সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

আকাশে ফোটানো ফুল

আবু তাহের

আকাশে ফোটানো ফুল

কড়া নড়ছে... নড়ছে... নড়ছে। মহাবিরক্তির সঙ্গে দরজা খুললাম। দেখি পরনে কালো শাড়ি মাঝবয়সী এক প্রিয়দর্শিনী দাঁড়িয়ে। তাঁর কাঁধে কাপড়ের বাহারি ব্যাগ, মুখে মোলায়েম হাসি। বললেন, 'ভাবী কই? কই তোমরা দীপা-রিপা?'

'দীপা-রিপা কে?' জানতে চাইলে কালো শাড়ি বলেন, 'ভাবীর দুই মেয়ে। ভাবীকে ডাকুন, ভাবী কী করছেন?' বললাম, 'ঘুমোচ্ছেন।' বিস্মিত কালো শাড়ি হাতঘড়ি দেখে বলেন, 'তিন মিনিট পরেই মাগরিবের আজান হবে। এ সময়ে কেউ ঘুমায়।'

'বাধ্য হয়েই ঘুমোচ্ছেন,' জানাই আমি, 'মরণোত্তর ঘুম আরকি।' প্রিয়দর্শিনী এবার আমার আপাদমস্তক দেখলেন। সম্ভবত যাচাই করলেন, পাগল না মাথা খারাপ। বললেন, 'ঠিক আছে। ভাবীর মেয়েদের ডাকুন।' বললাম, 'ভাবীর মেয়েরা এখানে থাকে না। ভাবীর দুই ছেলে আর আমি থাকি।'

ঠিক এ সময় দরজার ডানদিকে ফ্ল্যাট নম্বর লেখা ফলকটি তাঁর নজরে আসে। জিহ্বায় কামড় দিয়ে 'স্যরি' বললেন কালো শাড়ি। ভুলে তিনি এক ফ্লোর বেশি উপরে এসে পড়েছেন। জানতে চাইলেন 'মরণোত্তর ঘুম' কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বলেছি কি-না। হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলে তিনি 'চুহ্চুহ্' আওয়াজে সমবেদনা জানালেন। নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি অমুক মেয়র পদপ্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় আছেন। নিচের ফ্লোরের ভাবী তাঁর সহচর। কাঁধের ব্যাগ থেকে লিফলেট বের করে আমায় দিয়ে বললেন, 'বাসযোগ্য ঢাকা বলতে যা বোঝায় তা গড়ে তোলাটা... ভাইয়ের পক্ষেই সম্ভব। তাকে মেয়র বানানো আমাদের কর্তব্য।' মনে মনে বলি, 'হাতিঘোড়া গেল তল/গাধা বলে কত জল।'

আজানের আওয়াজ আসতে শুরু করার আগেই নিম্নগামী হওয়ার জন্য লিফটে ঢুকলেন প্রিয়দর্শিনী। বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে এই নিয়ে পাঁচজন প্রচারক এলেন আমার কাছে। কিন্তু আমার পছন্দের প্রার্থীর কেউই এলেন না। 'বাসযোগ্য ঢাকা' গড়ার বাণী তিনি দিচ্ছেন না। রসগোল্লাও তিনি দেখান না। যা দেখান তা রসগোল্লার পিতামহের চেয়েও তিন কাঠি সরেস। তিনি বলছেন, নির্বাচিত হলে তিনি এই ঢাকাকে বিশ্বমানের নগরী করে তুলবেন। পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা মোচনে উদগ্রীব কতিপয় নাগরিক খেপচুস হয়ে বলেন, 'বিশ্বের তিনি জানেন কী? বিশ্বমান বিশ্বমান যে করতেছেন বিশ্ব সম্পর্কে তেনার তো কোনো অভিজ্ঞতাই নাই!'

দ্বিমত পোষণ করে এক যুবক বলল, 'ভুল বললেন আংকেলরা। বিশ্ব বিষয়ে এই ক্যান্ডিডেটের বিস্তর অভিজ্ঞতা। নিজ চোখে ওটা আমি দেখেছি।' উদগ্রীবদের একজন বলেন, 'য়্যাই ছ্যামরা! চোপা মারতেছ ক্যান? কত পাইছ তেনার ফান্ড থেকে।' যুবক বলে, 'আস্তাগফিরুল্লাহ! জীবনে আব্বার ফান্ড ছাড়া কারও ফান্ড আমারে য়্যাট্রাক্ট করতে পারে নাই। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, ক্যান্ডিডেটের টেবিলে দশাসই সাইজের একখান গ্লোব আছে। আঙ্গুলের ডগা দিয়া সেই গ্লোব উনি সকাল-বিকাল ঘোরান। তার মানে কী?'

'তার মানে হইল বিশ্ব উনার আঙ্গুলের ডগায়।' রায় দিলেন যুবকটির পাড়াতুতো আংকেলদের একজন। অন্য আংকেলরা হ্যাহ্-হ্যাহ্-হোহ্-হো করে হাস্য করলেন। তা তারা করুন। অহোরাত্রি করুন, তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোল বাধালো তাদের কৌতূহল। তারা আমার কাছে জানতে চাইলেন বিশ্বমানের নগর বানানোর আকাশকুসুম লম্বা বুলি ঝাড়বার পরও এই প্রার্থীকে আমি পছন্দ করছি কোন্ যুক্তিতে।

'কারণ তিনি জানেন আকাশে ফুল ফোটানোরও একটা সীমা আছে,' বললাম আমি, 'ক্যান্ডিডেট ইচ্ছা করলে বলতে পারতেন যে তিনি ঢাকাকে বিশ্বসেরা নগরীতে পরিণত করবেন। তেমন কিছু তো তিনি বলেননি। আশা করি, প্রচারণার বাকি দিনগুলোতেও বলবেন না।'

'নির্বাচিত হলে পুরো টার্মের সময়টায়ও বলবেন না।' বললেন যুবকের পাড়াতুতো এক আংকেল, 'বিকজ ততদিনে তেনার জানা হয়ে যাবে হাউ ম্যানি প্যাডি মেকস হাউ ম্যানি রাইস।' একটা দম নিয়ে বলেন, 'ঢাকা বিশ্বসেরা নগরী হবে তার হাত ধরে, এমন ওয়াদা যে তিনি করছেন না, তাতে তো তেনার কোনো কেরামতি নাই। ওটা তো আমাদের চৌদ্দ পুরুষের পুণ্যের ফল।'

ভোট মৌসুমে ভোটার আর প্রার্থীদের বলা কথা আর না বলা কথা সংকলিত করে থান ইট সাইজের গ্রন্থ রচনার সুযোগ আছে। সেই সুযোগ নেওয়া হয় না দেখে আফসোস করতেন দৈনিক সংবাদ-এর প্রাক্তন চিফ রিপোর্টার তোজাম্মল আলী (মরহুম)। ১৯৮৬-র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচারণার বোলচালের বর্ণনা দিয়ে তিনি আমাদের হাসাতে হাসাতে কাহিল করে দিয়েছিলেন। শুধু এক প্রার্থীর কারবার শুনে আমরা হাসতে পরিনি। ধরা যাক সেই প্রার্থীর নাম কদম সর্দার।

কদমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে উদম। এক গ্রামের বত্রিশ শ' ভোটারের সবাইকে লুঙ্গি ও শাড়ি উপহার দিয়েছিল উদম। ওই গ্রামে গিয়ে সুমিষ্ট ভাষায় মিনিট তিনেক ভাষণ দিয়ে কদম বলে, 'উদম তোমরারে যা দিছে আমি তার ডবল দিবার পারি। তবু দিমু না। দিলে উদইম্মা তোমরারে 'তিন খান কইরা শাড়ি লুঙ্গি দিবে। তোমরা তখন আমার কাছে চার পিস কইরা দাবি করবা। তোমরার চরিত্র আমি নষ্ট করবার পারি না।'

'তোমরার চরিত্র যাতে ভালো থাকে, সেইটা আমি দেখতেছি,' 'বলল কদম, 'শরীলটা যাতে ভালো থাকবার পারে সেইটা দেখবা তোমরা। যাউকগা! মারফতি কইয়া আর কাম নাই। সোজাসুজি কইতেছি। ভোট আমারে দিবি শুয়ারের বাচ্চারা। যদি না দিস, শুধু বাঁশ দিমু ভাবছস? বাঁশ তো দিমুই। রুহ গেলে শরীলটা সেই বাঁশের ডগায় লটকাইয়া রাখুম। যদি না রাখি আমার নাম কদম সর্দার না। যদি না রাখি আমার জন্মদাতা বাপের সংখ্যা তিন।'

কদম সর্দার আকাশে বেশ কিছু ফুল ফুটিয়েছিল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে- তার এলাকায় ১২ ইউনিয়ন। প্রত্যেক ইউনিয়নের জন্য একটি করে অ্যাম্বুলেন্স থাকবে। গুরুতর অসুস্থ রোগীকে উঠিয়ে গাড়িগুলো সোজা যাবে জেলা সদর হাসপাতালে। ওখানে অবস্থার উন্নতি না হলে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। সব খরচ এমপি কদমের।

জনসভায় এ ঘোষণা দেয় কদম। শ্রোতারা দেড় মিনিট ধরে হাততালি দেয়। ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন এরশাদ সরকারের মন্ত্রী। তাঁকে সাংবাদিকরা বলেন, রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেছিলেন তিনি ইলেকশনে নিরপেক্ষ থাকবেন। কিন্তু এখনতো দেখা যাচ্ছে জাপা প্রার্থীদের পোস্টারে এরশাদের ছবি। এটা তো অন্যায়।

'ওরকম কিছু হয়ে থাকলে পার্টির অজ্ঞাতেই হয়েছে', বলেন শাহ মোয়াজ্জেম, 'ঠিক আছে। এখন বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা যদি তাদের পোস্টারে এরশাদের ছবি ছাপতে চান ছাপতে পারেন। আমরা অবজেকশন দেব না।' পরে দেখলাম, শাহ মোয়াজ্জেম বিএনপিতে যোগ দিলেন, বিএনপির কেউ অবজেকশন দিল না।

কদমরা সব দেশেই থাকে। ভারতেও আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রক্তবীজ উপন্যাসেও একরকম এক চরিত্র আছে, যে পেশাদার রাজনীতিক। তাকে নায়ক বলেছে, 'দশ বছর বিদেশে ছিলাম। বিদেশ যাওয়ার আগে দেখেছি, আপনারা লম্বা লম্বা বুলি ঝাড়ছেন। এই করব সেই করব। দশ বছর পরেও দেখি, সেদিন এক পাবলিক মিটিংয়ে আপনি সেই 'পুরনো কায়দায় আকাশে ফুল ফোটাচ্ছেন। বাস্তবায়ন অসম্ভব সব অঙ্গীকার করছেন। আপনাদের পরিবর্তন হবে কবে?'

'শুধু আমাদের অঙ্গের ঘা-টাই দেখলে!' বলে রাজনীতিক, 'লম্বা বুলি ঝাড়তেই হয় বাছা। পাবলিক রূপকথা শুনতে চায় আমরা করবটা কী! আমরা পাবলিক লিডার। পাবলিকের ইচ্ছামতো চলতে চলতে নাভিশ্বাস ওঠা বাকি।' নায়ক মনে মনে বলল, 'ওটা যত দ্রুত উঠবে ততই মানুষের মঙ্গল।'

প্রকাশ্যে বদলোকের মৃত্যু কামনা স্বাস্থ্যকর নয়। তাই বদেরা টের পায় না কত কোটিজন প্রতিক্ষণ বলে চলেছে- 'যা! গোভাগাড়ে গিয়ে মর।' জহির রায়হান পরিচালিত 'শেষ পর্যন্ত' ছবিতে ভোটে জেতার জন্য এক বদলোক তার কন্যার প্রেমিককে প্রচারণায় নামতে বাধ্য করে। প্রতিপক্ষের লোকরা মিছিলে হামলা করলে প্রেমিক গুরুতর আহত হয়। সে চিৎপাত হাসপাতালের শয্যায়।

প্রেমিকা হাসপাতালে যায় প্রেমিককে দেখতে। বলে, 'ওগো, তুমি কেন এসবের মধ্যে যাও।' প্রেমিক বলে, 'না গিয়ে উপায় কী! এটা তো শুধু তোমার বাবার ইলেকশন নয়। তোমার বরের সিলেকশনও।' মিছিলটা কেন আক্রান্ত হলো? হলো এজন্য যে, মিছিলকারীরা গান গাইতে গাইতে আকাশ কুসুম দেখাচ্ছিল।

ছবির সেই গানটিতে সুর দিয়েছিলেন আবদুল লতিফ। আমোদজনক সেই গান- 'ভোট চাই ভোট চাই ভোট চাই / ভোট দিলে যাহা চান তাহা পাবেন ভাই/ বাড়িঘর করে দেব ফিটফাট/ সোনা দিয়ে মুড়ে দেব পথ ঘাট/ চোখে শুধু ধরা দেবে রোশনাই রোশনাই।'

সিটি নির্বাচনের প্রচারণায় 'সোনা দিয়ে মুড়ে দেব পথঘাট'- এরকম কেউ বলছেন না। কিন্তু 'আমি জিতলে বদলে যাবে দৃশ্য' এরকম ভাব প্রদর্শন জারি আছে। কি জিতবে সেই কৌতূহলও বিস্তর। ১৯৯১'র সংসদ নির্বাচনের আগে তেজগাঁয় আমার দফতরে এসেছিলেন মুন্সীগঞ্জের মোফাখখারুল ইসলাম। ইনি ব্রিটিশ আমলের গ্রাজুয়েট। চিন্তা উদ্রেককারী কথা বলতেন হঠাৎ হঠাৎ। আমরা তাকে বললাম, মোফা ভাই কে জিতবে? বিএনপি না আওয়ামী লীগ?

'কঠিন প্রশ্ন।' বলেন মোফাখখারুল ইসলাম, 'কে জিতবে জানি না। কে হারবে জানি।' আমরা বললাম, 'কে হারবে তা-ই বলুন।' তিনি বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বললেন : হারবে পাবলিক।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর