সোমবার, ২৫ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাদ্য বাজায় টংকা

আবু তাহের

বাদ্য বাজায় টংকা

পার্সি ধর্মাবলম্বীরা আগুনপূজা করে। বহু শতক আগে বিপুলসংখ্যক পার্সি বিরাট এক ভূখণ্ডে বাস করত। তাই ওই জায়গাটির নাম হয়েছিল পার্সিয়া। বাঙালিরা পার্সিয়াকে বলত 'পারস্য'। সেই পারস্য কালক্রমে মুসলিম অধ্যুষিত হয়েছে। নাম হয়ে গেছে ইরান।

পেটের দায়ে বহু পার্সি ভারতে এসে স্থায়ী হয়েছে। এদের বংশধররা এখনো আছে ভারতের নানা এলাকায়। রাহুল গান্ধীর পিতামহ ফিরোজ গান্ধী ছিলেন পার্সি। মোগল আমলেও পারস্য থেকে বণিকরা তাদের কারওয়াঁ নিয়ে এসে ভারতে মাল বিক্রি করত। পণ্য বহনের অশ্বচালিত দুই চাকার গাড়ি, তবে তাতে শোয়া-বসার সুবিধার্থে ছাউনি দেওয়া, এরকম গাড়ির বহরকে ফার্সিতে 'কারওয়াঁ' বলা হয়। ঢাকা নগরীর যেখানে কারওয়াঁ থামিয়ে তারা মাল বেচত সে জায়গাটিই আজকের 'কাওরান বাজার।'

ঢাকার বাসিন্দারা খাঁটি উচ্চারণকে পরিহার করে সম্ভবত মজা পান। তারা ট্যাক্সিক বলেন, টেস্কি, রিকশাকে রিস্কা, পিকচারকে পিচকার এবং লোকসানকে বলেন, লোসকান। এই পন্থায় কারওয়াঁ হয়ে গেছে কাওরান। শুধু বুঝি না কী কারণে তারা বট নয়, তবু একটি গাছকে 'বট' নাম দিয়ে দিলেন। রমনা পার্কের যে গাছটির নিচে শিল্পীরা জড়ো হয়ে সমবেত কণ্ঠে 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো' গেয়ে বর্ষবরণ করেন, কাগজে কলমে ও লোকমুখে তা রমনার বটমূল। অথচ গাছটি অশ্বত্থ।

আমরা অবশ্য অশ্বত্থের কেউ নই। বটও আমাদের কেউ নয়। কারওয়াঁ? না, তা-ও আমাদের লাভ-ক্ষতি ঘটায় না। কারওয়াঁ যে ইংরেজিতে 'ক্যারাভান' হয়েছে তাতে পার্সিয়ান বা ইরানিরা আপত্তি করেছে, এমন রেকর্ড নেই। সম্রাট আকবরের আমলে পারস্য বণিকদের কারওয়াঁ আসছিল। কারওয়াঁর একটি গাড়িতে বসা এক বণিক আর তার কিশোরপুত্র। পথিমধ্যে একটি বাজারে বিক্রি হচ্ছিল আম। পুত্রটি 'আম খাবো আম খাবো' করায় গাড়ি থামে। পঞ্চাশটি আমের একটি ঝুড়ি কিনতে যায় বণিক। দোকানি দাম চায় দশ দিনার। কিশোর পুত্রকে বণিক বলে, 'দাম তো ভয়ানক বেশি। নাহ, কেনা যাবে না।'

লাহোরে মাল বিক্রি শেষে পারস্যে ফিরছে কারওয়াঁ। ফিরতি পথে আবার সেই বাজার। তিন ঝুড়ি আম কিনল বণিক। কোনো দরাদরি না করেই কেনা। বিস্মিত পুত্র বলে, যখন ঝুড়ি দশ দিনার ছিল তুমি কিনলে না। এখন তো দর তিনগুণ বেশি। তিন ঝুড়ি নব্বই দিনারে কিনে ফেললে!' বণিক বলে 'বাবারে কিছুই করিনি আমি। বাদ্য বাজিয়েছে দিনার। আগে আমার কেনার শক্তি ছিল না। লাহোরে মাল বেচে বিস্তর মুনাফা করেছি। দিনার আর দিনারে ভরে গেছে পুঁটুলি। ভয় কী আমার উঁচু দরে?'

দিনার বলি, ডলার বলি কিংবা বলি রুপি, পাউন্ড বা ইউরো, সব মুদ্রাই বাজে। টাকাও বাজে। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিষয়টাকে উপাদেয় ভাষায় মজুমদার সাহেব বলেছিলেন, 'বাদ্য বাজায় টংকা।' টাকাকে টংকা বলা হতো আদিকালে। পারস্য বণিকের কাহিনীটি জানার পর অনুভব করলাম, তাৎপর্যময় ব্যঞ্জনাগুলো ব্যাখ্যাতীত কায়দায় সমন্বিত করে চলে প্রকৃতি। সে জন্যই দেখা যায়, এক সংস্কৃতির মানুষের চিন্তার সংলগ্ন হচ্ছে আরেক সংস্কৃতির মানুষের ভাবনা। প্রতিধ্বনিও করছে। বণিক যা পুত্রকে ইঙ্গিত করেছিল মজুমদার সাহেবও তা-ই আমাদের ইঙ্গিত করলেন : অর্থশক্তির প্রভাবে কী হয় না হয়, বুঝিয়ে দিলেন।

পঞ্চাশোর্ধ্ব মজুমদার সাহেবের পদবির আগে নিশ্চয়ই কোনো নাম ছিল। আমাদের মফস্বল শহরের কেউই সে নাম জানত না। তার বস ছিলেন উচ্চস্তরের মূর্খ, এরকম অনেক অফিসেই থাকে, সে জন্য কান্নাকাটিতে সময় বরবাদ করা স্বাস্থ্যকর নয়। মজুমদার দেড় বছর ধরে বলতে থাকলেন, বস শুধু যে মূর্খ তা নয়, উনি মূর্খ ও চোর। এই দুই বৈশিষ্ট্যের কোনোটাই সমাজের হিতসাধনের অনুকূল হতে পারে না। বস বাদ্য বাজিয়ে দিলেন। দেড় বছর ধরে যে সহকর্মীরা সামনে তাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ তারা উল্টো গাইতে শুরু করে। তারা বলে, অফিসের ডিসিপ্লিন বলে একটা ব্যাপার তো আছে। অফিসের যিনি মা-বাপ তাকে কথায় কথায় মূর্খ বলাটা ভয়াবহ পাপাচার। বস মুখ বুজে অনেক সয়েছেন। মূর্খ বলছে তো বলছে, আবার বলছে মূর্খ প্লাস চোর। কতদিন সহ্য করবেন বস? সহ্য করারও তো লিমিট আছে নাকি?

স্বাধীনতা-উত্তর এক ফিল্মে দেখেছি, অভিনেতা আশীষ কুমার লোহ আর দিলীপ বিশ্বাস ঝগড়া করছেন। আশীষ বলছেন, 'তুই একটা মূর্খ, ছাগল।' দিলীপ বিশ্বাস বললেন, 'তুই আমারে কথায় কথায় মূর্খ আর ছাগল কয়ে গাল পাড়িস। আমার সহ্যের সীমা আছে। ছাগল কচ্ছিস সহ্য করলাম, ফের যদি আমারে মূর্খ বলিস তোরে মার্ডার করে ফালাব, হ্যাঁ।'

মার্ডারই হয়ে যেতেন মজুমদার সাহেব। মূর্খরা মার্ডার করতে ডরায় না। চোরদের সাহস কম থাকে। তাই খুনাখুনি হলো না। মজুমদারকে শুধু চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বানোয়াট অভিযোগগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়েছিল প্রিয় সহকর্মীরা। তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে অ্যাকশন নিয়েছে অফিস। টাকা নিয়ে বশীভূত হয়ে গেলেন একদার ন্যায়পরায়ণ সহকর্মীরা। মজুমদারের ভাষায়- 'টিয়া দি হ্যাতে বেগ্গুনরে দাসী বানাই ফালাইছে। বেইমানগুলার চেহারা মনে হইলেই অাঁই গলার মধ্যে আঙ্গুল ঢুকাইয়া বমি করি।'

হোসেন শরীফ যখন টাকার বাদ্য শুনিয়ে বাঘা বাঘা কিছু মর্দকে পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন তখন আমরা জনাচারেক যাদের তিনি শত চেষ্টায়ও পটাতে পারেননি- বমি করিনি। ঘৃণায় বমি করতে হবে, এমন চিন্তাও আমাদের মাথায় আসেনি। আমাদের মাথায় আসে, 'দেরে দে ছ্যাঁচা।' ১৯৭০-এর ভোট মৌসুমের আগে আমরা জিরো থেকে হিরো হওয়া ব্যবসাদার হোসেন শরীফকে কখনো দেখিনি। হঠাৎ তিনি ছয় দফা আদায় সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক হিসেবে এলাকায় অবতীর্ণ হলেন। অমুক আসনে দলীয় মনোনয়ন তার চাই-ই চাই।

প্রভাবশালী এক নেতার সমর্থন পেলেই নমিনেশন পাওয়া যাবে, তাই নেতার বেগমের আশপাশে বাকবাকুম বাকবাকুম করতে লাগলেন হোসেন শরীফ। মহিলাকে দামি দামি শাড়ি উপহার দিলেন। রটনা আছে, এই মহিলার বুদ্ধিতে পাতি নেতাদের হাত করে ফেললেন। এসব কেচ্ছা আমরা জানতে পাই অনেক পরে। ব্যাপারটি জানার আগে এক বিকালে দাঁড়িয়ে আছি টাউন হলের মোড়ে। রিকশা পাচ্ছিলাম না। দেখি দক্ষিণ দিক থেকে হোসেনের প্রাইভেট কার আসছে। গাড়ির ভিতরে বিক্রি হয়ে যাওয়া বাঘা বাঘা কিছু মর্দ। আমায় দেখে গাড়ি থামিয়ে হোসেন শরীফ প্রবল আন্তরিক গলায় বলেন, 'তুমি কোথায় যাবে?'

মেজাজ খিঁচড়ে গেল। ব্যাডায় আমারে 'তুমি' সম্বোধন করছে। বললাম, 'সোনাপুর যাব। তুমি কোথায় যাচ্ছ?' হোসেন শরীফ দ্রুত প্রস্থান করলেন। ওই দিন বিকালে আমরা গবেষণায় লিপ্ত হলাম 'আহমদ রেস্তোরাঁ'য়। কোন মন্ত্রে অনুরাগীর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন হোসেন? মজুমদার বলেন, 'হোসেন কিছুই করছে না। বাদ্য বাজায় টংকা।' শেষতক হোসেনকে আমরা রুখে দিতে পেরেছিলাম। নমিনেশন তিনি পাননি। যাদের বিস্তর কড়ি আরা বিস্তর উপহার দিয়েছিলেন তারা কোনো উপকারে না আসায় তিনি তাদের 'সানস অব বিচেস অ্যান্ড বাস্টার্ড' বলে গাল দিতেন। হোসেন পৃথিবী থেকে গত হন ১৯৮৬ সালে। টাকা উল্টোভাবে বাদ্য বাজানোয় তার মৃত্যু হয়। এই রচনার একেবারে শেষদিকে সেই বাদ্য-যন্ত্রণার কথা বলা যাবে। তার আগে সুপার স্টার সালমান খানের টংকাবিষয়ক বাদ্য শোনা যাক।

নরহত্যা মামলার আসামি সালমান খান ১৩ বছর ধরে আইনি লড়াই করছেন 'নির্দোষ' সাব্যস্ত হওয়ার জন্য। ভারতীয় পত্রপত্রিকা জানায়, টাকা তাকে এতদিন মুক্ত রেখেছে। চতুর যত উকিল সবাইকে খাটিয়েছেন সালমান। উকিলরা এমন আইনি মারপ্যাঁচ চালান যে 'বিচার করা যাবে কী যাবে না' প্রশ্নটিই ঝুলে থাকল অনেক দিন। শেষতক চলতি বছর বিচার শুরু হয়। ৬ মে রায় হয়েছে 'পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হলো।' অন্তর্বর্তী জামিনের জন্য সঙ্গে সঙ্গে আবেদন জানানো হয়। আবেদন জানানোর জন্য যেসব কাগজপত্র দরকার সেগুলো রকেট গতিতে এসে যায় উকিলের হাতে। দুই দিনের জামিন মঞ্জুর হয়। মঞ্জুরির কাগজপত্র পুলিশকে দেওয়ার জন্য আদালতের স্টাফরা নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পরও অফিস করেন। সাধারণত তারা অফিস সময়ের পর দুই মিনিটও কাজ করেন না। দুই দিন পরে উচ্চ আদালত আপিল শুনানির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সালমান খানের দণ্ড সাসপেন্ড ঘোষণা করেছেন। বিচার আদালত ও আপিল আদালতে সালমান খানের উকিল ছিলেন হরিশ সালভে। এই মহাশয়ের দৈনিক ফি ৩০ লাখ রুপি।

সালমানের পক্ষে হরিশ সালভে আদালতে দাঁড়িয়েছেন মোট ২৫ বার। ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানির সঙ্গে তার ছোটভাই অনিল আম্বানির মামলায় হরিশ ছিলেন বড় আম্বানির পক্ষে। এ জন্য নিয়েছিলেন ১৫ কোটি রুপি। তার মানে পাঁচবার দাঁড়িয়েছিলেন আদালতে। মুরুবি্ব সাংবাদিক এবিএম মূসা বলতেন, 'গুণী ডাক্তার আজরাইলরে দেরি করায়। গুণী উকিল জেলখানারে দূরে রাখে, জেলখানারে কাছে আনে, সম্পত্তি বাঁচায়, সম্পত্তি ছিনিয়েও নেয়। তোমার টাকা না থাকলে এই গুণীরা থাকবেন তোমার সহস্র হাত দূরে।'

মার্কিন কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছে হেনরি। ধর্ষণের দায়ে লোকটা সাত বছর সাজাভোগ করেছে। জেলার বলল, 'বেরিয়ে আবার ওই কুকাজ করে বেড়াবে। কী মজা, না?' হেনরি বলে, 'আমি মোটেই ওরকম নই স্যার। উকিলটা গুণী ছিল না। ওর যুক্তিতর্ক শুনে জজের মনে হয়েছে আমিই ধর্ষক। প্রকৃতপক্ষে আমি ছিলাম ঘটনার সাক্ষী।' সালমান গুণী উকিল পাওয়ায় তিনি গাড়িচাপা পড়েছেন, এরকম কিছু প্রমাণিত হয়নি। তার ভক্তরা আশাবাদী, আদালতে প্রমাণিত হবে সালমানচালিত গাড়ির নিচে চাপা পড়ে কেউ মারা যায়নি। টাকাঅলাদের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া নিয়ম।

হোসেন শরীফও আশাবাদী ছিলেন টাকায় টাকায় এসে যাবে প্রাণপ্রিয় দলের নামিনেশন। ১৯৮৬-এর সংসদে বসবেন তিনি। বিনিয়োগ করেছিলেন কোটি টাকারও বেশি। তাকে বলা হয়েছিল, নমিনেশন পাবেনই। কারও পিতার সাধ্য নেই ঠেকায়। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হলে তিনি ফোন করলে দলের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে কেউ একজন জানায়, 'স্যরি। আপনার নাম দেখছি না।' হোসেন শুধু বললেন, 'য়্যা?' বুকের বামদিকটা চেপে ধরে শুয়ে পড়লেন তিনি। দুই চোখ বোজা। চোখ আর খুললেন না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর