মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা
বিচিত্রিতা

বিড়াল দ্বীপ

আফতাব চৌধুরী

বিড়াল দ্বীপ

প্রচুর ক্যাঙ্গারু থাকার কারণেই দ্বীপটির নামকরণ হয়েছিল ক্যাঙ্গারু আইল্যান্ড। কিন্তু ক্যাঙ্গারু আইল্যান্ডে এখন আর আগের মতো ক্যাঙ্গারু নেই। সেই স্থান দখল করে নিয়েছে বনবিড়াল। পোষা বিড়াল নয়, বনবিড়াল। সমুদ্রসৈকত থেকে শুরু করে সরকারি রাস্তায় পর্যন্ত এদের অবাধ বিচরণ। চলাফেরা করে নির্ভীকচিত্তে কাউকেই তোয়াক্কা করে না। এসব দেখে স্থানীয়দের অনেকেই দ্বীপের নাম পাল্টে 'ক্যাট আইল্যান্ড' রাখার দাবি জানাচ্ছেন। মানুষ মাত্র চার হাজার কিন্তু বনবিড়াল আছে লক্ষাধিক। অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম এ দ্বীপটির মতো অন্য কোথাও এত বনবিড়াল নেই। ধারণা করা হয়েছে বেশির ভাগ মানুষের মতো বনবিড়ালও অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী। এদের উৎস সম্ভবত আফ্রিকা। তবে কে কখন সর্বপ্রথম এদের নিয়ে এসেছিল, সে সম্পর্কে কারও পরিষ্কার ধারণা নেই।

অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল কেপ জারিভস থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে ক্যাঙ্গারু আইল্যান্ডের অবস্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য দ্বীপটি বিখ্যাত। ম্যাথু ফিল্ডার্স দ্বীপটি আবিষ্কার করার পর দ্বিতীয়বার সেখানে গিয়ে যে পরিবেশ দেখে এসেছিলেন তা এখনো প্রায় বহাল আছে। তবে হেরফের ঘটেছে প্রাণীর সংখ্যায়। সিল, ওয়ালাবি ক্যাঙ্গারু ও কোয়েলাসহ বিভিন্ন দেশজ প্রাণী হুমকির সম্মুখীন। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে বনবিড়াল। গলিত মাংস এদের প্রিয় খাবার। ক্যাঙ্গারু মারা যাওয়ার পর এরা খুব আয়েশ করে খায়। দলবদ্ধ হয়ে মানুষের ওপর হামলা চালায়। ক্যাঙ্গারু আইল্যান্ডের অনেক লোক মনে করে, বনবিড়াল তাদের জীবনের বড় এক সমস্যা। কাজেই এদের সংখ্যাকে কমিয়ে ফেলা প্রয়োজন।

যেখানে ইঁদুর থাকবে, সেখানে বিড়ালও থাকবে- এটাই নিয়ম কিন্তু ক্যাঙ্গারু আইল্যান্ডে বিড়ালের ইঁদুরভোজ নেই। বনবিড়াল নিরীহ প্রাণীদের মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে। সে জন্য অনেক ক্ষুদ্র প্রাণীর অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন। সমস্যাটি নিয়ে পরিবেশবাদীরা ইতিমধ্যে সরব হয়ে উঠেছেন। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হেরিটেজ ২০১২ সালে যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছিল তাতে বিড়াল সৃষ্ট নানা সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তাদের আশঙ্কা খুব শিগগিরই দ্বীপটি থেকে কিছু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেকের পরামর্শে প্রচুর পরিমাণে ইঁদুর এনে ছাড়া হোক যাতে বনবিড়াল ভূরিভোজের জন্য অন্য প্রাণীর দিকে হাত না বাড়ায়। ইঁদুর বিড়ালের খেলার মাঝে বেঁচে যাবে সিল, ওয়ালাবি, ক্যাঙ্গারু, ইচিদনা ও কোয়েলা।

বনবিড়াল নিধনের চিন্তাভাবনাও চলছে। নিধনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি রয়েছে পর্যাপ্ত। অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের লোকদের প্রিয় খাবার বনবিড়ালের মাংস। ধারণা করা হয়, সারা অস্ট্রেলিয়ার এ প্রাণীর সংখ্যা প্রায় ১ মিলিয়ন। এরা বছরে হত্যা করছে আনুমানিক এক বিলিয়ন প্রাণীকে। বিষয়টি ভাবার মতোই বটে। এ সমস্যা নিয়ে প্রায়ই হচ্ছে সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম। সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হয়। যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তির মধ্য দিয়েই ইতি ঘটছে। আসা যাচ্ছে না কোনো সিদ্ধান্তে। কেউ কেউ বলেন, বনবিড়ালকে তাদের মতোই থাকতে দেওয়া উচিত। আবার কারও কারও অভিমত, এই প্রাণীগুলোকে হত্যার মাধ্যমে অন্যদের বাঁচতে দেওয়া উচিত।

অস্ট্রেলিয়ার বনবিড়াল হত্যা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ না হলেও নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কেউ কেউ এদের শিকার করেন। এদেরই একজন হচ্ছেন ব্যারি গ্রিন বিড়াল শিকারি হিসেবে তার খুব নামডাক। বনবিড়াল এবং ব্যারি গ্রিনকে নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই ফিচার ছাপা হয়। শিরোনাম দেওয়া হয়- বিড়াল ঘাতক কিংবা বিড়ালবিদ্বেষী। সম্পাদকীয়তে লেখা হয়- 'ব্যারি গ্রিন বিড়াল কমাতে চাইছেন ভালো কথা, কিন্তু এ কাজটি অন্যভাবেও করা যেতে পারে। প্রয়োজনে নেওয়া যেতে পারে বন্ধ্যা করার কর্মসূচি। এদের হত্যা করার পদ্ধতিটি নির্মম ফাঁদে আটক করে হত্যা আর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। উপরন্তু এদের চামড়া দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী বানিয়ে বিক্রি করাটা রসিকতার পর্যায়ে পড়ে। একটা প্রাণীকে নিয়ে রসিকতা করার কোনো অধিকার তার নেই। জীবিকার জন্য এ কাজটি করা তার জন্য আবশ্যক নয়। চাইলে আমরাই তাকে অন্য কাজ বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারি।'

সুরক্ষিত বেড়া নির্মাণ করে নির্দিষ্ট এলাকাকে বিড়ালশূন্য করার চেষ্টা পর্যন্ত হয়েছে; কিন্তু কোনো ফল হয়নি। কিছুদিন পর ঠিকই এসে যায়; গাছ দিয়ে লাফিয়ে চলে আসে। এরা রাতের অন্ধকারে সবার অলক্ষ্যে এ কাজটি করে। আর এক জায়গায় দুটি ভিন্ন লিঙ্গের বিড়াল থাকলে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে জ্যামিতিক গতিতে। কোনো বনবিড়ালই একটি বাচ্চা দেয় না। এই সংখ্যা ছয় পর্যন্ত হতে পারে। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকার ক্ষমতাও বেশি এদের। মূল সমস্যাটা এখানেই। সিল, ওয়ালবি, ইচদনা, কোয়েলার প্রজনন ক্ষমতা অনেক কম। উপরন্তু আছে বনবিড়ালের অত্যাচার। অতএব এদের সংখ্যা তো কমবেই। তবে অনেকেই মনে করেন, হত্যা করে বনবিড়াল কমানোর চিন্তা করাটা আসলে বোকামি। এদের খাবারের অভ্যাসটা পাল্টে দিতে পারলে বরং ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট

 

সর্বশেষ খবর