রবিবার, ৩১ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

থাই সম্মেলন এবং দুর্ভাগ্যের নৌকা যাত্রীদের ভবিষ্যৎ

মুহাম্মদ রুহুল আমীন

থাই সম্মেলন এবং দুর্ভাগ্যের নৌকা যাত্রীদের ভবিষ্যৎ

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু এবং বাংলাদেশের যেসব নাগরিক মালয়েশিয়ায় কাজের সন্ধানে সাগরের উন্মত্ত বক্ষে নৌকা-যাত্রার ঝুঁকি নিয়েছেন, তাদের দুর্ভাগ্যের ইতি টানতে ২৯ মে থাইল্যান্ডে উচ্চ পর্যায়ের অভিবাসী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ১৫টি দেশ এ সম্মেলনে অংশ নেয়। পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও সুইজারল্যান্ড।

প্রথমেই আমরা আলোকপাত করব নৌকার যাত্রীদের দুর্ভাগ্যের ইতিকথার ওপর। এ পর্যন্ত পত্র-পত্রিকা এবং বিশ্ব মিডিয়ার মাধ্যমে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সনি্নকটে সমুদ্রতটের নৌকা যাত্রীদের দুর্ভাগ্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিশ্লেষিত হয়েছে। প্রথমটি হলো- মিয়ানমারে জন্মগ্রহণ করা, মিয়ানমারের আলো, বাতাস ও মাটিতে বেড়ে ওঠা এবং মিয়ানমারের ভূমিতে বাসিন্দা হওয়ার ঐতিহাসিক অধিকার রক্ষা করে আসা রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা নাগরিকরা কয়েক বছর ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারা নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজ বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন। সরকারি আইন-কানুনেও তাদের রক্ষা করার কোনো প্রক্রিয়া রাখা হয়নি। উপরন্তু রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের মুখে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়কর অবস্থায় পতিত হয়েছে। স্বদেশের সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ দ্বারা সর্বমুখী অত্যাচার, শোষণ-নিপীড়নের মুখে বাধ্য হয়ে সাগরে নৌকায় ভাসতে ভাসতে তারা অজানার উদ্দেশ্যে আশ্রয় খুঁজছেন। দ্বিতীয় কারণ হলো, বাংলাদেশের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং বিশ্বের বিশেষত আরব বিশ্বের শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হওয়ায় বাংলাদেশের চাকরিপ্রার্থী তরুণরা একই পথে অজানা গন্তব্যে চাকরির অন্বেষণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর যাত্রায় নৌকায় সওয়ার হয়েছেন।

থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া উপকূলে সেই নৌকা যাত্রীদের যে সীমাহীন দুর্ভাগ্যের কাহিনী আমরা জেনেছি তা আদৌ বাস্তব বলে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কথা নয়। এ যেন কেচ্ছাকাহিনী, অবিশ্বাস্য বানোয়াট গল্পগুচ্ছ মনে হলেও তা আসলেই বাস্তবতা। বর্তমান পৃথিবীতে মানব-বিপর্যয়ের সবচেয়ে করুণ ও বেদনাবিধুর। কোনো কোনো নৌকার যাত্রীরা তীরে ভিড়লে তীরস্থ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার সীমানা আইনের আন্তর্জাতিকতার অজুহাতে ধাক্কা দিয়ে তাদের মধ্য সাগরে ঠেলে দিয়েছে। কখনো কখনো জলদস্যুর হামলার শিকার হয়ে বিস্বাদ শর্বরীতে আত্মাহুতি দিয়েছেন। ক্ষুধার যন্ত্রণায় এ অসহায় উদ্বাস্তু মানুষগুলো সাগরবক্ষের ভাসমান গাছপালা, লতাপাতা, গাছের শিকড় নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন। তৃষ্ণার্ত-পিপাসার্ত এ নৌকা যাত্রীদের উদ্দেশ্যে উন্নত ধনী দেশগুলো আকাশপথে বিমান থেকে খাদ্য ও পানীয় ছুড়েছে, আর তার দখল নিয়ে নিরন্তর লড়াই করতে দেখা গেছে সাগরবক্ষের এ দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষদের। অসীম তৃষ্ণায় কাতর ছটফট করতে করতে কখনো দুর্ভাগ্যের নৌকা যাত্রীরা নিজেদের মলমূত্র খেয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটাচ্ছেন।

এমনি এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়কর অবস্থায় থাইল্যান্ড সম্মেলন সম্পন্ন হলো। সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ভারত মহাসাগরে বেআইনি অভিবাসন প্রক্রিয়া রোধ করা।

২৯ মের আঞ্চলিক সম্মেলনের সফলতা নিয়ে সন্দেহ যে কম নয় তা অনুমান করা যায়। মিয়ানমার অভিবাসন সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা রক্ষা করা হবে কিনা নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে দেশটির সব সিদ্ধান্ত প্রণয়নকারী সংস্থা দায়ী। গোটা রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিয়ানমারের জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশকে জাতিগত নিধনের মাধ্যমে মূলোৎপাটন করতে চাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক হতে হয়, যখন গণতন্ত্রের মানসকন্যা অং সান সু চি রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। ২০১৩ সালে রাখাইন প্রদেশের বৌদ্ধ ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে ধর্মীয় অসন্তোষ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপুল রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হন এবং অনেকে বাস্তুচ্যুত হন। একটি স্বাধীন দেশের জনগণের অবিভাজ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন সর্বতোভাবে লঙ্ঘন করে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের জাতিগত নিধনে টার্গেট করা হয়।

দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক বিশ্লেষণে রোহিঙ্গা বিষয়ে সু চির নীরবতার পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। সু চি'র দল এনএলডির এক মুখপাত্র মনে করেন, ৯০ শতাংশ বৌদ্ধ-অধ্যুষিত দেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি দেখালে সু চির রাজনৈতিক আত্মহত্যার পথ ত্বরান্বিত হবে। এমন বস্তাপচা যুক্তির মাধ্যমে সার্বজনীন মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করা সু চির মতো নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নেত্রীর জন্য অবমাননাকর। বরং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার এজেন্ডা থাকা উচিত তার রাজনৈতিক মেনিফেস্টোতে। আর তা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মধ্যেই তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকা উচিত। ১৮ মে সু চির রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং তার দলের মুখপাত্র নেয়ান উইন দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, রোহিঙ্গারা মানুষ। তাদের মানবাধিকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। একজন রাজনীতিবিদের এমন স্বীকৃতির কারণে সু চির দলের মুখপাত্রের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আদৌ ক্ষুণ্ন হয়নি।

রোহিঙ্গাদের প্রতি আরেকটি অবিচার করা হচ্ছে তাদের বাংলাদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করে বাংলাদেশে জোর করে ঠেলে দেওয়ার মাধ্যমে। ইতিমধ্যে মিয়ানমার জলসীমায় আটকেপড়া রোহিঙ্গাদের ধরে ধরে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে মিয়ানমার সরকার।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমাজের চাপ বৃদ্ধি প্রয়োজন। আনন্দের খবর হলো, ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং জাতিসংঘ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রদানে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়া শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি বি্লংকেন ইয়াংগুনে সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারে ১.৩ মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে নাগরিক স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কারণ তাদের নাগরিক অধিকার পাওয়ার পথ প্রশস্ত না হলে মানবিক বিপর্যয় বাধাহীন হয়ে উঠবে।

ইইউর আইন প্রণেতারা রোহিঙ্গাদের প্রতি জুলুম নির্যাতন বন্ধ করতে মিয়ানমার এবং থাই সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ প্রথম থেকেই অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার প্রদানে মিয়ানমার সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আসছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো উপরোক্ত কূটনৈতিক উদ্যোগসমূহ কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচার প্রদর্শন করছে, যা এ মুহূর্তে কোনো কার্যকর কৌশল হতে পারে না। এখন প্রয়োজন রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নতুবা মিয়ানমারের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

বাংলাদেশের যেসব মানুষ সমুদ্রে ভাসছে তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের নীতি স্পষ্ট করে তাদের বৈধ কাগজপত্র সরবরাহ করে বিদেশ গমনে সহায়তা করা প্রয়োজন। যে মানুষগুলো সাগরে ভাসছে তাদের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করে ভবিষ্যতে এমন বেদনাদায়ক দৃশ্যের অবতারণা যেন না হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাসমূহের সচেতনতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের সিংহ ভাগ আসে শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে, ফলে সেই রেমিট্যান্স অর্জনের পথ যেন সম্মানজনক ও শান্তিময় হয়, সে জন্য সরকারের উচিত বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর নিয়মকানুন পরিশীলিত করা এবং এ ব্যাপারে আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের চাকরিপ্রার্থীদের প্রবেশাধিকার সহজ করার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের দায়বদ্ধতা অপরিসীম।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিন

স্কুল বিজনেস, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

ই-মেইল- [email protected]

 

সর্বশেষ খবর