রবিবার, ২৪ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

কারারুদ্ধ মির্জা ফখরুল, কিছু কথা

চণ্ডী কুমার সাহা

কারারুদ্ধ মির্জা ফখরুল, কিছু কথা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হাতেগোনা যে দুই-পাঁচজন পরিচ্ছন্ন ইমেজের রাজনীতিক রয়েছেন তাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্যতম। অত্যন্ত সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও এ কথা দৃঢ়চিত্তে স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। যারা তার সম্পর্কে জানেন, তার সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে, কেবল তাদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব, কত বড় মনের সাধারণ মানুষ তিনি। ব্যক্তি হিসেবে তিনি যেমন সৎ, সুশিক্ষিত তেমনই ন্যায়পরায়ণ, সজ্জন ও বাগ্মী। এককথায় আপাদমস্তক ভদ্রলোক। দেশের উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী মির্জা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সেখানকার লেখাপড়ার পর্ব শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে শিক্ষকতা পেশায় আত্দনিয়োগ করেন। অত্যন্ত সততা ও সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে শিক্ষকতা থেকে অবসরগ্রহণ করেন। পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে, একজন শিক্ষক হয়ে কেন তিনি রাজনীতিতে যোগ দিলেন? তার পিতা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী। সুতরাং তার শিরা-উপশিরায় রাজনীতি প্রবাহিত। তাই তো নিজেকে একটা বিশেষ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পর জীবনের বাকিটা সময় দেশ ও দশের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে রাজনীতিতে যোগ দেন। স্বীয় কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধার দ্বারা তিনি নিজেকে আজকের অবস্থানে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকারের কৃষি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে।

বিএনপির মতো একটি বড় দলের মহাসচিব (ভারপ্রাপ্ত) হয়েও তিনি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন, যা ভাবতেই অবাক লাগে। খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত তিনি। তার সম্পদ বলতে দুই কন্যা সন্তান, যাদের তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সত্য ও ন্যায়ের পথের পথিক। অন্যায়ের সঙ্গে কখনোই তিনি আপস করেননি। সুস্থ ধারার রাজনীতির চর্চা করাই তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এখানেই তিনি অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছেন বলা যায়। কেননা বর্তমানে প্রচলিত প্রতিহিংসার রাজনীতির ময়দানে তিনি সত্যিই বেমানান। কারণ, বর্তমান রাজনীতি পেশিশক্তি ও কালো টাকার কাছে অনেকাংশে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তার না আছে ক্যাডার বাহিনী, না আছে কালো টাকার শক্তি। আছে শুধু সততা আর পর্বতসম চারিত্রিক দৃঢ়তা, বর্তমান রাজনীতিতে যার কানাকড়িও দাম নেই। কথায় আছে সৎ লোকের ভাত নেই। সততার কারণেই তাকে সরকার খেলো মামলায় গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করেনি। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৮৬টি মামলা দেওয়া হয়েছে, যার প্রতিটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা। মামলাগুলো যে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে অভিযোগগুলোর পক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। খুবই দুঃখ ও ব্যথা লাগে যখন তার মতো মানুষকে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি পোড়ানোর মামলায় আসামি করা হয়। আবার রিমান্ডও মঞ্জুর করা হয়। শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে তার মতো লোকের সঙ্গে বার বার যে শিষ্টাচার-বহির্ভূত অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে সেটা কতখানি যুক্তিযুক্ত? এটা স্যাবোটাজ কিনা প্রধানমন্ত্রীর বিষয়টা ভেবে দেখা দরকার। এসব আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যতার ফল নয় কী? বাংলাদেশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক, বিএনপির নেতৃত্ব ও কার্যকলাপ পছন্দ করেন না। তারাও কিন্তু ব্যক্তি ফখরুলের ব্যক্তিত্বের জন্য তাকে দারুণভাবে পছন্দ করেন। সেসব মানুষ ও যারা রাজনীতির ধার ধারেন না তারা কিন্তু ফখরুলের গ্রেফতারের বিষয়টি খুব একটা ভালো চোখে দেখছেন না, তা কিন্তু সহজেই অনুমেয়। অদ্ভুত দেশ! এ দেশেই জন্মগ্রহণ করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক বড় বড় ত্যাগী নেতা, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী। নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ দেশের মানুষই পাকিস্তান হানাদারদের হটিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতি হিসেবে সেই বাংলার দিকে আমরা কী এগিয়ে যাচ্ছি, নাকি আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের দিকে ফিরে যাচ্ছি?

এ দেশেই ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি খালাস পায়। হাজার হাজার অপরাধী বুক ফুলিয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ায়। তাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে সরকার যতটা না আন্তরিক, তার চেয়ে বেশি আন্তরিক শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ মির্জা ফখরুলকে গ্রেফতারে। পাঠকের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখতে চাই মির্জা ফখরুলের ইন্টারনাল করোটিড আর্টারি ব্লক রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি আইবিএস, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে ভুগছেন। কারা চিকিৎসকের ভাষ্যমতে, তাকে ভাস্কুলার সার্জন, নিউরোলজিস্ট, গ্যাস্ট্রো এন্টোরোলজিস্ট ও কার্ডিওলজিস্ট দেখানো প্রয়োজন।

এমন একজন অসুস্থ মানুষকে গ্রেফতার করে সরকার কী রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন? চোখ বন্ধ করে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের ভেবে দেখার অনুরোধ রইল। মির্জা ফখরুলকে নিয়ে তার শুভানুধ্যায়ী বন্ধু-বান্ধব বিশেষ করে তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা বিরাজ করছে। আর এই শঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, বিনা চিকিৎসায় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন পিন্টু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গত ৫ মে মির্জা ফখরুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর বলেন, ফখরুলের অবস্থা গুরুতর নয় (সূত্র, ৬ মে দৈনিক ইত্তেফাক)। অথচ তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অবস্থা কতটা খারাপ হলে গুরুতর হবে! তাদের অভিযোগ, গত ৬ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে বের হওয়ার সময় যে রকম সুস্থ অবস্থায় তাকে জেলহাজতে নেওয়া হয়েছিল এখনকার শারীরিক অবস্থা সেরকম নেই। ডাক্তারের পরামর্শ ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে খাদ্যগ্রহণ করতে হয় বিধায় কারাগারে তিনি ঠিকমতো খাবার গ্রহণ করতে পারছেন না। ফলশ্রুতিতে তার ওজন কমে গেছে। প্রেসার নিচে নেমে গেছে। শরীর একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যরা তার উন্নত চিকিৎসা ও পর্যাপ্ত সেবা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে শিষ্টাচারের বড়ই অভাব। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নানারকম অনৈতিক কূটকৌশল গ্রহণ করতে রাজনীতিবিদদের বিবেক ও রুচিতে একটুও বাধে না। রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার স্বার্থে মির্জা ফখরুলের মতো নিঃস্বার্থ, ত্যাগী, পরিচ্ছন্ন ইমেজের লোক আজ বড় বেশি প্রয়োজন। সুতরাং তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সব মিথ্যা মামলা থেকে সসম্মানে তাকে অচিরেই মুক্তি দিয়ে সরকার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও শিষ্টাচারের পরিচয় দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। লেখক : শিক্ষক

 

সর্বশেষ খবর