মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
দর্শন

মূল্যবোধহীন মানুষ পশু সমতুল্য

আবু মহি মুসা

আমাদের মাঝ থেকে মানবিক মূল্যবোধ কি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এমন একটি প্রশ্ন এখন সবার মনে। আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন একজন যদি ন্যায়ের সমর্থক থাকেন, অন্যজন অন্যায়ের সমর্থক। এ সময়ে স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে, ভাই ভাইকে, মানুষ মানুষকে তুচ্ছ কারণে হত্যা করছে। বৃদ্ধ অসুস্থ পিতা বেকার, সংসারের বোঝা, তার সন্তানরা তাকে হাসপাতালে না নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গেছে। পুত্রের নামে জমি লিখে না দেওয়ায় পিতাকে হত্যা করছে। হরতালে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যার ঘটনাও সবার জানা। এ ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও আমরা যেন অসহায়।

দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে মানুষের কাছে সবচেয়ে যে জিনিসটি মূল্যবান, সেটি হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ। যে মানবিক মূল্যবোধ মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে। নতুবা মানুষ এবং পশুর মধ্যে আকৃতিগত পার্থক্য ছাড়া কোনো পার্থক্য নেই। মানুষের মধ্যে যখন ভিটামিনের অভাব হয়, মানুষ তখন পুষ্টিহীনতায় ভোগে, অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়। মানবিক মূল্যবোধে তেমনি একটি ভিটামিন আছে। আর তা হচ্ছে জ্ঞান। মানুষের জ্ঞান যখন লোপ পায় তখন মানবিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। যেমন দালানের ইটের গাঁথুনির জন্য সিমেন্টের প্রয়োজন। সিমেন্টের কার্যক্ষমতা যখন হ্রাস পায় তখন দালানটা ধসে পড়তে পারে। ঠিক তেমনি জ্ঞান কমে গেলে মানবিক মূল্যবোধ কমতে থাকে। জ্ঞানের অভাবে মানবিক মূল্যবোধ যখন অবক্ষয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তখন প্রেমের উপাদানগুলো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাছে ফরমালিন দেওয়া, ফলে ক্ষতিকারক স্প্রে দেওয়া, হোটেলে পোড়া মবিল দিয়ে মাছ ভাজি করে খাওয়ানো- এগুলো হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ। একজন জ্ঞানী লোক কখনোই এমন কাজ করতে পারেন না। কোনো অনৈতিক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেন না। বলছিলাম, মানবিক মূল্যবোধ যখন অবক্ষয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তখন প্রেমের উপাদানগুলো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবিক মূল্যবোধের পর মানুষের যে জিনিসটি মূল্যবান তা হচ্ছে প্রেম বা ভালোবাসা। প্রেম ভালোবাসা কিন্তু আদি রাষ্ট্রের উৎপত্তিরও একটি কারণ। ভালোবাসা হচ্ছে সুপার গ্লুুর মতো। ভালোবাসা এবং প্রেমের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। ফ্রয়েড, ফরেন, স্পেন্সার এই পার্থক্যটা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেননি বলে তারা ভালোবাসার মধ্যে জৈবিক বিষয়কে টেনে এনেছেন। আমি একটা পশুকে ভালোবাসি, আমি একটা পাখিকে ভালোবাসি, সেখানে কি কোনো জৈবিক ব্যাপার আছে? ভালোবাসার সংজ্ঞা দিতে না পারার কারণটা এখানে। ইংরেজিতে ভালোবাসা অর্থ হচ্ছে love. যেমন ও love my mother ও love my sister ও love my daughter. এখানে আমি আমার মাকে ভালোবাসি, আমার মেয়েকে ভালোবাসি। কিন্তু এটা বলা যাবে না যে আমি আমার বোনের সঙ্গে প্রেম করি। এখানে ভালোবাসা এবং প্রেমের সংজ্ঞা হবে দুটো। প্রেমের মধ্যে জৈবিক বিষয় রয়েছে, কিন্তু ভালোবাসার মধ্যে জৈবিক বিষয় নেই বলে ষড়াব শব্দটির মতো সবার ক্ষেত্রে ভালোবাসা শব্দটি ব্যবহার করা যায়। যেমন আমি আমার বান্ধবীকে ভালোবাসি, আমি আমার মেয়েকে ভালোবাসি। প্রেম শব্দটি কেবল প্রেমিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভালোবাসার মধ্যে ছ'টি বিষয় বা উপাদান রয়েছে। যেমন- মানসিক আকর্ষণ, কল্যাণ কামনা, স্বার্থ, জ্ঞান, আবেগ এবং ইচ্ছা। এর একটিও অনুপস্থিত থাকলে সেখানে ভালোবাসা হবে না। জ্ঞানটা ভালোবাসার মধ্যে কেন আসছে? যেমন- একটি রাস্তা দিয়ে ১০টি মেয়ে প্রতিদিন কলেজে যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি মেয়েকে আমার ভালো লেগেছে। যে মেয়েটি দেখতে কুৎসিত। কিন্তু এই মেয়েটির এমন একটি গুণ আছে যা হাজারটির মধ্যে নেই। এখানে জ্ঞান বিশ্লেষণ করবে মেয়ের রূপ সৌন্দর্য ভালো লাগবে, নাকি গুণ ভালো লাগবে। এই ছয়টি বিষয়কে নিয়ে ভালোবাসা। প্রেমিকার ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত বিষয় বা উপাদান হচ্ছে দৈহিক কামনা। বলছিলাম, মানবিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের কারণে প্রেমের উপাদানগুলো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে মানবিক মূল্যবোধের মধ্যে যেমন জ্ঞান রয়েছে তেমনি ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে জ্ঞান। ভালোবাসার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে আবেগ। আবেগ বেগ সৃষ্টি করে। মধ্যরাতে প্রেমিকের ঘুম ভাঙিয়ে দেয় প্রেমিকার সানি্নধ্য পাওয়ার জন্য। প্রবাসী সন্তানের জন্য মা কাঁদেন এ আবেগের জন্য। জ্ঞানের অভাবে এ আবেগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। আবেগ হচ্ছে ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো। ট্রেনের ইঞ্জিন যে গতিতে সামনে যেতে পারে, ঠিক তেমনি একই গতিতে পেছনে যেতে পারে। আবেগ যেমন অন্যকে উপকারে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, আবেগ তেমনি অন্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে। আবেগ যখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ সময় ভালোবাসা কমে যাবে। ফলে স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে, ভাই ভাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কারণে হত্যা করতে পারে। যে সন্তান তার জন্মদাতা পিতাকে ভালোবাসে সে কি পারে অসুস্থ পিতাকে হাসপাতালে না নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে যেতে? কোনো সন্তান পারে বৃদ্ধ মাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে তার টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যেতে। সমাজে এমন ঘটনা যখন ঘটে দর্শনের একজন গবেষক হিসেবে তখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোনো সীমা থাকে না। আগামীতে কী ঘটতে যাচ্ছে এ বিষয়টি আমরা অনুধাবন করতে পারি? এ শতাব্দীতে কী ঘটবে, এটা ভাবতে গেলে পুরো দেহ হিমশীতল হয়ে যেতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে কিছু বললে অনেকের মধ্যেই ফ্রাস্ট্রেশন দেখা দিতে পারে, আত্মহত্যার প্রবণতা জাগতে পারে। তবুও এর উত্তরণের জন্য আমাদের করণীয় কি এ বিষয়টি এখনই ভাবতে হবে। বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্য থেকে জ্ঞানের লেভেল কমে যাচ্ছে। কীভাবে মানুষের মধ্যে জ্ঞান বৃদ্ধি করা যায় এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। কোন জ্ঞান? যে জ্ঞান মানবিক মূল্যবোধকে বৃদ্ধি করবে। জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে নৈতিকতা, সততা বৃদ্ধি পাবে। মানুষের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। যে ভালোবাসা সিমেন্টের মতো সভ্যতাকে অাঁকড়ে ধরে রেখেছে। যেদিন ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে, সেদিন সমাজ আর সমাজ থাকবে না। মানুষ হয়ে যাবে পশু সমতুল্য।

লেখক : দার্শনিক।

 

সর্বশেষ খবর