রবিবার, ২৪ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

সালাহউদ্দিন হারিয়ে গেলেন কেন?

ড. শেখ আবদুস সালাম

সালাহউদ্দিন হারিয়ে গেলেন কেন?

১২ মে (২০১৫) তারিখ রেডিও-টেলিভিশনের প্রধান প্রধান সংবাদ বুলেটিনের প্রথম খবরটির হেডলাইন ছিল- ভারতের মেঘালয়ে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের খোঁজ পাওয়া গেছে। তিনি সেখানে ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সে (মিমহান্স) নামক একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এক দিন পর সেখান থেকে তাকে একটি সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে তিনি শিলং পুলিশের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। গত ১০ মার্চ উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি থেকে কে বা কারা বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সে সময় সালাহউদ্দিনের পরিবার এবং তার দল বিএনপি থেকে বলা হয়েছিল সরকারের কোনো সংস্থা বা বাহিনীর সদস্যরা সালাহউদ্দিনকে ধরে নিয়ে গেছে। নিখোঁজ হওয়ার দিন থেকে ২ মাস যাবৎ তারা মোটামুটি এ কথাই বলে আসছিলেন। অপরদিকে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করে আসছিল যে, সালাহউদ্দিনকে তারা উঠিয়ে নেননি বা সালাহউদ্দিন তাদের হেফাজতেও নেই; তারা বরং সালাহউদ্দিনকে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা থাকায় তাকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজছেন। সরকারের দু-একজন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতারা সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টিকে বিএনপির নিজেদের কাজ বলে কখনো কখনো মত ব্যক্ত করে বলেছেন যে, সরকারের ওপর দোষ চাপানোর জন্য বিএনপির কোনো একটি অংশ এ কাজটি করেছে। সালাহউদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার ২ মাস পূর্তির দিন খোদ বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া সরাসরি মন্তব্য করেছেন যে, সালাহউদ্দিন র্যাবের কাছেই রয়েছে। তিনি সালাহউদ্দিনকে সুস্থ শরীরে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দাবি জানান।

সালাহউদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ২ বছর আগে বিএনপির প্রভাবশালী আর এক নেতা ইলিয়াস আলীও ঢাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। রাতে একটি হোটেল থেকে বের হওয়ার পর একদল অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তার আগে ঢাকা থেকে নবী আলম চৌধুরী নামে একজন ওয়ার্ড কমিশনারও নিখোঁজ হন। সে সময় থেকে বিএনপি এবং ইলিয়াসের পরিবারসহ নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার সন্দেহ করে আসছে যে সরকারের ইশারাতেই ইলিয়াস ও নবী আলমকে গুম করা হয়েছে। এরপর সিলেট থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ নাগরিক মুজিবর রহমান নিখোঁজ হন। নিখোঁজ হওয়ার কয়েক দিন পর তাকে অবশ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এভাবে পরিবেশবাদী নেত্রী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের স্বামীকেও নিখোঁজ অবস্থা থেকে তার পরিবার খুঁজে পেয়েছিল; আবার অনেককে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি- তাদের বিষয়টি এখন প্রায় বিস্মৃত প্রায়। এসব নেতা/ব্যক্তিরা কেন নিখোঁজ হচ্ছেন এ ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক রাজনৈতিক দোষারোপ যেমন আমরা লক্ষ্য করি; তেমনি একইভাবে লক্ষ্য করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা কিংবা অপারগতার দিকটিও। বাংলাদেশে এই নিখোঁজ হওয়া প্রবণতার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে 'খুন হয়ে যাওয়ার' বিষয়টিও। দুটোই আইনশৃঙ্খলাজনিত বিষয় এবং এগুলো রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত। কোনো নাগরিকের কাছে এরূপ কৃষ্টি কাম্য নয়, নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

যা হোক, জনাব সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার ২ মাস পর তাকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে দেশে-বিদেশে এখন প্রবল কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বত্র আলোচনা চলছে এ রহস্যকর নিখোঁজ হওয়া এবং তার খোঁজ পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে। নানাজন এ ব্যাপারে নানা মত দিচ্ছেন; অফিসে, চায়ের আড্ডায় এই ঘটনা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। কিন্তু বিষয়টি আসলে কী তা আমরা আদৌ জানতে পারব কি-না সে ব্যাপারে আমার অন্তত সন্দেহ রয়েছে। জনাব সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বন্ধু-বান্ধব এবং চারপাশের মানুষের যে আলাপ-আলোচনা শুনছি তা থেকে সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে বলে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলছেন।

এক. সালাহউদ্দিন নিজেই নিজেকে হিরো বানানোর জন্য এমন কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন। দুই. বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন একজন নির্বিবাদী মানুষ। রিজভী আহমেদ গ্রেফতার হওয়ার পর কিছুদিন হাবিবুন নবী সোহেল বিএনপির মুখপাত্রের পদ থেকে সরে গেলে হঠাৎ করে সালাহউদ্দিনকে অবরোধ-হরতালের দিনগুলোতে দলের মুখপাত্র বানানো হয়। দলের অনেক নেতাই এসব নিয়োগ বা দায়িত্ব দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। কেউ কেউ বলেন এক ধরনের গায়েবি ওহি (!) নিয়ে এরা এ ধরনের দায়িত্বে বসে যান। ফলে নাখোশ হয়ে বিএনপির মধ্যেই একটি অংশ সালাহউদ্দিনকে নিখোঁজ করে দিয়েছে। তিন. সালাহউদ্দিন যখন মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছিলেন তখন দেশে চলমান অস্থিরতা-নৈরাজ্যের সব খবরাখবর তার কাছে ছিল। সরকার সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে এসব খবরাখবর পেতে এবং সালাহউদ্দিনকে থামিয়ে দিয়ে অন্য বিএনপি নেতাদের ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার তার রাজনৈতিক ক্যাডার বা সংস্থা/বাহিনীর দ্বারাও সালাহউদ্দিনকে তুলে নেওয়ার কাজটি করে থাকতে পারে। চার. সালাহউদ্দিন হয় স্বেচ্ছায় অথবা গায়েবি (!) দায়িত্ব পেয়ে ওই সময় বিএনপির মুখপাত্রের কাজটি করছিলেন। সে সময় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে সরকার তখন বলতে শুরু করে যে, যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা এবং যারা হরতাল-অবরোধ ঘোষণা দিয়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করাচ্ছেন তারা উভয়েই আইনের চোখে সমান দোষী- এসব নির্দেশদাতার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার তখন সেভাবে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দিতেও শুরু করে। উল্লেখ্য, এ পর্যায়ে বিএনপি তথা ২০ দলের কর্মসূচি ছিল বিবৃতি-নির্ভর। অনেকে মনে করেন ওই সময়ের সব বিবৃতি যে সালাহউদ্দিন দিতেন, অথবা ঘটনা-দুর্ঘটনা যা ঘটত তা যে তার কারণেই ঘটত এমনটি না-ও হতে পারে। কিন্তু ঘটনার সব তাৎক্ষণিক দায় এসে পড়ত তার ওপর। সালাহউদ্দিন এক সময় এ চাপ সহ্য করতে পারছিলেন না। এই পরিস্থিতি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তিনি নিজেই সরকার বা রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থার সঙ্গে বোঝাপড়া করেই 'নিখোঁজ' হওয়ার ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারেন।

সালাহউদ্দিন বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তিনি একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী। যে কোনো কারণেই এরকম একজন ব্যক্তির (এমনকি যে কোনো নাগরিকের জন্যও তা সত্য) নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এটা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একেবারেই বেমানান। আমরা খুশি যে, যেভাবেই হোক একজন নিখোঁজ মানুষের সন্ধান মিলেছে; তিনি এখন একভাবে না একভাবেই তার পরিবার এবং সন্তান-সন্তানাদির কাছে ফেরত আসবেন। কিন্তু এখন যে বিষয়টি সরকারের দায়িত্বের মধ্যে এসে পড়েছে তা হলো সরকারকেই এখন এই ঘটনাকে ঘিরে ধূম্রজালের যে জট সৃষ্টি হয়েছে তা সরকারকে খুলতে হবে। জনগণকে জানাতে হবে কেন রাষ্ট্রের একজন নাগরিক এভাবে নিখোঁজ হলেন? সঙ্গে সঙ্গে গ্যারান্টি দেওয়ার সব রকম চেষ্টা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমনটি আর না ঘটে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক

E -mail:[email protected]

 

সর্বশেষ খবর