মঙ্গলবার, ২৬ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই পক্ষই অতৃপ্ত

বিভুরঞ্জন সরকার

বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই পক্ষই অতৃপ্ত

সদ্য সমাপ্ত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন যেন ছোটগল্পের সংজ্ঞার মতো হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তিকে ছোটগল্পের সংজ্ঞা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পঙ্ক্তিগুলো হচ্ছে, 'ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা, নিতান্তই সহজ সরল, নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ, অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ।' ছোটগল্পে বড় কোনো তত্ত্বকথা থাকে না, থাকে না উপদেশবাণী, সরল-সহজ-সাধারণ বিষয়ই ছোটগল্পের প্রধান উপজীব্য। ছোটগল্প পাঠ শেষে মনে হবে, আহা শেষ হয়ে গেল, আরেকটু হলে ভালো হতো। পাঠ শেষে অন্তরে এক ধরনের অতৃপ্তি যদি না থেকে যায় তাহলে সেটা সার্থক ছোটগল্প নয়। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনও শেষ হয়েছে, নবনির্বাচিত মেয়র-কাউন্সিলররা শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালনও শুরু করেছেন। কিন্তু শেষ হচ্ছে না এই নির্বাচন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, বিজয়ী হয়েছেন কিংবা পরাজিত- কেউই তৃপ্তি বোধ করছেন না। বিজয়ীরা খুশি মনে বিজয় উদযাপন করেননি কিংবা করতে পারেননি, আবার নির্বাচনে যারা পরাজিত হয়েছেন, যারা মনে করছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, তারাও তার পক্ষে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ হাজির করে জোরালো প্রতিবাদ করতে পারছেন না। বিজয়ীরা কোনো বিজয় মিছিল বা আনন্দ শোভাযাত্রা বের করেননি।

নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে মাঝপথে নির্বাচন বর্জন করা সত্ত্বেও ফলাফল ঘোষণার পর বিএনপি কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। না হরতাল, না অবরোধ, না নিদেনপক্ষে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও। এমনকি প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনেও দাঁড়াতে দেখা গেল না বিএনপি সমর্থক নানা নামের বিচিত্র সব সংগঠনের কোনোটিকে। ভোটকেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতির উৎসব ইত্যাদি গুরুতর অভিযোগ উত্থাপনের পরও বিএনপির এভাবে শীতল প্রতিক্রিয়া দেখানো নিয়ে নানা কানাঘুষা চলছে। কেউ বলছেন, বিএনপির অবস্থা এখন 'অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।' আগে অসময়ে বেশি বেশি কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি তার শক্তি ক্ষয় করে ফেলেছে বলেই নির্বাচনের পর, যখন প্রতিবাদী কর্মসূচি দেওয়াটা প্রয়োজন ছিল তখন সেটা দেওয়ার সক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলেছে। আবার কেউ বলছেন, আন্দোলন করতে গিয়ে ধাক্কা খেতে খেতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে কিছুটা রাজনৈতিক 'ম্যাচিউরিটি' এসেছে। বিএনপি নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারছেন, যেভাবে বা যে ধারায় তারা রাজনীতি করছেন, সেভাবে বা সে ধারায় আর চলা যাবে না। একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে, কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত না করে সন্ত্রাস-সহিংসতার পথ বেছে নিয়ে আর সামনে এগুনো যাবে না। সব কিছু ভালোভাবে পর্যালোচনা-মূল্যায়ন করতে হবে; হিসাব-নিকাশ করেই পরবর্তী পদক্ষেপ ফেলতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্ভবত পুরো পরিস্থিতিটা আবার নতুন করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাশার বাইরে কিছু হয়নি। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে। কেউ যদি বলেন, এমন ফলাফল আমরা চাইনি, তাহলে তারা আসলে সত্য বলছেন না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল বিজয়ী হওয়ার জন্য; যে কোনো মূল্যে বিজয় পাওয়াটাই তাদের লক্ষ্য ছিল। তারা বিজয় পেয়েছে। আগের পাঁচ সিটি নির্বাচনে হেরে তারা সমালোচিত হয়েছে। এবার তারা ঠিক করেছিল, সমালোচনা যদি হয়ই তাহলে জিতেই হোক। তবে জয়লাভ করেও আওয়ামী লীগের অতৃপ্তি আছে। তাদের অতৃপ্তির কারণ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের লাখ লাখ ভোট প্রাপ্তি। আন্দোলনের নামে দেশে বার বার ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর কোনো সুস্থ বুদ্ধির মানুষ বিএনপিকে ভোট দিতে পারে না মনে করা হলেও তিন সিটিতেই অসংখ্য মানুষ বিএনপিকে ভোট দিয়েছে।

বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভের জন্য অংশগ্রহণ করেনি। তারা চেয়েছে নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে, প্রশ্নবিদ্ধ করতে। এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়- এটা প্রমাণ করাই ছিল এই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের প্রধান উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে বিএনপিও সফল হয়েছে। নির্বাচন যে শতভাগ ভালো হয়নি, সেটা অনেকেই স্বীকার করছেন। বিএনপির সবচেয়ে বড় সাফল্য, তারা এই নির্বাচনে দেশের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যমের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছে। গণমাধ্যম যদি ভোটকে বিতর্কিত করার বিএনপির উদ্দেশ্যের সঙ্গে একাত্দতা না দেখাত তাহলে সমস্যা ছিল। ভোটকেন্দ্র দখল হয়েছে, জাল ভোট দেওয়া হয়েছে- এসব কথা কোনো কোনো গণমাধ্যমে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ঢালাওভাবে না এলে বিদেশিরা এই নির্বাচন নিয়ে যেরকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সেরকম করতে পারতেন না। তিন মাসের নাশকতা ও সহিংস নিষ্ঠুর আন্দোলনে বেগম জিয়া মানুষের জীবন, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সম্পদের যে বিপুল ক্ষতি করেছেন সে জন্য গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচিত না হয়ে এক ধরনের সহানুভূতিই পেয়েছেন। বিএনপির নেতৃত্বের উচিত গণমাধ্যমের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা।

তারপরও নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অতৃপ্তি আছে। 'জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে'- এই দাবি বক্তৃতা-বিবৃতিতে করলেও বেগম জিয়া এবং তার পরামর্শদাতারা সত্যিকার অর্থে জনগণ তাদের সঙ্গে কতটা আছে, সে বিষয়ে আস্থা রাখতে পারেননি। ভোটের ফলাফল থেকে তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, তারা যতটা আশা করেন, জনগণ তার চেয়ে বেশিই তাদের সঙ্গে আছে। এটা যদি আগে বুঝতে পারতেন, তাহলে নির্বাচনটা তারা আরেকটু সিরিয়াসলি করতেন। এমনকি দুপুরের মধ্যেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণাও হয়তো নিতেন না। শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলে ভোটের ফলাফল কী হতো বলা যায় না। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয় না পেলেও লড়াইটা হতো হাড্ডাহাড্ডি। নির্বাচন স্বচ্ছ হয়নি বলে বিদেশিরা যে কথা বলেছেন, তার সুফল পুরোটা বিএনপি ঘরে তুলতে পারছে না, কারণ বিদেশিরা বিএনপির নির্বাচন বর্জন করাটাও ভালোভাবে নেয়নি। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, এটা যেমন তারা বলেছেন, তেমনি একই সঙ্গে তারা বিএনপির নির্বাচন বর্জনেরও সমালোচনা করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অপরাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের গত এবং বর্তমান মেয়াদে বেগম জিয়া একাধিকবার সরকার পতনের আন্দোলন করেছেন। আন্দোলনের নামে দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা চালানো হয়েছে। অনেক মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যানবাহনসহ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো হয়েছে নজিরবিহীন। কিন্তু দাবি আদায় হয়নি। আন্দোলনের নামে অকারণ শক্তিক্ষয় করে সারা দেশে বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোর এখন বিপর্যস্ত অবস্থা। বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা কতটা নড়বড়ে হয়েছে, তার কিছুটা প্রমাণ তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পাওয়া গেছে। সংগঠন নড়বড়ে হলেও বিএনপিতে বেশ কিছু বাকপটু লোক আছেন। যারা সুযোগ পেলেই মিডিয়ায় হাজির হয়ে বড় বড় কথা বলেন। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই। একটু ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে। তাদের হুমকি-ধমকিতে সরকার যখন কঠোর হয়, গ্রেফতার-মামলার পথে যায় তখন ওই বাক্যবাগীশরা আড়ালে সরে যান। এরা সুযোগসন্ধানী, সুবিধাভোগী এবং নেতৃত্বলোভী। এরা কষ্ট করতে চায় না, ত্যাগ স্বীকার করতে চায় না। এরা মানুষের জন্য রাজনীতি করে না। এদের রাজনীতি নিজেদের জন্য, নিজেদের ভাগ্য গড়ার জন্য। অথচ এদের কথার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন, সবাইকে মাঠে নামতে বলেন। কিন্তু এরা মাঠে নামেন না; বেগম জিয়ার আন্দোলনও সফল হয় না।

সিটি নির্বাচন থেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক কিছু শেখার আছে। আওয়ামী লীগের জন্য শিক্ষণীয় হচ্ছে, তাদের গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে, হেলাফেলা না করে সংগঠনের দিকে নজর দিতে হবে। দল সংগঠিত ও সক্রিয় না হলে সরকার ভালোভাবে চলবে না। আমলা-প্রশাসনের ওপর অতিনির্ভরতা, সরকারের ওপর দলের নিয়ন্ত্রণ না থাকা একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। আরও মনে রাখার বিষয় হচ্ছে, কেবল উন্নয়নমূলক কাজ করলেই ভোট পাওয়া যায় না। ভোটের রাজনীতিতে নানা ফ্যাক্টর কাজ করে। মানুষ যেসব জিনিস পছন্দ করে না- (যেমন নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ি, বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতি) সেসব থেকে আওয়ামী লীগকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। দেশের বড় বড় সব সমস্যা সমাধানে সফলতা দেখানোর পরও একশ্রেণির মানুষের মন থেকে কেন আওয়ামী বিরোধিতা দূর হয় না, সেটা খুঁজে দেখা দরকার। ধর্ম নিয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যে অপপ্রচার চালানো হয়, সেটা কেন অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয়, কেন এই অপপ্রচারের উপযুক্ত জবাব আওয়ামী লীগ দিতে পারে না, এ ক্ষেত্রে করণীয় কী সেটা ভাবা দরকার। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ছোট-বড় সব নেতাই অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ধর্ম পালনে সব ধরনের সহযোগিতাও দেওয়া হয়। তারপরও কেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ধর্মহীনতার অভিযোগ জড়াজড়ি করে চলে তা অনুসন্ধান করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিএনপির জন্য সিটি নির্বাচন থেকে শেখার বিষয় হচ্ছে, মানুষের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে সব ধরনের হঠকারিতা থেকে সরে আসতে হবে দলটিকে। সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অধৈর্য হওয়া চলবে না। মানুষ সংঘাত-সহিংসতা চায় না, পছন্দ করে না। দেশের মানুষের একটি বড় অংশ বিএনপিকে ভোট দেয়, ভোট দিতে চায়। কাজেই ভোটের রাজনীতিতেই বিএনপিকে আস্থা রাখতে হবে। আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা, নাশকতা, সন্ত্রাস একেবারেই বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সময় হচ্ছে রাজনীতির একটি বড় ফ্যাক্টর। উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। জামায়াতের ব্যাপারেও দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে বিএনপিকে। বিএনপিকে বিএনপির রাজনীতি নিয়েই অগ্রসর হতে হবে, জামায়াতের পেটের মধ্যে ঢুকে গেলে চলবে না। জামায়াতের আগ্রাসী থাবা থেকে বের হতে বিএনপি যত দেরি করবে, বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো-শক্তি ততই শিথিল হতে থাকবে। শেখ হাসিনা এবং তার সরকারকে ছলে-বলে-কৌশলে ফেলে দেওয়ার অপচেষ্টা যে সফল হওয়ার নয়, এটা যদি বিএনপি নেতৃত্ব এখনো বুঝতে না পারেন তাহলে তাদের দুঃসময় দীর্ঘতর হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর