শুক্রবার, ২৯ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

লাইলাতুল বরাত বা মুক্তির রাত

মুফতি আমজাদ হোসাইন

লাইলাতুল বরাত বা মুক্তির রাত

আগামী ১৪ শাবান ১৪৩৬ হিজরি মোতাবেক ০২/০৬/২০১৫ রোজ মঙ্গলবার দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত বা মুক্তির রাত। আমাদের সমাজে পবিত্র শবেবরাত নামে প্রসিদ্ধ। শবেবরাত ফার্সি শব্দ। 'শব' অর্থ রাত আর 'বরাত' অর্থ মুক্তি। সুতরাং অর্থ হলো মুক্তির রাত। অনেক মুসলমান ভাই শবে বরাতের অর্থ ও মাহাত্ম্য কোনোটাই বুঝে না। বাপ-দাদাদের অন্ধ অনুসরণ করে আসছে। তারা বলে থাকে, শবে বরাতের রাত বা লাইলাতুল বরাতের রাত। তাদের খবর নেই 'লাইলাতুল' বা 'শব' অর্থ হলো রাত। আমি অনেক শুনেছি, মাইকে খুব হাঁকডাক করে বলতে থাকে আজকে লাইতুল বরাতের রাত বা শবে বরতের রাত। তারা শবে বরাতের মাহাত্ম্য বা দাবি কি এটাও বুঝে না। এই রাত এলে আলোকসজ্জা, আতশবাজি, মোমবাতি জ্বালানো, ছোট বাচ্চাদের পটকা ফোটানো, হালুয়া-রুটি তৈরি করার মধ্যেই শবে বরাতের মাহাত্ম্য লুকায়িত আছে বলে মনে করে। বিশেষ করে মা-বোনেরা ১৪ শাবান বিকাল থেকে হালুয়া-রুটি তৈরির পেছনে সময় ব্যয় করে। এভাবে খেয়েদেয়ে, গল্পগুজব আর আলাপচারিতায় পুরো রাত শেষ হয়ে যায়। অনেক সময় এশা ও ফজরের নামাজও ছুটে যায়। পরের দিন পান চিবাইতে চিবাইতে একে অপরের কাছে গল্প করে, গত রাতে অনেক ইবাদত করেছি। এ ধরনের বদ-রছমকে ইবাদত মনে করা গুনাহে কবিরা। আল্লাহপাক তওবা ব্যতীত গুনাহে কবিরা ক্ষমা করেন না। অনেক পুরুষ ভাইকে দেখা যায়, এ রাত এলে মহল্লার কয়জন মিলে জায়নামাজ কাঁধে নিয়ে মসজিদে যায়। পথে বিভিন্ন আড্ডা চলতে থাকে। এক সময় দেখা যায় তারা মসজিদে যেতে যেতে জামাত শেষ হয়ে যায়। মসজিদে প্রবেশ করে কয়েক রাকাত নামাজ পড়ে, আবার চা-স্টলে বসে চা-পান ইত্যাদি পর্ব সেরে অন্য মসজিদে যায়। সেখানে দুই-চার রাকাত নামাজ পড়ে বাসাবাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের ফজরের নামাজ কখন ছুটে যায় তার কোনো খবরই থাকে না। এমন কাজে সময় নষ্ট করাকেই শবে বরাত পালন করেছে বলে দাবি করে। অথচ তিরমিজি, ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি শরিফের এক হাদিসে শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেক হয়ে যায় অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত হয়, তখন তোমরা সেই রাত জাগরণ কর ও পরের দিন রোজা রাখ। নিশ্চয়ই আল্লাহপাক এ রাতে প্রথম আকাশে এসে বান্দাদের ডেকে ডেকে বলতে থাকেন, যারা পাপ থেকে মুক্তি চাওয়ার আছ মুক্তি চাও মুক্ত করে দিব, যারা অভাব-অনটন থেকে মুক্তি চাও, মুক্তি দিয়ে দিব। যারা নিজেদের রিজিক বৃদ্ধি করতে চাও, রিজিক বাড়িয়ে দিব। এভাবে আল্লাহপাক ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত বান্দাদের বলতে থাকেন তুমি আমার কাছে আজ রাতে যা চাইবে তাই আমি তোমাকে দিয়ে দিব। এ হাদিস দ্বারা যেমনিভাবে শবে বরাত প্রমাণিত হয় অনুরূপ শবে বরাতের আমল সম্পর্কেও সংক্ষিপ্তভাবে দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। প্রিয় পাঠক, আপনি এই হাদিসের মর্মবাণী বোঝার চেষ্টা করুন। নিজেকে পণ্ডিত মনে না করে হক্কানি উলামায়ে কেরামদের শরণাপন্ন হওয়ার অনুরোধ করছি। তারা আপনাকে বুঝিয়ে দেবেন। কিভাবে শবে বরাতের আমল করতে হবে। নিঃসন্দেহে শবে বরাত গুনাহ থেকে মুক্তির রাত, অভাব-অনটন থেকে মুক্তির রাত, রোগ-শোক থেকে মুক্তির রাত। আপনি যদি হেলায়-ফেলায়, হাসি-তামাশায় রাতটি পার করেন, তাহলে কিভাবে শবে বরাতের ফজিলত পাবেন? একটু ভেবে দেখুন। আমাদের বুঝতে হবে। শবে বরতের আমল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত নফল আমল। নফল আমল অন্যকে কষ্ট দিয়ে সমষ্টিগতভাবে হয় না। অনেক এলাকায় দেখা যায়, মসজিদের মাইক চালু করে শবে বরাত পালন করা হয়। গভীর রাত পর্যন্ত মাইক বাজিয়ে অন্য মানুষের ইবাদতের বিঘ্ন ঘটানো হয়। অনেকের ঘরে রুগ্ন বা মাজুর ব্যক্তি আছে, যারা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। মাইক বাজানোর কারণে তাদের আরামে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। যা কোনোভাবেই শরিয়ত সাপোর্ট করে না। এতে অনেকের কষ্ট হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে অপর ভাইকে কষ্ট দেওয়া হারাম। নফল কাজ করতে গিয়ে হারামে লিপ্ত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। মিশকাত শরিফের এক হাদিসে আছে, এক মুসলমান কর্তৃক অপর মুসলমানকে কষ্ট দেওয়া হারাম। আমরা কেন নফল সওয়াব কামাই করার জন্য হারামে লিপ্ত হব? তা কি ভেবে দেখেছি? বিষয়টি ওই ব্যক্তির মতো হয়ে যাচ্ছে না? এক বেচারা ওয়াজে শুনেছে, পাগড়ি মাথায় বেঁধে এক রাকাত নামাজ পড়লে সত্তর রাকাত নামাজের সওয়াব পাওয়া যায়। এই বেচারা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আজ থেকে পাগড়ি মাথায় দিয়েই নামাজ আদায় করব। এভাবে চিন্তা করে মসজিদে গেল। ইমাম সাহেব নামাজ শুরু করে দিয়েছেন। বেচারা মাথায় হাত দিয়ে দেখে মাথায় পাগড়ি নেই। কালবিলম্ব না করে পরনের লুঙ্গি খুলেই পাগড়ি বানিয়ে নামাজ পড়তে আরম্ভ করে দিল। ওইদিকে তার শিল্প এলাকা খুলে টান টান হয়ে আছে। সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। নামাজের পরে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, নামাজে এমন আচরণ কেন সে করল? সে উত্তরে বলল, ভাই আমি তো ওয়াজে শুনেছি পাগড়ি মাথায় বেঁধে নামাজ পড়লে এক রাকাতে সত্তর রাকাতের সওয়াব। জীবনে তো বহু নামাজ ছেড়েছি। এখন যদি পাগড়ি বাঁধার কারণে সত্তর রাকাতের সওয়াব পাওয়া যায় তাহলে খারাপ কি? তাকে বলা হলো, আরে ভাই আপনি তো হুজুরের কথা বুঝেননি। তিনি কি আপনাকে ফরজ তরক করে পাগড়ি বাঁধতে বলছেন? সে বলল না তা তো বলেননি। বেচারা আক্ষেপ আর লজ্জায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। আমাদের সমাজে অনেক মানুষ ইবাদতের ক্ষেত্রে বেশি বাড়াবাড়ি করে আমল বরবাদ গুনাহ লাযেম করে থাকে। তারা একদিন পরকালে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে আক্ষেপ করে বুক চাপড়াইতে থাকবে। বলতে থাকবে আমরা যদি নবী, অলি ও উলামায়ে কেরামদের নির্দেশনা মতো ইবাদত করতাম তাহলে আজকে আমাদের এই পরিণাম হতো না। তারা তো আমাদের কাছে সব কিছু বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। আমরা নিজেদের পণ্ডিত মনে করে তাদের কথা মানতে পারিনি। আল্লাহপাক আমাদের সঠিকভাবে ইবাদত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া মাদানিয়া, বারিধারা, ঢাকা।

 

সর্বশেষ খবর