শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা
দর্শন

জ্ঞান ও সততার অভাব ধ্বংস ডেকে আনে

আবু মহি মুসা

জ্ঞান ও সততার অভাব ধ্বংস ডেকে আনে

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যখন কথা হয় তখন অনেকেই বলেন, বাংলাদেশে শত শত সমস্যা। দর্শনের একজন গবেষক হিসেবে আমি বলব, বাংলাদেশে কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশের মাটির ওপরে এবং নিচে যে ধন-সম্পদ রয়েছে তার যদি সুষ্ঠু ব্যবহার হয় তাহলে বাংলাদেশ গরিব থাকতে পারে না, বাংলাদেশ অভাবী হতে পারে না। আমরা গরিব, তবে সততায়, আমরা অভাবী, তবে জ্ঞানে। যে জাতির মধ্যে জ্ঞান এবং সততার অভাব রয়েছে সে জাতির ধন-সম্পদ যতই থাক, সে জাতি কোনো দিনও উন্নতি করতে পারে না। মূল সমস্যা কিন্তু এখানে। বলা হয়েছে, বিমান চলে ফুয়েলে, দেশ চলে জ্ঞানে। এমনকি একশ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েও দেশ চালানো যাবে না যদি জ্ঞান না থাকে। আমরা যারা রাজনীতি করছি, দেশ চালাচ্ছি, আমাদের কতটুকু জ্ঞান আছে? যতটুকু জ্ঞান আছে ততটুকু জ্ঞান দিয়ে কি দেশ চালানো যায়? কতটুকু জ্ঞান আছে এর একটি পরিমাপ করা প্রয়োজন। তবেই বোঝা যাবে আমরা দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি।

জ্ঞানের চারটি স্তর বা ফ্রাগমেন্টর কথা আমরা জানি। যেমন সাধারণ জ্ঞান, বুদ্ধি, অলৌকিক জ্ঞান এবং দার্শনিক জ্ঞান বা দর্শন। সম্প্রতি এর সঙ্গে জ্ঞানের আরও দুটি স্তর যুক্ত হয়েছে। এর একটি অভ্যন্তরীণ জ্ঞান, অন্যটি অতি সাধারণ জ্ঞান। এ দুটি সহজাত, অর্জন করতে হয় না। একটি খাদ্যের বিষয়, অন্যটি জৈবিক বিষয়ের। দ্বিতীয় দুটি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং শেষের দুটি আধ্যাত্মিক জ্ঞান। এ ছয়টি জ্ঞানের স্তরের ওপর ভিত্তি করে সমগ্র প্রাণিজগতকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- কারও মধ্যে একটি স্তর, কারও মধ্যে দুটি এভাবে। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু বলেছেন, গাছের প্রাণ আছে। দর্শন বলছে, যার প্রাণ আছে, তার জ্ঞান আছে। সে হিসেবে গাছের জ্ঞান আছে। গাছের আছে একটি জ্ঞান, যেটাকে বলা হয় অভ্যন্তরীণ জ্ঞান। কেঁচোর মধ্যে দুটি জ্ঞান, খাদ্য এবং জৈবিক। কেঁচোর আত্মরক্ষার জ্ঞান বা সন্তান লালন-পালনের জ্ঞান নেই। তিনটি স্তর রয়েছে পৃথিবীর সব প্রাণীর মধ্যে। এদের মধ্যে আত্মরক্ষার জ্ঞান এবং সন্তান লালন-পালনের জ্ঞান রয়েছে। চারটি স্তর রয়েছে বুদ্ধিমান প্রাণীর, যেমন শিম্পাঞ্জি, বানর, গরিলা, হনুমান ইত্যাদি। পাঁচটি স্তর রয়েছে জিনের মধ্যে (অশরীরী প্রাণী)। ছয়টি স্তর রয়েছে মানুষের মধ্যে। এ জন্যই মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। এ ছয়টি স্তরের ওপর ভিত্তি করে মানুষকে আবার ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ঠিক এভাবে- কারও মধ্যে একটি স্তর বা জ্ঞান, কারও মধ্যে দুটি জ্ঞান, কারও মধ্যে তিনটি জ্ঞান ইত্যাদি। একটি জ্ঞান কোন মানুষের মধ্যে? মাতৃগর্ভে মানুষ যখন স্পার্ম থেকে বড় হয়ে পরিপূর্ণ মানুষ আকৃতি ধারণ করে তখন তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জ্ঞান আসে। এ জ্ঞানটি আসার পরই মাতৃগর্ভের শিশুটি হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারে। এ শিশুটি একটি মাত্র জ্ঞান নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। এরপর যদি তার মুখে তরল খাবার তুলে দেওয়া হয়, সে তা খেতে পারে। এটা কারও কাছে শিখতে হয় না। অনেক সময় মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। কোন জ্ঞানটি লোপ পেলে তাকে অজ্ঞান বলে? ওই জ্ঞান, যে জ্ঞানটিকে বলা হয় অভ্যন্তরীণ জ্ঞান। যেমন- একজন মুষ্টিযোদ্ধা মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। এ সময় সে খেতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না, হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারবে না। অথচ একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েই খেতে পারছে, হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারছে। অভ্যন্তরীণ জ্ঞান লোপ পেলে সব জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অভ্যন্তরীণ জ্ঞান ফিরে এলে সব জ্ঞান আবার ফিরে আসবে। সে উঠে বসবে, খাবে, কথা বলবে। যাই হোক, দুটি জ্ঞান যার মধ্যে বিদ্যমান তাকে বলা হয় নিরেট মূর্খ। তিনটি জ্ঞান যার মধ্যে সেও মূর্খ, তবে তার কিছুটা বুদ্ধি আছে, চারটি জ্ঞান যার মধ্যে তাকে বলা হয় বুদ্ধিমান, পাঁচটি জ্ঞান যার মধ্যে তাকে বলা হয় অলি আল্লাহ বা সাধু-সন্ন্যাসী, ছয়টি জ্ঞান যাদের মধ্যে তাদের বলা হয় মহাজ্ঞানী, অর্থাৎ ধর্মপ্রবর্তক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী। আমরা অলি আল্লাহও নই বা মহাজ্ঞানীও নই। আমরা বুদ্ধিমান। পৃথিবীতে বুদ্ধিমান মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ১০ লাখ লোকের সমাবেশে প্রায় শত ভাগ লোকই বুদ্ধিমান, যাদের জ্ঞান হচ্ছে চারটি। এখানে নির্বোধ পাওয়া যাবে না, মূর্খ পাওয়া যাবে না। মহাজ্ঞানীদের তো প্রশ্নই ওঠে না। অলি আল্লাহ থাকলে তাকে খুঁজে বের করা যাবে না। এর মধ্যে আরও একশ্রেণির জ্ঞানী রয়েছে। অর্থাৎ ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষ হচ্ছে বুদ্ধিমান।

আমরা বুদ্ধিমান, আমাদের জ্ঞান চারটি। দর্শন বলছে, আমাদের জ্ঞান হচ্ছে তিনটি। হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া, গরু, মহিষ, পশুপাখির জ্ঞানও তিনটি। ওরা যতটুকু চিন্তা করতে পারে, তারচেয়ে একটুও বেশি চিন্তা আমরা করতে পারি না। ওদের যেমন খাদ্য, জৈবিক, আত্মরক্ষা, সন্তান লালন-পালন এবং ভয়ভীতির জ্ঞান আছে, আমাদের ঠিক ততটা জ্ঞান রয়েছে। পার্থক্য এখানে, আমাদের মধ্যে মহাজ্ঞানীরা আসছেন। মহাজ্ঞানীদের জ্ঞান আমরা ধারণ করতে পারছি। এ মহাজ্ঞানীরা যদি কোনো কালেই আমাদের মধ্যে না আসতেন তাহলে আজও আমরা বনে-জঙ্গলে উলঙ্গ অবস্থায় বসবাস করতাম। আফ্রিকার জঙ্গলে যে জনগোষ্ঠী বাস করে, ওদের মধ্যে কোনো মহাজ্ঞানী আসেননি বলে ওরা আজও উলঙ্গ অবস্থায় জীবনযাপন করছে। এটা হচ্ছে জ্ঞানীদের জন্য জ্ঞানের নিদর্শন।

আমরা যে পশুপাখির চেয়ে বেশি চিন্তা করতে পারি না তার প্রমাণ এখানে। আমাদের গৃহিণীরা ভালো রান্না করতে পারেন। একটি শিশুকন্যাকে পঁচিশ বছর যদি কোনো বন্দীশালায় বন্দী করে রাখা হয়, এ সময় তাকে শাড়ি পরতে দেওয়া হবে না। তার সঙ্গে কথা বলা যাবে না। ২৫ বছর পর তাকে বের করে এনে যদি শাড়ি পরতে দেওয়া হয়, সে শাড়ি পরতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না। রান্না করতে পারবে না। এমনকি আগুনও ধরাতে পারবে না। তার মানে সে কিছুই পারবে না। অথচ মাত্র ২৫ সেকেন্ডে একটি সাপ ডিমের খোলস থেকে বের হয়ে দৌড়াতে পারে, খেতে পারে, ফণা তুলতে পারে। একটি মুরগির বাচ্চা ডিমের খোলস থেকে বের হয়ে দাঁড়াতে পারে, হাঁটতে পারে, খেতে পারে, কথা বলতে পারে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, কে শ্রেষ্ঠ? ওরা, না আমরা? অনেকেই বলবেন, সে হিসেবে তো ওরা শ্রেষ্ঠ।

লেখক : দার্শনিক

 

সর্বশেষ খবর