রবিবার, ৩১ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

চলে গেলেন টরে টক্কার সাংবাদিক জমির আহমেদ টুন

ফখরে আলম

চলে গেলেন টরে টক্কার সাংবাদিক জমির আহমেদ টুন

টুন ভাই ডিআইজি হতে পারতেন। সচিব হতে পারতেন। হতে পারতেন কাস্টমস কমিশনার। কিন্তু তিনি সাংবাদিক হয়েছেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। সৎ সাংবাদিকতার আলো জ্বেলে আমাদের সাংবাদিকতার নতুন দিনের পথ চিনিয়েছেন। সাংবাদিকতায় সুদীর্ঘ ৫০ বছর পূর্ণ করে পূর্ণপ্রাণ হয়েছেন। ঢাকার বাইরে মফস্বলে বসবাস করে টুন ভাইয়ের এই পূর্ণতা সাংবাদিকতার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। আমাদের সবার প্রিয় সেই টুন ভাই সাংবাদিকতার ইতিহাসের চাদর মুড়ি দিয়ে ২২ মে ২০১৫ সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।

শেখ মোহাম্মদ জমির আহমেদ টুন ১৯৩৪ সালের ১ অক্টোবর ঝিকরগাছায় জন্মগ্রহণ করেন। আমি যখন অদৃশ্য মায়ের গর্ভেও নয়। ১৯৫৬ সালে টুন ভাই স্নাতক হন। আর আমার যখন দুই বছর বয়স ১৯৬৩ সালে টুন ভাই সাংবাদিক। টুন ভাইয়ের বন্ধুদের কেউ সচিব, কেউ ব্যারিস্টার, কেউ ঊর্ধ্বতন আমলা হিসেবে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু টুন ভাই সেই ১৯৩৪ সালে যে কলম ধরেছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই কলমে সংবাদ লিখেছেন। তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু অ্যাডভোকেট তৌহিদুর রহমানের হাত ধরে টুন ভাই ১৯৬৩ সালে এপিপিতে ক্রীড়া সাংবাদিকতার মাধ্যমে সাংবাদিকতার পৃথিবীতে প্রবেশ করেন। ১৯৬৪ সালে মর্নিং নিউজের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে তার সাংবাদিকতার কর্মজীবন শুরু। এরপর তিনি ডেইলি মর্নিং পোস্ট, রেডিও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ টাইমস, বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ বেতারে সুদীর্ঘ ৫০ বছর সাংবাদিকতা করেছেন। সাংবাদিকতার জীবন তার বর্ণাঢ্য। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, জনপ্রতিনিধি, খ্যাতিমান ব্যক্তিদের খবর তিনি লিখেছেন। ৮০ বছর বয়সেও তারুণ্যের প্রতীক টুন ভাই প্রতিদিন খবর লিখে তরুণ সাংবাদিকদের এক হাত দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ম্যানুয়াল এবং ডিজিটাল যুগ তিনি খুুব কাছ থেকে দেখেছেন। ষাটের দশকে পোস্ট কার্ডের মাধ্যমে খবর লিখে ডাক বিভাগের সহায়তায় ঢাকায় পত্রিকা অফিসে পাঠিয়েছেন। এ সময় গুরুত্বপূর্ণ খবর টেলিগ্রামের মাধ্যমেও পাঠিয়েছেন। শহরের দড়াটানায় টুন ভাইদের দুলদুল ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকান ছিল। এই ফার্মেসিকে ঘিরেই যশোরের সাংবাদিকদের দ্বিতীয় প্রেসক্লাব গড়ে ওঠে। ইত্তেফাকের আফজাল সিদ্দীকি, আইয়ুব হোসেন, এপিপির তৌহিদুর রহমান, পূর্বদেশের মশিউল আযমসহ আরও কয়েকজন সাংবাদিকের ভাতবাড়ি ছিল দুলদুল ফার্মেসি। ইংরেজির জাহাজ টুন ভাই টাইপ রাইটারে ইংরেজিতে খবর লিখতেন। অন্যরা সেই খবরের কপি নিয়ে প্রধান ডাকঘরের পূর্বপাশে টেলিগ্রাফ অফিসে ছুটে আসতেন। ৫ টাকা ৭ টাকার বিনিময়ে টরে টক্কের শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে তামার তারের ভিতর দিয়ে খবর পৌঁছে যেত ঢাকায়। পরবর্তীতে টুন ভাই টেলিফোনের এনডবি্লউডি লাইনের মাধ্যমে ঢাকায় খবর পাঠিয়েছেন। নব্বই দশকে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন সুবিধায় তিনি ফ্যাক্স মেশিনের মাধ্যমে সাদা কাগজে লিখে খবর পাঠিয়েছেন। পরবর্তীতে মোবাইল ফোনে বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। এখন তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবে ম্যানুয়াল টুন ভাইও ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়ে ই-মেইলে খবর সেন্ট করছেন। টুন ভাই খবরের খোলনলচে দেখেছেন। পোস্টকার্ড থেকে ই-মেইলে সংবাদ পাঠানোর সাক্ষী হয়ে আছেন।

১৯৯১ সালে যশোর থেকে আমার সাংবাদিকতা শুরু। এ সময়ই পরিচয় হয় টুন ভাইয়ের সঙ্গে। তখন থেকেই চশমা চোখে প্রতিদিন তিনি খবরের সন্ধানে ঘর থেকে বের হয়েছেন। ইংরেজিতে কথা বলেছেন। ইংরেজিতে খবর লিখেছেন। মফস্বলের এক অতি স্মার্ট সাংবাদিক ডিসি-এসপির অফিসে যখন তখন গেছেন। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। আমি তার এই ইতিবাচক বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। নব্বই দশকে তার সঙ্গে সরেজমিন গিয়ে শুড়ো বাঘডাঙ্গার গণডাকাতি, কারাবিদ্রোহ, ধানে মাজরা পোকার আক্রমণের খবর সংগ্রহ করেছি। জটিল কোনো অনুবাদে তার শরণাপন্ন হয়েছি। আমি ক্যান্সারে আক্রান্তের পর আমার পায়ের তলা, হাতের তালু জ্বলে পুড়ে ছারখার হলে উপশমের জন্য ভারতের চিকিৎসকদের কাছে জরুরি ই-মেইল করার প্রয়োজনে টুন ভাইয়ের কাছে ছুটে গিয়েছি। তিনি আমাকে কম্পিউটারের মতোন বলেছেন, 'পায়ের পাতার ইংরেজি feet, হাতের তালুর ইংরেজি palm।' মফস্বলের সাংবাদিকতার নায়ক টুন ভাই। তিনি সচিব কিংবা বড় আমলা হতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস হয়েছেন। ইতিহাস হয়ে কালজয় করেছেন। মফস্বল সাংবাদিকতার ইতিহাসে তিনি অমর।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক [email protected]

 

সর্বশেষ খবর