শনিবার, ৪ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

ফল হোক নিরাপদ

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

ফল হোক নিরাপদ

গ্রীষ্মের খরতাপের এ মৌসুমটিকে মধুমৌসুমও বলা যেতে পারে। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, লটকন, তরমুজ, কচিতাল, গোলাপজাম, অরবরই, বাঙ্গি, তেঁতুল, গাব, পেয়ারা, জামরুল, জাম্বুরা, আতা, করমচা ও কলাসহ ইত্যাদি দেশি রসালো, মজাদার ও বাহারি জাতের ফলমূল এ মৌসুমকে দিয়েছে বিশেষ মর্যাদা। কলা সারা বছরের একটি ফল হওয়া সত্ত্বেও এ মৌসুমে কলার ফলন সবচেয়ে বেশি হয়। আর কলা পাকানোর জন্য এরমধ্যে অমানবিকভাবে ও নির্বিচারে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কলা কিনে দুয়েকদিন রেখে দিলে দেখবেন, বাইরে পাকা সুন্দর রং হলেও ভিতরে শক্ত, কষটে, গুটিগুটি দাগ এবং আরেকটু বেশি সময় থাকলে খুব তাড়াতাড়ি পচে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে অফিসে আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন যে, এ মৌসুমে একটি তরমুজ কিনে বাসায় নিয়ে কেটে খাওয়ার পর সবার মুখ-জিহ্বা-দাঁত নাকি অনেকক্ষণ লাল হয়েছিল। অথচ আমি নিজে একজন কৃষিবিদ হিসেবে জানি যে, পাকা তরমুজে থাকে ন্যাচারাল কালার, এ কালার কখনো লেগে থাকার কথা নয়। সহজেই বোঝা যায়, ওই তরমুজকে লাভজনকভাবে বিক্রির জন্য অবশ্যই অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী নামক মানুষখেকোরা এতে লাল রং মিশিয়েছে এবং তাও আবার ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে। আম এবং লিচুর মধ্যে ফুল অবস্থা থেকেই পোকা-মাকড় দমনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক বিভিন্ন মাত্রায় চাষিরা প্রয়োগ করে থাকেন। এক্ষত্রে ডাক্তারি ভাষায় ও চিকিৎসামতে যেসব রোগের জন্য সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, তার নির্ধারিত সময়ের একটি কোর্স থাকে। বলা হয়ে থাকে যে, যদি অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ না হয় তবে সেই রোগের রেজিস্ট্যান্স গ্রো করে। কীটনাশকের ক্ষেত্রেও এরকম হতে হতে এখন প্রত্যেকটি ওষুধেরই রেজিস্ট্যান্স গ্রো করাতে মাত্রাতিরিক্ত হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্বাভাবিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার কিন্তু কৃষকদের ফসল রক্ষায় বৈজ্ঞানিক পরামর্শ হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারই আমাদের ভোক্তা-নাগরিকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঁঠালে তেমন কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। অন্যান্য দেশি ফলমূলে সাধারণত কোনোরকম কীটনাশকই ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না বিধায় এখন বিশেষজ্ঞরা বেশি করে দেশি ফলমূল খাওয়া ও আবাদ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। ফলে মূলত তিন স্তরে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার হয়ে থাকে। তা হলো (১) প্রাথমিক অবস্থায় রোগ-বালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার, (২) জোর করে ফল পরিপক্ব হওয়ার আগে ও তাড়াতাড়ি পাকানোর জন্য কার্বাইড জাতীয় রাসায়নিক ব্যবহার এবং (৩) পচন রোধ করে দীর্ঘসময় সংরক্ষণের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন ব্যবহার। তাছাড়াও অনেক সময় গাছে বেশি ফল ধরা ও বেশি ফল টিকে থাকার জন্যও হরমোন স্প্রে করা হয়ে থাকে। ভাবলে আসলে গা শিহরিত হয়ে উঠারই কথা। কারণ এ বিষয়গুলোর ক্ষতিকর প্রভাব খুব সহজেই শেষ হয়ে যায় না। সাত দিন থেকে শুরু করে এসব কীটনাশকের প্রভাবের মেয়াদ সাত বছর পর্যন্তও হতে পারে, আবার কোনো কোনোটির প্রভাব কখনই শেষ হয় না। সেজন্য ডিডিটি, এনড্রিনর মতো কীটনাশক বাংলাদেশে আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও চোরাইপথে এখনো এ ধরনের ঘাতক ওষুধ আমদানি করে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ব্যবহার করে যাচ্ছে। আসলে মানুষ নিজে থেকে যার যার জায়গায় সতর্ক না হলে কোনো আইনপ্রয়োগের মাধ্যমেই এসব অপরাধ নিধন করা সম্ভব নয়। তারপরও আশার কথা, বিগত কয়েক বছর যাবৎ এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন সংগঠনের যথাযথ তৎপরতার কারণে পূর্বের তুলনায় রাসায়নিক ব্যবহার অনেকটা কমে এসেছে। এখন চাষি, মধ্যস্বত্বভোগী, আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, আড়তদার সর্বোপুরি ভোক্তারা সচেতন হওয়ার কারণেই এরকম ফল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এতেও আমরা ভোক্তা হিসেবে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছি না এজন্য যে, আমরা একেবারে রাসায়নিকমুক্ত ফল খেতে চাই যা একটু আন্তরিক হলেই পাওয়া সম্ভব। তবে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করার কারণে আতঙ্কে একেবারে ফল খাওয়া ছেড়ে দিলাম এটা আবার বাড়াবাড়ি কিংবা না বোঝে চিলে কান নেওয়ার মতো অবস্থা। সম্প্রতি ওয়ালমার্ট নামের একটি বহুজাতিক বিদেশি আমদানিকারক কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে আম আমদানি করেছে। উক্ত আমদানি করা আমের নমুনা পরীক্ষা করে তাদের দেশের জন্য সহনীয় মাত্রায় ফরমালিন পেয়েছে যা কোন অবস্থাতেই স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ নয়। কারণ আম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি ফলে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু ফরমালিন তৈরি হয়। আমাদের দেশে এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য প্রমাণ কোনো যন্ত্রপাতি না থাকায় (যা মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট থেকেও আদেশ দেওয়া আছে) গত কয়েক বছরে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অনেক তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে অহেতুক হয়রানি ও আতঙ্ক বেড়েছে। আমার মতে, যদি কিছু রাসায়নিক থাকেও সে জন্য মৌসুমী এ রসালো ফলগুলো খাওয়া বাদ না দিয়ে সহজেই গ্রহণ করা উচিত। কারণ একেকটি নির্দিষ্ট ফলে একেকটি নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান থাকে যা শুধু ওই নির্দিষ্ট ফল খেলেই কেবল পূরণ হওয়া সম্ভব, অন্যথায় নয়। সেজন্য রাসায়নিকের কবল থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য ফলগুলো খাওয়ার আগে আধাঘণ্টা থেকে ঘণ্টাখানেক বড় একটি বোল কিংবা বালতিতে ডুবন্ত পরিষ্কার পানিতে ভিজিয়ে পড়ে কেটে খেলে রাসায়নিক বিষক্রিয়া অকেটাই কমে যাবে। সেজন্য আমার পরামর্শ হলো মানুষের উড়া কথায় কান না দিয়ে নির্দ্বিধায় দেশি এসব রসালো ফল খেয়ে যান এবং কৃষক, উৎপাদক, ব্যবসায়ীকে বাঁচিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করুন। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ব্যাপারে যথাসাধ্য সতর্ক থাকার জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হলো। আর পবিত্র এ রমজান মাসে সারাদিন প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা খালিপেটে থাকার কারণে এমনিতেই পেটের স্বাভাবিক সহ্যক্ষমতা হ্রাস পায়। সেজন্য এ মাসে ব্যবসাকে শুধু ব্যবসা হিসেবে না দেখে জনস্বার্থে অন্তত ফল-ফলাদিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো থেকে থাকার সনির্বন্ধ অনুরোধ রইল। তাহলে ব্যবসার পাশাপাশি আধ্যাত্দিক লাভ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। -লেখক : কৃষিবিদ।

 

সর্বশেষ খবর