মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

বুদ্ধির ঠিকানা সন্ধানে

আবু তাহের

বুদ্ধির ঠিকানা সন্ধানে

মানবদেহের কোথায় বুদ্ধি থাকে, জানার ভারি আগ্রহ আমার। চারদিকে এত বুদ্ধিমান, তাদের এত নর্তন-কুর্দন, এত আস্ফালন, তাদের তুলনায় আমার বুদ্ধি কতটা কম তা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে আন্দাজ করতে চাই। সেজন্য তো বুঝতে হবে 'বস্তু'টা কোথায়।

'ছুঁয়ে দেখবে! পাগল নাকি?' বলেন সিনিয়র সহকর্মী কামরুল হুদা, 'বুদ্ধি থাকে মগজের কোষে। ডাব যেভাবে কাটে মাথার খুলিটা সেভাবে কাটলে পর মগজ ছুঁয়ে দেখা যেতে পারে। ওই কাজ করতে গেলে তো মরেই যাবে।'

মগজেই থাকে বুদ্ধি, এরকম ধারণা পোষণ করছিলাম। হঠাৎ নতুন তথ্য পেয়ে যাই। বুদ্ধি থাকে মানুষের পেটে। বিখ্যাত লোকসাহিত্য গবেষক অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন (মৃত্যু : ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭) ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সম্মেলনে এক বক্তৃতায় নিজেকে নিয়ে মশকরা করায় তথ্যটি পেয়ে গেলাম। এই জ্ঞানতাপস মারা যান ৮৩ বছর বয়সে। ডিইউজের অনুষ্ঠানে যখন এলেন তখন তার ৭৯ চলছে। ওখানেই তাকে প্রথম দেখি।

শীর্ণদেহী রোগাটে পলকা। হাঁটতে কষ্ট। সঙ্গে আসা কিশোরী নাতনি আর ডিইউজে সভাপতি আনোয়ার জাহিদ তাকে দু'পাশ থেকে ধরে ধরে সন্তর্পণে মঞ্চে উঠিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেন। মনে মনে বলি, এর তো দেখি প্রাণ যায় যায়। ভাষণ দেবেন কীভাবে! কিন্তু ওরে আল্লা! দেখি কি বক্তৃতার সময় অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন বিলকুল টগবগে নওজোয়ান। তেজি কণ্ঠস্বর, ঋজু উচ্চারণ, চিত্তভেদী বাক্য। বললেন, 'সাংবাদিকদের পেটে বুদ্ধি বলে কোনো বস্তু যদি থাকত তাহলে তারা আমার মতো আহাম্মককে চিফ গেস্ট করতেন না।'

তিনি জানান, সমাজ বদলের জন্য সাংবাদিকরা তাদের লেখনী চালিয়ে যাচ্ছেন জানতে পেরে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এ অনুষ্ঠানে এসে তার মোহভঙ্গ হয়েছে। অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন বলেন, 'নির্ধারিত সময়ের দু'ঘণ্টা পরে যারা অনুষ্ঠান শুরু করেন তাদের তো উচিত আগে নিজের স্বভাব বদলানো। কাজ আর কথার মধ্যকার অমিল দূর করার গুরুত্ব বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ১০টার ট্রেন সোয়া ১০টায় ছাড়লে সহ্য হয়, ১২টায় ছাড়লে যাত্রীর মনে হত্যাপ্রবৃত্তি জাগে।

প্রগতির পথে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করে যারা ওই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছিলেন তাদের উদ্দেশে অধ্যাপক বলেন, রশির বন্ধন ছিন্ন করা বিনা প্রগতি আসে না। তুরস্কে মুস্তফা কামাল যেভাবে করেছিলেন সেভাবে পাঁচ রশি, সাঁত রশি, দশ রশি যত রশি আছে চুরমার করা চাই। ... বেলা বাজে দুটো। এখন ভাষণ ঢুকবে না কানে, খাদ্যগন্ধ বার বার শুধু টানে।

অনুষ্ঠান মণ্ডপের খুব কাছেই মুরগি-পোলাউ রান্না হয়েছে সম্মেলনে আগতদের জন্য। খাদ্যগন্ধ খিদে উসকে দিচ্ছিল। মনসুরউদ্দিন ভাষণ শেষ করার আগে বললেন, 'রোজ যে পরিমাণ ভেজালদ্রব্য খাওয়া হচ্ছে তাতে মরে দীর্ঘ হওয়া যায়, আয়ু দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবু ভদ্রতা রক্ষার্থে প্রার্থনা করি- আপনারা দীর্ঘায়ু হোন।'

একাত্তরে পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের শহরটা দখল করে নেওয়ায় পালিয়ে গেলাম কেশরপাড় নামক গ্রামের ডাক্তারবাড়ি। ওই বাড়ির প্রধান পুরুষ ডাক্তার নূরুজ্জামান চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র বাবুল মানে শামসুজ্জামান চৌধুরী সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, 'খাওয়া-শোয়া কোনো সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে নিজের জীবন নিজে রক্ষা করা। মিলিটারি গ্রামে গ্রামে হানা দিতে শুরু করেছে। এখন শরীরে যত বুদ্ধি আছে সব অ্যাপ্লাই কর। জান বাঁচাও।'

আমার মতো জনাপাঁচেক আশ্রয় নিয়েছিল ডাক্তারবাড়িতে। আমাদের খেদমত করার জন্য নিযুক্ত হয় ভেরু নামের এক তরুণ। প্রকৃতপক্ষে তার নাম ভেড়ু। 'ভেড়া' বললে সে রুষ্ট হয়, তাই আদুরে নাম ভেরু। কেননা 'ভেড়ু' বললেও সে বুঝে ফেলে এবং রেগে আগুন হয়ে যায়। অথচ এ বাড়ির সবাই মনে করে 'ভেরু-গাধা ভাই ভাই/দুজনারই মাথায় বুদ্ধি নাই'।

পরীক্ষা করে সেরকম অনেকটা দেখাও গেছে। ভেরু বাজারে যায় ১০০ টাকা নিয়ে। চা-পাতা, চিনি, কনডেন্সড মিল্ক, সিগারেট, দেশলাই ইত্যাদি কিনে আনে। এতে খরচ হয় ৭৭ টাকা। আমরা বললাম, খরচ হয়েছে ৬০ টাকা। সে আমাদের কথাই বিশ্বাস করল। প্রশ্ন করা হয়, 'একশ টাকার মধ্যে ষাট টাকায় কেনাকাটা হলে তুমি কত ফেরত পাবে।' ভেরু বলে, 'পঞ্চাশ টাকা'। আমরা জানাই যে তাকে তেইশ টাকা ফেরত দিয়েছে দোকানি। ভেরুর প্রশ্ন, 'কম দিছে না বেশি দিছে?' যে-ই বলা হলো, 'কম দিয়েছে' অমনি বাজারমুখো দৌড় মারল ভেরু। দৌড়তে দৌড়তে বলল, 'আইজ ট্যাগরা বৌদ্দারে মার্ডার! য়্যাত্ত বড় সাহস! আমারে ঠগায়।'

মুদি দোকানির নাম বদি। লোকটা একটু ট্যারা। স্থানীয় ভাষায় 'ট্যাগরা বৌদ্দা' হয়ে গেছে। তার দোকানে হাজির হয়ে ভেরু বলে, 'পঞ্চাশ টাকার জায়গায় তেইশ টাকা দিছেন ক্যান। মনে করছেন হিসাব বুঝি না! দেন, পুরা টাকা দেন।' বদি মজা পেয়ে বলে, তেইশ তো পাইছস। আর কত দিলে পঞ্চাশ হবে? ভেরু বলে, 'এই হিসাবও যদি না পারেন, দোকানদারি করেন কিয়েল্লাই?'

আরও ২৭ টাকা দিলে ৫০ টাকার মিল হবে, এটা ভেরু জানে না। তাই সে চালাকির আশ্রয় নিয়ে বদির সঙ্গে ডাঁট দেখায়। বাধ্য হয়ে এরকম ডাঁট আমিও দেখিয়েছি আমার ছাত্রছাত্রীকে। ডিগ্রি ক্লাসে থাকতে টিউশনি করি। এক ম্যাজিস্ট্রেটের পুত্র-কন্যাকে পড়াই। ইংরেজি-বাংলা-অঙ্ক। ভাইবোন দুজনই ব্রিলিয়ান্ট। এত ব্রিলিয়ান্ট যে ওদের কাছে আমার পাঠ নিলেই মানাত। ইংরেজি-বাংলা কোনোমতে সামাল দিতে পেরেছিলাম। অঙ্ক?

কঠিন কোনো অঙ্ক করে দিতে বললে ছেলেটিকে বলতাম, 'ক্লাস এইটের ছাত্র। এই সামান্য অঙ্কটা পার না! তোমার লজ্জা হওয়া উচিত মুন।' মুনের বোনকেও একই কায়দায় বলতাম, 'সেভেনের ছাত্রী এই ফালতু অঙ্কটা পার না বলতে তোমার লজ্জা করে না ডুরি?' ওদের বলতাম, 'আজ রাতভর চেষ্টা কর। কাল দেখব কী করা যায়।' এই ফাঁকে বন্ধুদের কাছ থেকে শিখে নিয়ে গিয়ে পরদিন মুখস্থবিদ্যা জাহির করে গণিত বিশেষজ্ঞ সেজেছি বহুদিন। সাজতাম আর ভাবতাম, আমি কত বুদ্ধিমান! কী চমৎকার ধাপ্পা দিয়ে চলেছি!

১৯৭৮ সালের দিকে প্রকৌশলী হয়ে বেরোয় মুন (আশফাকুর রশিদ)। বুয়েটের ছাত্র থাকাকালে মুন যোগাযোগ করত আমার সঙ্গে। একদিন কথায় কথায় বলল, 'অঙ্ক যে মুখস্থ করে আসতেন, আমি আর ডুরি তা বুঝতাম স্যার। আমরা যে বুঝতাম ওটা আপনাকে টের পেতে দিইনি। ব্যাপারটা আম্মাও জানতেন। আম্মা চাইতেন আপনাকে বাদ দেওয়া হোক। আব্বা রাজি হননি। আব্বা বলতেন, ছেলেটা অঙ্কেই শুধু উইক। মুন-ডুরি তো ওর অঙ্কের ওপর নির্ভর করে না। সামনে চার-পাঁচ মাস পর ডিগ্রি ফাইনাল। ও নিজেই চলে যাবে। তেজি ছেলে। থাকুক না এ কটা দিন।'

'আইয়ুব শাহি নিপাত যাক/মোনেম শাহি নিপাত যাক' আওয়াজ ছাড়বার সময় লাফিয়ে উঠতাম ওই সময়। ম্যাজিস্ট্রেট আসিফুর রহমান ওই লম্ফনকে 'তেজ' বলে গণ্য করেছিলেন। পাবনার চাটমোহরের এই ভদ্রলোক ছিলেন উচ্চস্তরের সৎ এবং দেশপ্রেমিক। সাদা শার্ট আর ট্রাউজার ছিল দুই সেট। নিজ হাতে ওগুলো ধুয়ে নিজে ইস্ত্রি করে পরতেন। টানাটানির সংসার তার। তবু আমায় মাঝেমধ্যে চা খাওয়াতেন। যতদিন খাইয়েছেন কোনো দিন চা-বিস্কুট খাইনি। চা-মুড়ি খেয়েছি।

পার্থিব জীবনের ব্যর্থতা-সার্থকতা নিয়ে যখন চিন্তামগ্ন হই তখন কোনো কোনো দিন হঠাৎ করে ভেরুর একটা মন্তব্য দোলা দেয়। দিনভর সে ডাক্তারবাড়ি থাকে, রাত ৮টায় সে নিজের বাড়ি যাবেই। কারণ 'নিজের বিছানা ছাড়া ঘুমাইয়া কোনো মজা নাই'। এক রাতে তুমুল বৃষ্টি। রাত ১০টায়ও বৃষ্টি থামে না। ভেরু জেগে আছে। বৃষ্টি থামলে বাড়ি যাবে। রাত ১১টায়ও বৃষ্টি। ভেরু অন্ধকারে ভিজতে ভিজতে ছুটল স্বগৃহে। পরদিন আমরা জানতে চাই, দুর্যোগ মাথায় করে ওভাবে না গেলে কী এমন ক্ষতি হতো?

'কী যে কন মামুরা!' বলে ভেরু, 'আপন ঘরে যে ব্যাডা হুইততো হারে না, হ্যাতার মতো দুর্ভাগা এই দুইন্নাত আর আছেনি?' তীক্ষ্ন বুদ্ধি মানুষের মতোই ওর প্রশ্ন। ওর কথায় আমরা চমকে উঠি। প্রাণ বাঁচাতে নিজের বাড়ি ছেড়ে যে ঘরে এসে উঠলাম, সেখানে হয়তো খাদ্য আছে, স্বস্তিও আছে। শান্তি? তাও হয় তো আছে, তবে পুরোপুরি নয়। আপন ঘর ব্যতিরেকে ধবল শান্তি আসে না। যার তা নেই সে তো দুর্ভাগাই। আমরা দুর্ভাগা অবশ্যই।

শামসুজ্জামান চৌধুরী বাবুলের ধারণা ভেরুর মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই। ওর শরীরটাও বুদ্ধিরহিত। মাথা তো শরীরেরই অংশ। অংশ বিস্তর। সর্বত্রই বুদ্ধি! না, সেরকম সিদ্ধান্ত মগডালে বসা কোনো বিজ্ঞানী এখনো দেননি। হতে পারে দেহস্থ একাধিক স্থানে বসত করে বুদ্ধি। এ ব্যাপারে বছর ছয়েক আগে জামালপুর শহরের বেলটিয়ায় যে জ্ঞানপ্রাপ্ত হই সেরকম প্রাপ্তি আর বোধহয় হব না।

বেলটিয়া বাসস্ট্যান্ডে গেলাম ঢাকার বাস ধরতে। আমার আসনের সামনের চারটি আসনে বারো/তের বছর বয়সী চারটি বালক। বাস ছাড়তে আরও ত্রিশ মিনিট বাকি। ঊনত্রিশ মিনিটের সময় বৃদ্ধ এক ব্যক্তি আর বোরকা পরা তিন মহিলা আসতেই তাদের জন্য বালকরা আসন ছেড়ে দেয়। বালকরা তার নাতি। তিনি প্রত্যেকের হাতে একটি করে ১০ টাকার নোট দিলে ওরা দাদা-দাদি ও দুই ফুফুকে সালাম দিয়ে নেমে যায়। বাস ছাড়ার পর বুড়োর পাশের যাত্রী বলে, চোখ জুড়িয়ে গেল ভাই। গুরুজনের আরামের জন্য ছেলেগুলান এক ঘণ্টা ধইরা বইসা বইসা সিট দখলে রাখছে। বুড়ো বলেন, ভালো ছেলে! আপনে জানেন আন্ডা। ৪০ টাকা অ্যাডভান্স নিছে। পরে কত দিলাম নিজ চোখেই তো দেখলেন। এই গুলার হইল পোঁদ-ভরা বুদ্ধি। চাপে ফালাইয়া ট্যাকা বাইরকরণের ওস্তাদ।'

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

সর্বশেষ খবর