সোমবার, ৪ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক

পৃথিবীর প্রতিটি শ্রমিকের অধিকার আছে তার ন্যায্য পারিশ্রামিক পাওয়ার ও নিরাপদ কর্মক্ষেত্রে কাজ করার অধিকার পাওয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কতটা পিছিয়ে আছি তা নিচের চিত্র দেখলেই আমরা বুঝতে পারব। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের ২০১২ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে শুধু ঢাকা আর চট্টগ্রামেই গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। যার মধ্যে ৮৩ ভাগ নারী এবং তার মধ্যে অনেকেই বয়সে শিশু ও তরুণী। আমরা সপ্তাহে দুই দিন ছুটি পেলেও সাপ্তাহিক একদিনের ছুটি পাওয়ার নিয়মও নেই তাদের। এদের মধ্যে প্রায় ৩৩ ভাগ ঘুমায় রান্নাঘরের মেঝেতে; বাকিরা বসার ঘর কিংবা শোবার ঘরের মেঝেতে, এমনকি স্টোররুমেও রাত কাটায় অনেকে। অনেক বাসায় লিফট ব্যবহার তাদের জন্য নিষিদ্ধ এবং আলাদা পাক হয়। এদের মধ্যে বেশির ভাগই পড়াশোনা করার সুযোগ পায় না কোনো দিনই। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, বাসার এই কাজের মেয়েরা যৌন নির্যাতনের শিকারও হয়। আমরা সারা দিন বাচ্চাকে যে বুয়ার কাছে রেখে কাজে যাই, সেই বুয়াকে আমাদের ফার্নিচারে বসতে দেই না। বাচ্চা বসে সোফায়, বুয়া বসে মেঝেতে। আমাদের বাচ্চারা জম্মের পরে পরিবারের বাইরের মানুষ হিসেবে প্রথমে তার বুয়াকেই দেখে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা কীভাবে এই বুয়াদের সঙ্গে ব্যবহার করে তা দেখেই বাচ্চা প্রথমে শিখে কিভাবে বাইরের মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিজেদের কাজের মানুষদের সম্মান করতে শিখেছে পাশ্চত্যের জনগণ। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র সমাজেই তাদের মানসিকতার বিবর্তনের প্রতিফলন ঘটেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের শিক্ষকদের যেমনভাবে গুডমর্নিং বলে, একইভাবে বলে তাদের স্কুলের দারওয়ানকে আর সুইপারকে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে কাজের মানুষদের বাসার ফার্নিচারে বসতে বারণ নেই; গৃহকর্মীরা কর্মচারী হিসেবে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো পায়। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় দেখতে পাই বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়ে ড্রাইভারের দুপুরের খাওয়ার কথা ভুলে যাই। আমাদের এই সমাজের কিছু শ্রমিকের কাছে পৃথিবী যেন শুধুই ক্ষুধার রাজ্য। আজ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও দেখা যায় একজন কর্মজীবীর ন্যায্য অধিকার আদায় করা হচ্ছে না। মসজিদগুলোতে একজন মুয়াজ্জিন ও খাদেম যে পরিমাণ শ্রম দিয়ে থাকেন তাকে সে পরিমাণ বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে না। যা কিছু দেওয়া হয় তাও নয়-ছয় মাস বাকি রাখার পর। সামান্য ত্রুতি-বিচ্যুতি দেখা দিলে সাধারণ থেকে সাধারণ মুসলি্লরও ধমক শুনতে হয় তাদের। ইসলাম আমাদের সব শ্রমিকের সঙ্গে সদাচরণের শিক্ষা দেয়। নিয়োগ, পদোন্নতি বা অন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কর্মচারীদের যোগ্যতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিরপেক্ষতা এবং ন্যায়বিচার অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সেরূপ নির্দেশই দিয়েছেন : আল-কোরআনে তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন আমানতগুলো তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে (সূরা নিসা-৫৮)। ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, নিয়োগদাতা তার কর্মচারীদের ন্যায্য পারিশ্রমিক প্রদান করতে বাধ্য। যদি মজুরির হার খুব অল্প হয়, তাহলে একজন ব্যক্তি পর্যাপ্ত কাজ করতে উৎসাহী নাও হতে পারে। পক্ষান্তরে, মজুরির হার যদি খুব বেশি হয়, তাহলে নিয়োগকারী মুনাফা অর্জনে সক্ষম নাও হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে তার ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী পরিচালিত কোনো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে মজুরির পরিমাণ বা হার কর্মচারী ও নিয়োগদাতা উভয়ের জন্যই ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া অবশ্যক। বিচারের দিনে মহানবী (সা.) তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন, 'যে ব্যক্তি একজন শ্রমিক নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পরিপূর্ণ কাজ আদায় করে কিন্তু তাকে তার মজুরি পরিশোধ করে না।' (বুখারি) পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় মুসলমান মালিকদের কর্মচারীদের প্রতি অসঙ্গত আচরণ করা উচিত নয়। যেমন- মুসলমান কর্মচারীদের নামাজের জন্য বিরতি দেওয়া উচিত, ইসলামী অনুশাসনের বিপরীত কোনো কাজে তাদের জোর-জবরদস্তি না করা, অসুস্থতার সময় সাময়িক অবকাশ বা ছুটি দেওয়া এবং হয়রানি না করা ইত্যাদি। সমতা এবং সাম্যাবস্থা লালনের জন্য অমুসলিম কর্মচারীদের ধর্মমতের প্রতিও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার এবং ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করছেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। (সূরা মুমতাহিনা-৮) যদি কোনো কর্মচারী (পুরুষ বা মহিলা) শারীরিক সমস্যার কারণে নির্ধারিত কাজ করতে না পারে বা অতীতে কোনো ভুল করে থাকে; নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ জনসম্মুখে তা অবশ্যই প্রকাশ করবে না। এতে কর্মচারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ বলেছেন, যদি তোমরা ভালো কিছু প্রকাশ কর কিংবা গোপন কর অথবা মন্দ ক্ষমা করে দাও; তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও ক্ষমতাবান। (সূরা নিছা-১৪৯) মালিকের দুর্দিনে কর্মচারীকে একটু সহ্য করতে হবে বা মেনে নিতে হবে তার নির্ধারিত কাজের জন্য কম মজুরি গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। কর্মচারীদের ওপর অন্যায় অথবা কোনো চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। হার্ভার্ড বিজনেস রিবিউর ১২২৭ জন পাঠকের ওপর পরিচালিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রায়ই তাদের অধস্তনদের মিথ্যা দলিলাদিতে স্বাক্ষর করতে চাপ প্রয়োগ করছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভুল-ভ্রান্তি খতিয়ে না দেখতে বা বিবেচনায় না আনতে বলছেন, যে কারণে কর্মচারীরা ভুয়া ও মিথ্যা দলিলাদিতে স্বাক্ষর করায় সব সময় তাদের আতঙ্কেই থাকতে হয়। তাই আসুন সমাজ সংস্কার করার আগে আমাদের সবার অধীনে থাকা কর্মচারীদের অধিকার প্রদানের মাধ্যমে প্রতিটি ঘরকে আগে সংস্কার করি।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাচ্ছিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

 

সর্বশেষ খবর