আগামী ২৮ এপ্রিল দেশের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ার সময় অতিক্রম হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে অবশ্য আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেনি। বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন অনেকটা অনায়াসেই। সে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি, নাগরিকরা পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়নি- এমন সব কথা তখন খুব বেশি শোনা যায়নি। একতরফা নির্বাচনে সাদেক হোসেন খোকা নির্বাচিত হয়ে প্রায় দুই মেয়াদের সময়কাল পর্যন্ত ঢাকার মেয়রগিরি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ঢাকার মেয়র নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়নি। তারপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেও বিএনপির মেয়রকেই মেনে নিয়েছে, নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করেনি। এক সময় আকস্মিকভাবে ঢাকা সিটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। নগরবাসীর কাছে সিটি করপোরেশনের সেবা সহজলভ্য করার জন্যই ঢাকাকে উত্তর ও দক্ষিণ- দুই ভাগে ভাগ করার যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সাদেক হোসেন খোকার মেয়র পদ চলে যাওয়া ছাড়া ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্ত করার আর কোনো সুফল মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি। দুই সিটি করপোরেশনে দুজন অনির্বাচিত প্রশাসক বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ব্যবস্থা দ্রুততম সময়ের মধ্যে করে দুজন নির্বাচিত মেয়রের হাতে নগর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু তারপরও কয়েক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যান্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। সেসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা হেরেছেন। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা তথা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে প্রবল রাজনৈতিক বৈরিতা, প্রতিরোধ-প্রতিবাদ উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হতেও কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু বাধা হয়েছিল শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই এখন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশের পরই নির্বাচন আয়োজনের সব বাধা দূর হয়ে যায়। নির্বাচন কমিশন দ্রুততার সঙ্গেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। শুধু দুই সিটি নয়, মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছু আগেই একই দিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনও হবে। তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের তৎপরতা শুরু হয়েছে। নির্বাচন হওয়া নিয়ে বিকল্পধারার সভাপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ দু-একজন রাজনীতিবিদ সংশয় প্রকাশ করলেও হাওয়া দেখে মনে হচ্ছে ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন হবেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেটা চান সেটা যে হয়ই, সে অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। দলের দু-একজন নেতা নির্বাচন এ সময়ে কেন হচ্ছে, নির্বাচনে সরকার সমর্থক প্রার্থীরা পরাজিত হলে কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছেন, নির্বাচন হবেই এবং মাঝেমাঝে পরাজিত হওয়ার জন্যও নির্বাচন করতে হয়। অত্যন্ত মূল্যবান কথা। নির্বাচন হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর নির্বাচনে হার-জিৎ দুটোই আছে। একটি পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একাধিক প্রার্থী কিন্তু জয়লাভ করে একজনই। জয়-পরাজকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়াই গণতান্ত্রিক রীতি।
দেশে বিরাজমান এক অস্বস্তিকর সময়েই গুরুত্বপূর্ণ তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হচ্ছে। গত ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা টানা অবরোধ-হরতালে জনজীবনসহ দেশের অর্থনীতি কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছে। অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি দিয়ে এবার যেভাবে দেশের নিরীহ সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস-ট্রাক-ট্রেনে পেট্রলবোমা-ককটেল নিক্ষেপ করে যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তা এক কথায় অকল্পনীয়। আমাদের দেশ আন্দোলনের দেশ। আমাদের দেশের মানুষের রয়েছে অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতা। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামের নামে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যার অভিজ্ঞতা অতীতে কখনো হয়নি। এবার আন্দোলনের নামে কার্যত গণহত্যা চালিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট এমন একটি নজির স্থাপন করেছে, যা ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মানুষের জীবন ও সম্পদকে বিপন্ন ও ধ্বংস করে আগাম নির্বাচনের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা যাবে বলে বিএনপি-জামায়াত জোট মনে করেছিল। তারা ভেবেছিল একের পর এক মানুষ মারা যেতে থাকলে, বাসে-ট্রাকে-ট্রেনে আগুন দেওয়ায় পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলে, উৎপাদন ব্যাহত হলে, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকারের কোনো উপায় থাকবে না দাবি না মেনে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে, সন্ত্রাস-সহিংসতার কাছে কোনো দেশের কোনো সরকারই নতি স্বীকার করে না, করতে পারে না। শেখ হাসিনার সরকারও বোমা-সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ না করে শক্ত হাতে সব ধরনের নাশকতা মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। দেশের পরিস্থিতি এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। অবরোধ-হরতাল মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। অতীতেও শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বেগম জিয়া কোনো সাফল্য পাননি; এবারও পাবেন, সে আশা দূরাশা ছাড়া কিছু নয়।পৌনে তিন মাস ধরে তথাকথিত অবরোধ-হরতাল চালিয়ে, ১৩৩ জনের মতো নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে বেগম জিয়ার 'আন্দোলন' যখন মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম, তখনই সামনে এসেছে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক কৌশলে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার যেমন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে, তেমনি হঠাৎ করে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়েও সরকার এবং সরকারি দল সুবিধাজনক অবস্থায়ই আছে। সন্ত্রাস-সহিংসতানির্ভর আন্দোলন করতে গিয়ে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি এখন বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য নেতা-কর্মীর নামে নাশকতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা হয়েছে। কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন, অনেকেই আত্মগোপনে আছেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। তারপরও বিএনপি তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের পরামর্শেই মূলত বেগম জিয়া নির্বাচনের প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে বলেই গণমাধ্যমে খবর ছাপা হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়ার প্রশ্নে মতভিন্নতা আছে। নির্বাচনে অংশ নিলে কী লাভ আর না নিলে কী ক্ষতি সে হিসাব-নিকাশ চলছে। তবে বিএনপি নেতৃত্বের একাংশ এবং বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের বড় অংশই আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন। টানা অবরোধ-হরতালের নামে সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে দলটি সরে গেছে কি-না সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির কর্মকাণ্ডকে জঙ্গিবাদী বলে অভিহিত করা হচ্ছে। বিএনপি একটি জঙ্গিবাদী দল- এ বিশ্বাস মানুষের মনে দৃঢ়মূল হলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক রাজনীতি করা বিএনপির পক্ষে দুরূহ হবে। বিএনপির মাথা গরম নেতারা এটা না বুঝলেও বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই যে তা বুঝতে পারছেন, সেটা স্পষ্ট হচ্ছে শত নাগরিক কমিটির তৎপরতা দেখেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. এমাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বিএনপি সমর্থক পেশাজীবীদের সংগঠন শত নাগরিক কমিটি সিটি নির্বাচনের বিষয়ে শুরু থেকেই ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করেছে। বেগম জিয়ার সঙ্গে ড. এমাজউদ্দীন একাধিকবার বৈঠক করেছেন। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি জানাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনে গিয়েও কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে তিন সিটি করপোরেশনেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। চট্টগ্রামে বিএনপি সমর্থিত নাগরিক সংগঠন চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের পক্ষ থেকে বর্তমান মেয়র এম মনজুর আলমকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার পর চট্টগ্রামের বিএনপির কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষ নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং আবদুল্লাহ আল নোমানও মনজুর আলমের প্রতি প্রকাশ্যেই বিএনপির সমর্থন জানিয়েছেন। মনজুর আলম মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। বলা যায়, চট্টগ্রামে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন শুরু করে দিয়েছে। ঢাকায়ও এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হচ্ছে না।
সিটি করপোরেশনে দলীয় নামে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে হওয়ার কথা। কিন্তু এটা এখন কাগজে-কলমের ব্যাপার। বাস্তবে সব নির্বাচনই এখন দলীয়ভাবেই হয়ে থাকে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও শুধু দলীয় প্রতীক ব্যবহার ছাড়া আর সবকিছুই হয়ে থাকে দলীয়ভাবে। দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়, নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হয় দলীয়ভাবে। ভোটাররাও জানেন, কোন প্রার্থী কোন দলের। এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তিন সিটি করপোরেশন মেয়র পদে তিনজন নতুন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে চমক দিয়েছেন। চট্টগ্রামে তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছির, ঢাকা উত্তরে ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের পুত্র সাঈদ খোকনকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যত অন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের এই সংকেতই দিয়েছেন যে, তার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে লাভ হবে না। চট্টগ্রামে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী যারা ছিলেন তাদের সবাইকে গণভবনে ডেকে প্রধানমন্ত্রী আ জ ম নাছিরের পক্ষে কাজ করতে বলেছেন। সবাই তা মেনেও নিয়েছেন। প্রভাবশালী সম্ভাব্য প্রার্থী, সাবেক মেয়র ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী নাছিরের পক্ষে প্রচারে নামবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মো. সেলিম। তিনি এখন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে মেয়র পদে লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে তিনি মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে লড়তে চেয়েছিলেন মিরপুরের সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার। তবে তিনি খুব বেশি অগ্রসর হননি। আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী ঢাকা উত্তর থেকে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও তিনি শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন কিনা বলা মুশকিল।
গত ২৭ মার্চ গণভবনে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের এক বিশেষ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনিসুল হক ও সাঈদ খোকনকে মাঠ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে দল-সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'দুই প্রার্থীকে আপনাদের হাতে তুলে দিলাম। তাদের বিজয়ী করার দায়িত্ব আপনাদের।' প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী দল-সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে আন্তরিকভাবে কাজ করবেন কিনা, সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। দৃশ্যত সবাই দল-সমর্থিত প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করার কথা বললেও ভিতরে ভিতরে অন্যরকম ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলেই নেতৃত্বের মধ্যে বিভেদ-কোন্দল গ্রুপিং আছে। একটি নির্দিষ্ট পদে প্রার্থী হওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি দুই দলেই একাধিক আছেন বা থাকেন। কিন্তু দল তো একজনের বেশি সমর্থন বা মনোনয়ন দিতে পারে না। সেজন্য নির্বাচনের সময় দুই দলেই প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কলহ-বিবাদ দেখা যায়। নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হলে দেখা যায় বিএনপিতে শেষ পর্যন্ত বিভেদ খুব একটা থাকে না। দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়ে থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। নির্বাচন এলে তাদের অনৈক্য বাড়ে। প্রার্থী মনোনয়ন যে ঠিক হয়নি সেটা বোঝানোর জন্য দলীয় প্রার্থীর পরাজয় নিশ্চিত করার জন্য ভোটের দিন পর্যন্ত বিরোধিতা জারি রাখা হয়। এবার তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হলেই ভালো।
ঢাকা উত্তরে ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, দক্ষিণে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস এবং চট্টগ্রামে এম মনজুর আলমকে মেয়র পদে সমর্থন দিয়ে তিন সিটি নির্বাচনে নেমে পড়লেও বিএনপির দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়নি। ঋণ খেলাপির অভিযোগে আবদুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় গভীর সংকটে পড়েছে বিএনপি। মিন্টুর পুত্রের মনোনয়ন বহাল থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি কতটা সুবিধা করবেন তা নিয়েও সংশয় কম নয়। নির্বাচনী প্রচারণায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না হলে নির্বাচন থেকে সরে আসার অপশন রেখেই সম্ভবত অগ্রসর হচ্ছে বিএনপি। আন্দোলন এবং নির্বাচন দুটোই তারা পাশাপাশি করবে। বিএনপির এ দ্বিমুখী কৌশল স্পষ্ট হয়েছে ২৫ মার্চ ২০-দলীয় জোটের এক বিবৃতিতে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'আন্দোলনের গতিধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আরেকটি প্রতারণামূলক নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন তথা সরকার। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যে তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে, তা গোটা দেশবাসীর ইচ্ছার সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।'
২০-দলীয় জোটের এই বক্তব্য ইঙ্গিতপূর্ণ। নির্বাচন প্রতারণামূলক হবে কিংবা এটা যদি তামাশাই হয় তাহলে বিএনপি এ নির্বাচনে শামিল হচ্ছে কেন? বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী করবে সেটা বোঝার জন্য সম্ভবত আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ শেষ পর্যন্ত থাকলে কী হবে এবং না থাকলে কী হতে পারে, সে আলোচনা পরবর্তী সময়ে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট