বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

উগ্রবাদীদের দৌরাত্ম্য আর কতকাল?

রণেশ মৈত্র

উগ্রবাদীদের দৌরাত্ম্য আর কতকাল?

মুক্তবিবেকের কণ্ঠস্বর ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার রেশ না কাটতেই প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর ব্যস্ত রাজপথে কুপিয়ে হত্যা করা হলো ওয়াশিকুর রহমান বাবু নামের এক ব্লগারকে। অভিজিৎ এবং তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার ওপর জঙ্গিবাদীর হামলার জন্য কাউকে শাস্তি পেতে না হওয়ায় তারা তাদের ছোঁবল আরও বিস্তার ঘটানোর সাহস পেল। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্ত বিবেকের বিরুদ্ধে মানবতার শত্রুরা অস্ত্র ধরেছিল বেশ আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিবাদী শিক্ষক ও লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইউনুস শুধু প্রগতিশীল চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি নীতিনিষ্ঠ থাকার কারণে নির্মমভাবে খুনের শিকার হয়েছিলেন।

করুণ কাহিনীর সমাপ্তি এখানেই নয়। ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ ও সদ্য খুন হওয়া ওয়াশিকুর রহমান বাবুর 'অপরাধ'ই তো দৃশ্যত এক। তিনজনই ব্লগার এবং প্রগতিবাদী লেখালেখির সঙ্গে জড়িত।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইউনুস, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, গোপীবাগের সিক্স মার্ডার, ব্লগার আশরাফুল ইসলাম, চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী, উত্তরায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাশিদুল এবং ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং বাবুর হত্যাকাণ্ডের ধরন একই। ব্লগার আসিফ হুমায়ুন ও ব্লগার রাকিবের ওপর হামলার ঘটনাও একই কায়দায় সংঘটিত হয়। এসব ঘটনায় ক্ষুদ্রাস্ত্রের পরিবর্তে খুনিচক্র অত্যন্ত ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এমন ব্যক্তি হামলার শিকার হলেও সবার উপর হামলার ধরন ছিল একই। মূলত গলা থেকে দেহের ঊর্ধ্বভাগ অর্থাৎ মাথাই ছিল আক্রমণকারীদের লক্ষ্যবস্তু। এসব হত্যাকাণ্ডে জেএমবি ও উগ্রপন্থি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সম্পৃক্ততার বিষয় না-কি তদন্তকালে বারবার উঠে আসছে। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড হয়েছে হয় ডিসেম্বর নয়তো ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। উল্লেখ্য, ডিসেম্বর বাঙালি জাতির বিজয়ের মাস, ফেব্রুয়ারি আমাদের ঘরে ফেরার মাস, মার্চ স্বাধীনতার মাস- আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাবোধ জাগ্রত ও ব্যক্ত হওয়ার মাস। তাই বুঝতে আদৌ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, হত্যাকারীরা ঘোরতর সাম্প্রদায়িকতাবাদী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের কট্টর বিরোধী।

ব্লগার অভিজিত রায়ের নির্মম হত্যালীলায় সমগ্র জাতি ব্যথিত, শোকাহত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু সরকারি মহল নিশ্চুপ থাকায় হত্যাকারীরা অনেকটাই নিরুদ্বেগ বলে মনে হয়। মনে পড়ে গেল, প্রথম ব্লগার হত্যাকাণ্ডের শিকার আহমেদ রাজীব হায়দার গুরুতরভাবে আহত হওয়ার পর সরকারি মহলের মন্তব্য খুনিদেরই প্রকারান্তরে উৎসাহিত করেছিল। তারপর থেকে তারা মৌনতা পালন করে চলেছেন। অধ্যাপক ইউনুস হত্যার ব্যাপারে অবশ্য দুজন জঙ্গির ফাঁসির আদেশ হয়েছে, একটির মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। অপরটির? একটি বাদে বাকিগুলোর আসামিরা দীর্ঘকাল যাবৎই ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিজিতের বাবা শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অজয় রায় কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও পরিচিত। তিনি সরাসরি অভিজিৎ হত্যার ব্যাপারে ইসলামী জঙ্গিদের দায়ী করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, তার পুত্র হত্যার ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীও জড়িত- যারা নিত্যদিন নাশকতা করছে, পেট্রলবোমা মেরে মানুষ ও গাড়ি পুড়িয়ে মারছে। তিনি অভিযোগ করেন, অভিজিৎ হত্যার সব কিছুই পুলিশের নখদর্পণে, আসামিদের ধরতে পুলিশের ২৪ ঘণ্টাও লাগবে না। কিন্তু প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের। এ কথা বলে তার পুত্র হত্যার আসামিদের গ্রেফতারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠন তাদের টার্গেটকে হত্যা করে ই-মেইল বা ইদানীং আরও প্রযুক্তিগত উন্নত যোগাযোগ মাধ্যমে তার স্বীকারোক্তি প্রচার করে থাকে। বিগত কয়েক বছর যাবৎই তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার দুই আসামি ধরা পড়ায় খুনিচক্র সঙ্গত কারণে নিশ্চুপ। কিন্তু অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার পর এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দফায় দফায় তার স্বীকারোক্তিই শুধু করা হয়নি- এক অস্বাভাবিক রকমের বিকৃত এবং বর্বরোচিত উল্লাস প্রকাশ করে তাও জনগণকে অবহিত করা হয়েছে। যেন তারা দিগ্বিজয় করেছে। এটা মর্মান্তিক এবং কার্যত কাপুরুষোচিত। এই উল্লাস কি আমাদের সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে তাদের কর্তব্যে তৎপর করে তুলতে সক্ষম হবে। তাদের এতদিনের দুঃখজনক গড়িমসির কি সমাপ্তি হবে?

বাংলাদেশে জঙ্গিবিরোধী সরকারি অভিযান কি পর্যায়ে রয়েছে- প্রশ্নটি নিশ্চয়ই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এ কথা অবশ্যই সত্য যে, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে শুরু করে সরকার সংশ্লিষ্ট সবাই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বা জঙ্গিবাদীদের উত্থানের কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করতে শোনা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও প্রায়শ সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মধ্যে কাউকে কাউকে অস্ত্রসহ গ্রেফতারও করছে; কিন্তু দেখা যায়, দুর্বল পুলিশ রিপোর্টের কারণে অনেকেই জামিনে মুক্তি পেয়ে বাইরে এসে আবারও জঙ্গিবাদী ক্রিয়াকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। এরূপ উদাহরণ খুব একটা কম মনে করার কারণ নেই। সে কারণে উদ্বেগের মাত্রাও বাড়ছে।

মানুষের মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যায় যখন জানা যায়, দেশের নানা স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ, পেট্রলবোমা এবং তা তৈরির প্রভৃতি সরঞ্জামাদি উদ্ধার হচ্ছে। জানা যাচ্ছে, বিশেষ বিশেষ এলাকার বিশেষ ধরনের বাড়ি ভাড়া নিয়ে জঙ্গিরা ওগুলো তৈরি ও সংরক্ষণ করছিল। এগুলোর সঙ্গে ধরাও পড়ে স্বল্পসংখ্যক জঙ্গি। কিন্তু কারও শাস্তি হওয়ার খবর কদাপি প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ শাস্তির বালাই নেই- শেষ শুনানি পর্যন্ত ওই মামলাগুলো বিচারাধীন থাকে নাকি প্রত্যাহৃত হয় নানা অজুহাতে, তাও জানা যায় না। চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকা, কক্সবাজার প্রকৃতির সীমান্ত এলাকাগুলোতেও ভয়ঙ্কর অস্ত্রাগারে বা অস্ত্র চোরাচালানির কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে এমন দাবি কি খুবই অযৌক্তিক হবে? অপরাপর এলাকাও কি এ জাতীয় ঘটনা থেকে মুক্ত? না, মোটেও তা নয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, গোবিন্দগঞ্জ, শিবগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের বহু এলাকায়ও প্রায়শ এমন দ্রব্যাদি উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। লক্ষণীয় যে, স্থানগুলো সবই সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চয় বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করছে এবং এলাকাগুলো যত দুর্গম বা ঝুঁকিপূর্ণই হোক, তাতে নিরন্তর অভিযান চালিয়ে যেতেই হবে দেশ ও জনগণের শান্তি এবং নিরাপত্তার স্বার্থে।

আমাদের ক্ষমতাসীনরা জঙ্গি দমনের ব্যাপারে বস্তুত কেমন ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন তা অত্যন্ত দুর্বোধ্য বলে মনে হয়। তারা জঙ্গিদের মদদদাতা হিসেবে তাদের স্তাবকতায় সর্দাসর্বদা লিপ্ত কতিপয় লেখক-বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে এক বাক্যে বিএনপিকে দায়ী করতে গিয়ে বলছেন বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে। আমিও এ দাবির স্বপক্ষে অতীতেও লিখেছি, এখনো লিখছি। কিন্তু যে জামায়াতে ইসলামী প্রত্যক্ষভাবে জঙ্গিবাদী ক্রিয়াকলাপে ভয়াবহভাবে সদাসর্বদা লিপ্ত- তারা আজও এ দেশের মাটিতে বৈধ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কাজ করছে কীভাবে? প্রশ্নটি বারবার নানাভাবে উত্থাপিত হচ্ছে কিন্তু চূড়ান্ত উত্তরের ক্ষেত্রে সরকার কেন যেন নীরব। জামায়াতে ইসলামীর মতো সংগঠনের বাংলাদেশের মাটিতে বৈধ সংগঠন হিসেবে কাজ করার কোনো অধিকার না থাকা সত্ত্বেও এবং বারবার নানা মহল থেকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি উত্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও সরকার যেন স্থির করেই উঠতে পারছে না, কীভাবে তা করা হবে। বস্তুত, এ ব্যাপারে তাদের সর্বশেষ বক্তব্য হলো- জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ ঘোষণা করাটাই সর্বোত্তম। এক বছর ধরে তারা এ কথা বলে চলেছেন এবং সে লক্ষ্যে আইন সংশোধনের কথাও বলেছেন।

কিন্তু মাত্র বছর তিনেক আগে যখন সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের কিছু সংশোধনীকে বেআইনি বলে ঘোষণা করলেন- ল্যাঠা তো সেখানেই চুকে গিয়েছিল। কিন্তু সরকার তৎক্ষণাৎ পঞ্চদশ সংশোধনী এনে ওগুলোকে পুনরায় বৈধতা দিল। খুশি করল জামায়াত, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে। ক্ষুব্ধ করলেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে নিষ্ঠাশীল সব দল ও ব্যক্তিকে। এখন প্রশ্ন তো করাই যেতে পারে, সংবিধান সংশোধন করে যে দলকে বৈধতা এই সরকারই দিল তাকে আর এক সংশোধনী এনে অবৈধ বা বেআইনি না করে দায়-দায়িত্ব আদালতের কাঁধে পুনরায় চাপানো হচ্ছে কেন? সর্বোচ্চ আদালত তো রায় দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল বছর কয়েক আগে- কেন তার প্রতি মর্যাদা দেওয়া হলো না। আবার যদি আদালত বেআইনি ঘোষণা করেও- তা যে সরকার মানবেই তারই-বা নিশ্চয়তা কোথায়? এ ছাড়া আদালতের রায় যে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার অনুকূলে হবেই তা জোর করে বলা যায় কি? যদি তা না হয় তবে সরকারকে তো আপিল করতে হবে। আপিলে কি রায় হবে তা-ই বা অগ্রিম বলা যাবে কেমন করে? কিন্তু আইনমন্ত্রী যেভাবে বলছেন তাতে মনে হয় আদালত জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা যে করবেনই- তিনি অন্তত সে ব্যাপারে নিশ্চিত। কিন্তু আমরা নিশ্চিত হতে পারি না, কারণ আদালত কি করবেন তা নির্ভর করবে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গৃহীত আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর। এখন বলতে চাই বিষয়টি অনিশ্চিত। তদুপরি অত্যধিক সময়সাপেক্ষও বটে। কারণ ট্রাইব্যুনালের বিচারে এবং তার রায় হতে হতে অন্তত দু-তিন বছর লাগার আশঙ্কা। অতঃপর যে পক্ষই সুপ্রিমকোর্টে আপিল করুক- বছর দুয়েক তো সেখানেও লেগে যেতে পারে।

সরকারের উচিত চলমান অধিবেশনেই নতুন একটি সংশোধনী এনে জামায়াতে ইসলামী, তার সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, সব ধর্মাশ্রয়ী দল প্রভৃতিকে বেআইনি ঘোষণা করা। এর চেয়ে সহজ এবং নিশ্চিত পদ্ধতি আর কোনো কিছু হতে পারে না। অবশ্য সরকারের মতলব যদি ভিন্ন কিছু থাকে তা হলে ভিন্ন কথা। দেখা যাক, তারা শেষ পর্যন্ত কি করেন? বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অনুকূলে এনে নতুন সংশোধনীতে এগুলো নিষিদ্ধ করেন, না কি জিয়া-এরশাদের নীতি-আদর্শে ওগুলোকে বৈধতা দিয়েই জীবিত রেখে জঙ্গিবাদের উত্থানের পথ সুগম রাখেন।

আমরা জানছি সংবাদপত্রের মাধ্যমে জামায়াত ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা একই কায়দায় ১৬ জনকে খুন করল স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। ওয়াশিকুর রহমান বাবু তাদের একজন। জানি না বাবু শেষ টার্গেট কিনা- জানি না অতঃপর এই নির্মম হত্যালীলার সমাপ্তি ঘটবে কিনা। কিন্তু জঙ্গিবাদের কার্যকলাপ আর সরকারের পদক্ষেপগুলো সে ব্যাপারে কাউকেই আশ্বস্ত করতে পারছে না।

লেখক : রাজনীতিক।

 

 

সর্বশেষ খবর