলিতে হাটে আগমনকারী সাধারণ কোনো মানুষ আহত বা নিহত না হয়। রাজাকাররা রফিকে হত্যা করে তার মাথা কেটে ফুলতলা বাসস্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে রাখে। বর্তমানে ওই স্থানে রফির নামে একটি পাঠাগার স্থাপিত হয়েছে। রফির সহযোদ্ধা কমরেড হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া প্রবন্ধকারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন : 'রফির ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ছিল।' এই সাহসী যোদ্ধা চিরকুমার ছিলেন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

 

 

 

সর্বশেষ খবর