সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা
স্মরণ

ঘুম ভাঙানোর জন্য জন্মেছিলেন যারা

আজিজুস সামাদ আজাদ

ঘুম ভাঙানোর জন্য জন্মেছিলেন যারা

আমাদের সমাজে যারা আদর্শ মানুষ ছিলেন তারা সবাই একে একে চলে যাচ্ছেন। এমন একদিন হয়তো আসবে যখন এই ধরাধামে আদর্শ হিসেবে মানার মতো আর কোনো মানুষই জীবিত থাকবেন না। মানুষ কিছু কাজ করে তার কাছে অনুকরণীয় ওই মানুষদের কাছ থেকে আহরিত অনুপ্রেরণা থেকে। আর যখন অনুপ্রেরণা পাওয়ার মতো অনুকরণীয় কোনো মানুষ তার সামনে থাকে না তখন তারা হতাশা থেকে মরিয়া আচরণ করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, প্রয়াত জাতীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদের দশম মৃত্যুবার্ষিকী ২৭ এপ্রিল সোমবার। তৎকালীন সিলেট জেলার জগন্নাথপুর থানার ভূরাখালি গ্রামে তিনি ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সামাদ আজাদ ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৪৬ সালে একই সংগঠনের অবিভক্ত আসামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তার সিদ্ধান্তক্রমে ও নেতৃত্বে প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন এবং আওয়ামী লীগে শ্রম সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং সর্বদলীয় রাজনৈতিক জোট এনডিএফের দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে এমএনএন নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকের একজন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তিনি। '৭৫-পরবর্তী পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের এবং ১৯৯৬-এর জনতার মঞ্চের অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি। সুনামগঞ্জ জেলার প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে বিভিন্ন সময় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্বৈরাচারের কোপানলে পড়ে জীবনের বহু বছর তিনি কারাবন্দী ছিলেন।

নিজের জীবনী লেখার ব্যাপারে আবদুস সামাদ আজাদের বিশেষ একটা আগ্রহ ছিল না। যদিও এ ধরনের মানুষের জীবনী সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জানা উচিত। কিন্তু তিনি বাংলার ইতিহাসের এমন সব দিক পরিবর্তনকারী সময়গুলোর সন্ধিক্ষণে উপস্থিত ছিলেন যে, তার মাঝে সবসময় একটা আশঙ্কা কাজ করত, তার সাক্ষ্যে হয়তো ইতিহাসের বিষাক্ত সাপ ইতিহাসকে ক্ষত-বিক্ষত করার জন্য লালায়িত হবে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর আর সাক্ষ্য দেওয়ার প্রশ্ন আসছে না। সুতরাং তাকে কাছে থেকে দেখা মানুষ যদি তার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে লিখে রেখে যান, তবে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসই সমৃদ্ধ হবে। তাদের সেই হেঁটে হেঁটে চোঙা ফুঁকে মানুষকে সংগঠিত করার ইতিহাস, ঔপনিবেশিক আর স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর রুদ্ররোষ এড়িয়ে মাসের পর মাস নৌকায় জীবন কাটিয়ে জনগণকে সংগঠিত করার ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তাদের ত্যাগী রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সীমাবদ্ধ রাখবে যৌক্তিকতার রাজনীতির মাঝে।

আজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে যাওয়া মানুষ আবদুস সামাদ আজাদ। তিনি খুব গর্ব বোধ করতেন যে, তার হাত দিয়েই ১৯৯৬ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে পুনঃপ্রত্যাবর্তনের বিলটি সংসদে উপস্থাপিত হয়। গণতন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যার কারণে ২১ শতকে গণতন্ত্র জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের গণতান্ত্রিক সূত্রের মধ্যে কোন সূত্রটি অধিকতর ভালো ইত্যাদি আরও বহু ধরনের প্রশ্ন এসে হাজির হবে এই শতকে। তারপরও এক কথায় বলতে গেলে, স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের সাফল্য এক ব্যক্তির মানসিকতার ওপর নির্ভরশীল; যদি প্রধান ব্যক্তিটি সৎ ও প্রজাবৎসল হন, তবে পুরো তন্ত্রটিই ভালো আর যদি প্রধান ব্যক্তি ভালো না হন তবে সবই খারাপ। অন্যদিকে যদি সঠিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খারাপও ভালো হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। জনমত, স্থান-কাল-পাত্র কোনো বিবেচনায়ই স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। যে কোনো ইস্যুকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে যদি জনমতকে প্রভাবিত করার মতো ও পরিবর্তন করার মতো যথেষ্ট তথ্য জনগণের কাছে পেঁৗছানো না যায়, তবে জনমত তার অবস্থান পরিবর্তন না করার কোনো কারণ নেই বলেই ধরে নেওয়া যায়।

আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন হাওর পাড়ের মানুষ। হাওর পাড়ের মানুষদের তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তিনি বুঝেছিলেন তাদের অন্তরের কথা। তাদের চাওয়া খুব অল্প। তাদের মনের মানুষগুলোকে তাদের সুখে-দুঃখে পাশে চায়। তাদের সবারই চাওয়া-পাওয়ার আকার খুব সীমিত। সবাই ঝড়-বন্যাকে বুক পেতে রুখে দেওয়ার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে। এই খেয়ালি প্রকৃতির সঙ্গে হার না মানা যুদ্ধের সঙ্গে বেড়ে উঠতে উঠতে তারাও হয়ে উঠে কিছুটা স্বপ্নচারী-খেয়ালি-বাউল। এই অসম যুদ্ধে তাদের স্বপ্নগুলো বেশিরভাগ সময় হারিয়ে যায়। বন্যায় তাদের স্বপ্নগুলো ভেসে গেলেও আবার তারা স্বপ্নের বীজ রোপণ করে বানের জলের রেখে যাওয়া পলি মাটিতে। আবার তারা দেখা শুরু করে নতুন দিনের স্বপ্ন। এই যুদ্ধের যেন কোনো শেষ নেই কিন্তু তাদের কোনো নালিশও নেই এর বিরুদ্ধে। শুরু হয় আবার প্রতীক্ষার পালা। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার প্রতীক্ষা। কবে শেষ হবে এই প্রতীক্ষার? সবকিছুই এক সময় শেষ হয়। হয়তো শেষ হবে এই প্রতীক্ষারও। আবদুস সামাদ আজাদ বিদায় নিয়েছেন। তার এই শূন্যতার জায়গাটুকু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূরণ করে আমরা এগিয়ে যাব সম্মুখপানে, গড়ে তুলব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। আর যুদ্ধ নয়, শান্তিই যদি হয় আমাদের মূল লক্ষ্য, একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী জনগোষ্ঠীর দেশ গড়াই যদি আমাদের সবার মূল উদ্দেশ্য, তবে ঘুম ভাঙানিয়া গান গাওয়ার জন্য সামাদ আজাদের মতো স্বার্থহীন রাজনীতিবিদের বিকল্প নেই।

লেখক : রাজনীতিক।

 

সর্বশেষ খবর