বুধবার, ১ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ও কিছু কথা

আরিফুর সবুজ

আজ পয়লা জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। মুক্তচিন্তার পাদপীঠ, গণতন্ত্রের সূতিকাগার, ভাষা আন্দোলন আর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা তারুণ্যের অহংকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গর্বের সঙ্গে পার করে ফেলল চুরানব্বইটি বছর। ১৯২১ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার লেখাপড়ার জন্য উন্মুক্ত হয়েছিল, যদিও ১৯১২ সালে রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে গঠিত নাথান কমিশনের মধ্য দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ আরও অনেক গুণীজনের একান্ত প্রয়াসে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে গঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্য লাভ করে। অঙ্ফোর্ডের মতোই শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখে। এ জন্য একে বলা হতো প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড। শুধু লেখাপড়াই নয়, এই দেশ ও জাতির ইতিহাসের সঙ্গেও এর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। জাতির ইতিহাস থেকে একে পৃথক করা অসম্ভব। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশ ও মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মাঝে বপন করে অধিকার সচেতনতা, উদ্বুদ্ধ করে দেশপ্রেমে, গঠন করে অধিকার আদায়ে কঠিন সংগ্রামের মানসিকতা। সবচেয়ে বড় কথা, মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ তৈরির কারিগর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্ত বুদ্ধিচর্চায় এই বিশ্ববিদ্যালয় বিরামহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই। এর শিক্ষার্থীরাই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়গুলোতে অবস্থান করে শক্ত হাতে দেশের হাল ধরে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। তবে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয় হারিয়ে ফেলছে তার সুনাম। বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের তীর্থভূমি এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতে অবস্থান করতে পারছে না। এই না পারা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীই নয়, সমগ্র জাতির জন্যই বেদনাদায়ক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য নতুন নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি ও জ্ঞান বিতরণ করা। জ্ঞান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন গবেষণা; বিশেষ করে মৌলিক গবেষণা। একটা সময় পর্যন্ত এই কাজগুলো সুচারুরূপে সম্পন্ন হলেও বর্তমানে অবস্থা খুবই নাজুক। গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টি যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য, সেখানে গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে পড়ছে তা স্পষ্টতই দৃশ্যমান। কয়েক দশক ধরে গণমানুষের অর্থে পরিচালিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য আশাপ্রদ। তবে বাড়েনি গণমানুষের স্বার্থে পরিচালিত গবেষণা খাতের বরাদ্দ। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতের বরাদ্দের কয়েক বছরের চিত্র দেখলেই তার সত্যতা পাওয়া যায়। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। বাজেটে গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ বাড়লেও গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৪ কোটি ৫০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বছর এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি ১০ হাজার টাকা। এবার বরাদ্দ বাড়লেও তা নিতান্তই অপ্রতুল যা গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে কখনই কাম্য হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড উপাধির মর্যাদা রাখতে হলে গবেষণা খাতের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।

গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টি এবং বিতরণে যে করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য আমাদের সম্মানিত শিক্ষকরা দায় এড়াতে পারেন না। শিক্ষকদের নিজেদের যে রকমভাবে মৌলিক গবেষণাকর্মে নিয়োজিত থাকার কথা তা যেমন তারা থাকছেন না, তেমনি শিক্ষার্থীদেরও তেমনভাবে আগ্রহী করে তুলতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সমাজ সভ্যতা বিনির্মাণের পথ দেখাবে, সমাজের বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে গবেষণা করবে, সমাধানের পথ বের করবে এটাই সমগ্র জাতির কাম্য। কিন্তু আজ শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের কাছেই যেন মৌলিক গবেষণা, মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবর্তে অর্থের পেছনে ছোটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক শিক্ষকই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে কিংবা বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করে অর্থ আয় করছেন, নিজের প্রকৃত দায়িত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, যা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, তারপরও তারা যদি অর্থের মোহে ব্যতিব্যস্ত থাকে তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে লেখাপড়ার মান নিম্নগামী হবে তা স্বাভাবিক। হচ্ছেও তাই। লজ্জার মধ্যে পড়তে হয়, যখন জাতির বিবেক হিসেবে চিহ্নিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তখন। তবে আশার কথা, এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব ব্যাপারে অনেক সচেতন। মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতি, যৌন হয়রানিসহ ঘৃণ্য কর্মের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখনো অনেক শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিমুখী করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশু তৎপর হওয়া প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি বিষয়ের জন্য অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। তা হলো সেশনজটের মারাত্দক সমস্যা থেকে শিক্ষার্থীদের পরিত্রাণ দেওয়া। আগে যেখানে একজন শিক্ষার্থী আট থেকে নয় বছর, কখনো কখনো ১০-১১ বছর সেশনজটের কারণে ক্যাম্পাসের চৌহদ্দিতে আটকে পড়ে থাকত, এখন তারা পাঁচ-থেকে ছয় বছরের মাথায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করে প্রবেশ করতে পারছে পেশাগত জীবনে। এর কারণ সেমিস্টার সিস্টেমের প্রবর্তন। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে আগে যেখানে শুধু ফাইনাল পরীক্ষার আগে কিছু বাছাই করা নোটপত্র মুখস্থ করার প্রবণতা ছিল, এখন তা হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ামুখী হয়েছে। এটা অনেক বড় ব্যাপার। এ ছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোতেও আনা হয়েছে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন অনেক ডিপার্টমেন্ট চালু করা হয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনসহ অনেক নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বিজয় একাত্তর হল ও সুফিয়া কামাল হল তৈরি করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষগুলোকে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। এ বিষয়গুলো উচ্চশিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ।

তবে এখনো অনেক সমস্যায় জর্জরিত গর্বের এই বিশ্ববিদ্যালয়। বেশির ভাগ বিভাগের শিক্ষাক্রমই মান্ধাতা আমলের। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথা ক্রম অগ্রসরমান বিশ্বের চাহিদানুযায়ী শিক্ষাক্রমগুলোতে তেমন পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা সময়োপযোগী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কার্যকর শিখন পদ্ধতির ব্যবহারও হচ্ছে না তেমন। রয়েছে শিক্ষা উপকরণের ঘাটতি যা শ্রেণি-শিখন কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের অন্তরায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে প্রচুর বই থাকলেও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায়শই দেখা যায়, প্রয়োজনের সময় শিক্ষার্থীরা বই পায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত এত বেশি যে, মাঝে মাঝেই কলাভবনের বিভিন্ন ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে দেখা যায়। ফলে শিক্ষকের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের উন্মেষ ঘটানো অনেকটাই দুরূহ হয়ে পড়ে। ডাকসু নির্বাচন ছাত্রছাত্রীদের প্রাণের দাবি হলেও দীর্ঘদিন এই নির্বাচন হচ্ছে না। কোনো এক অজানা রহস্যের আবর্তে, অদৃশ্য শক্তির মায়াজালের কারণে ডাকসু নির্বাচন সুদূরপরাহত হয়ে আছে।

গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশে সব বাধা ছিন্ন করে এই নির্বাচন দেওয়া সময়ের দাবি। প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বজনীন নাগরিক হওয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানান্বেষণের ক্ষুধাকে প্রজ্বলিত করে এসেছে সৃষ্টিলগ্ন থেকে। সচেতন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেমের মন্ত্র প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছিল বেশ সফলভাবেই। যার প্রমাণ গেল শতকের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং জীবনদানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। আজ সেই দেশপ্রেমের মন্ত্রে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় অনেকাংশেই ব্যর্থ বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরিজীবনে দুর্নীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়াই এর প্রমাণ বহন করে। মননশীলতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, নৈতিকতার চর্চা এখন তেমন একটা হয় না। যার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অতীত ঐতিহ্য ধারণ করে বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও সদিচ্ছা।

সর্বশেষ খবর