শুক্রবার, ৩ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

নৈতিকতা বিকাশে সিয়াম সাধনা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

নৈতিকতা বিকাশে সিয়াম সাধনা

মাহে রমজানে রোজা পালনের অতীব তাৎপর্য নির্দেশিত হয়েছে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বোখারী (রহ.) সংকলিত এবং হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে- নবী করিম (সা.) বলেছেন, 'রোজা (যাবতীয় অপকর্ম আর পাপাচার থেকে শরীর ও মনের) জুন্নাহ বা ঢালস্বরূপ। সুতরাং রোজাদার ব্যক্তি অশ্লীল কথা বলবে না বা জাহেলী আচরণ করবে না। কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে উদ্যত হলে বা গালমন্দ করলে সে বলবে, আমি রোজা রেখেছি। কথাটি দুবার বলবে।' মাহে রমজানে সিয়াম সাধনায় ব্যক্তি রোজাদারের জন্য আত্মশুদ্ধির যে সুযোগ আসে তা তার পেশাগত কর্মধারা ও দায়িত্ব কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রেও নৈতিক মূল্যবোধ জাগৃতিতে অনুপ্রেরণা জোগায়। মাহে রমজান ইসলামী বিশ্বে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিশেষ মৌসুম বিবেচনা করা হয়। মাহে রমজানের পরে আসে অন্যতম ধর্মীয় উৎসব 'ঈদুল ফিতর'। সে উপলক্ষে ব্যাপক কেনাবেচায় ব্যাপৃত হয়ে পড়ে সবাই এই মাহে রমজানেই। এই কেনাবেচা তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা ও বিধান অনুসরণ সিয়াম সাধনারই অনিবার্য অংশ। ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ইসলামের বিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। ইসলাম নির্ভেজাল এবং পারস্পরিক কল্যাণ ও সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যবসা-বাণিজ্যকে গুরুত্বসহকারে শুধু অনুমোদনই করে না, বরং সে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনাকে ইবাদততুল্য কল্যাণকর আখ্যা দিয়েছে। এতদসংক্রান্ত আল কোরআনের ভাষ্য এই : 'আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ ও সুদকে অবৈধ করেছেন' (২ সংখ্যক সূরা বাকারা। আয়াত ২৭৫) হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সর্বাপেক্ষা পবিত্র রোজগার হচ্ছে ব্যবসায়ীদের রোজগার। তবে শর্ত হচ্ছে, 'তারা যখন কথা বলবে তখন মিথ্যা বলবে না। কোনো আমানতের খেয়ানত করবে না। কোনো পণ্য ক্রয় করার সময় সেটাকে মন্দ সাব্যস্ত করে মূল্য কম দেওয়ার চেষ্টা করবে না। নিজের মাল বিক্রয় করার সময় সে মালের অযথা তারিফ করে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করবে না। তার নিজের কাছে অন্যের ধার থাকলে পাওনাদারকে অযথা ঘুরাবে না। অপর পক্ষে, সে কারও কাছে কিছু পাওনা হলে তাকে উত্ত্যক্ত করবে না।'

সিয়াম সাধনায় মানুষের স্বভাবে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয়। কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি সিয়াম সাধনার একটি অন্যতম তাৎপর্য। আর আত্মশুদ্ধি মানব চরিত্র সংশোধন ও বিকাশের উৎকৃষ্টতম উপায়। আত্মশুদ্ধির দ্বারা ব্যক্তি তথা সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে স্বচ্ছ সুদৃঢ় স্বকীয় সত্তার। রোজা পালনের দ্বারা মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি ও তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হয়। রোজার দ্বারা মানুষের স্বভাবে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয় এবং দূরদর্শিতা আরও প্রখর হয়। চারিত্রিক মাহাত্ম্য, নৈতিক পরিচ্ছন্নতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, আত্মিক পবিত্রতা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো রোজা। সিয়াম সাধনায় মানুষের ইমান দৃঢ় হয়। তাকওয়া বা খোদাভীতি যেমন গুনাহর কাজ করে রোজা নষ্ট করা থেকে রোজাদারের অন্তরসমূহকে পাহারা দিয়ে থাকে তেমনি রোজা পালনের মাধ্যমে তার চিন্তাচেতনায় যে উপলব্ধি আসে তা থেকে সে সন্ধান পায় তার জীবনবিধানের সেই রূপরেখা, ইসলাম যা মানবজীবনের জন্য প্রত্যাশা করে। রোজার আত্মিক, শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক তাৎপর্য সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ ইমান প্রতিষ্ঠার পটভূমি, প্রেক্ষাপট ও প্রত্যয় জন্ম দিয়ে থাকে।

অপচয় অপব্যয় ব্যষ্টি ও সমষ্টির সামগ্রিক অবয়বে অনির্বচনীয় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সিয়াম সাধনা অপচয় অপব্যয়ের অপব্যবস্থা ও অভ্যাস থেকে বিরত থাকার তাগিদ দেয়, সুযোগ এনে দেয়। স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে এ কথা সর্বজনবিদিত যে সময় সম্পদ ও সুযোগের সুষম ব্যবহারে সাফল্য সুনিশ্চিত হয়। আল কোরআনে অপচয় অপব্যয় ও অমিতাচার থেকে দূরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, 'এবং যারা মানুষকে দেখানোর জন্য তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে না আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না আর শয়তান কারও সঙ্গী হলে সে সঙ্গী কত মন্দ।' (৪ সংখ্যক সূরা নিসা। আয়াত ৩৮) যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়। (২৫ সংখ্যক সূরা ফুরকান। আয়াত ৬৭)

মাহে রমজানে কৃচ্ছ্র সাধনের দ্বারা জীবনযাপনে যে মূল্যবোধ জাগ্রত হয় তার সারমর্ম হলো- স্থায়ী কল্যাণ লাভের জন্য সাময়িক ভোগবিলাসকে পরিহার করা এবং ব্যক্তি, সমাজ ও সংসারে সাম্য-সহনশীলতা-সমন্বয়ের উপলব্ধিকে পরিব্যাপ্ত করা। অস্থায়ী পার্থিব জীবনের প্রতি অস্বাভাবিক মোহ এবং আসক্তি চিরস্থায়ী পারলৌকিক জীবনের প্রতি ঔদাসীন্য বাড়িয়ে তোলে। ইবনে কাসির, তিরমিজি এবং আহমদ সংকলিত হাদিসে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে শিখখীর (র.) বর্ণনা করেছেন, আমি একদিন রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পৌঁছে দেখলাম, তিনি সূরা তাকাসুর তেলওয়াত করে বলছিলেন : 'মানুষ বলে, আমার ধন, আমার ধন, অথচ তোমার অংশ তো ততটুকুই যতটুকু তুমি খেয়ে শেষ করে ফেল অথবা পরিধান করে ছিন্ন করে দাও অথবা সদকা করে সামনে পাঠিয়ে দাও। এ ছাড়া যা আছে, তা তোমার হাত থেকে চলে যাবে-তুমি অপরের জন্য তা ছেড়ে যাবে।' বোখারি শরিফে হজরত আনাস (রা.) বর্ণিত, অন্য এক রেওয়াতে আছে- 'আদম সন্তানের যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকা থাকে, তবে সে (তাতেই সন্তুষ্ট হবে না, বরং) দুটি উপত্যকা কামনা করবে। তার মুখ তো (কবরের) মাটি ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা ভর্তি করা সম্ভব নয়।'

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, বর্তমানে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান

 

 

সর্বশেষ খবর