রবিবার, ৫ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

পরিমিতি, পাঞ্জাবি ও মুরগি

আবু তাহের

পরিমিতি, পাঞ্জাবি ও মুরগি

হজরত আলী (রা.) বলে গেছেন, 'শত্রুর সঙ্গে পরিমিত শত্রুতা কর কারণ সে এক সময় তোমার বন্ধু হয়ে যেতে পারে। বন্ধুর সঙ্গে পরিমিত বন্ধুত্ব কর, কেননা সেও তোমার শত্রু হয়ে যেতে পারে।' উপদেশটা গভীর তাৎপর্যবাহী। চেষ্টা করে চলেছি মেনে চলতে। সুযোগ পেলে অন্যদেরও উদ্ধৃতিটা শুনিয়ে বলি, অনুশীলন কর। উপকার পাবে।

'তুই পাইছত নি?' জানতে চেয়েছেন বাল্যবন্ধু আবদুল করিম মিন্টু। বললাম, 'পাইছি কিছুটা।' মিন্টু বলেন, 'একজাম্পল দে।' দুনিয়াটা এরকমই। হিতকথা বললেই মানুষ হাতেনাতে প্রমাণ চায়। মিন্টুর সামনে দুটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছিলাম।

দৃষ্টান্ত এক. তবিবুর রহমান কদম। পাবনার এই সন্তানটি এমএ পাস করে আয়রোজগারের কোনো উপায় না দেখে মফস্বল কলেজের শিক্ষক হয়। বেতন এতই অনিয়মিত যে দুঃখে গলায় দড়ি দিতে মন চায়। বাধ্য হয়ে সে ঢাকায় এসে আমার কর্মস্থলে প্রবেশ করে। তা করতেই পারে। কর্মস্থলটি তো আমার পৈতৃক সম্পত্তি নয়। প্রবেশ করার সময় কদমের সঙ্গে ছিল অপরিসীম উচ্চাকাঙ্ক্ষা। বাঙালি অধ্যুষিত কর্মস্থল মাত্রই কর্মবিমুখ অদক্ষদের জোট বিরাজ করে। কদম অদক্ষ নয়। তবু সে ওই জোটের মিত্র হয়ে যায়। জোটের সদস্যরা হবে সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে কদম আকাশে ওঠার স্বপ্ন দেখে। কর্মস্থলের মগডালে বসা কর্মকর্তাকে ভজনতোষণে আত্মনিয়োগ করল কদম। মগডালের মহাজন জিরো থেকে হিরো হওয়া সিদ্ধপুরুষ। কিন্তু ভঙ্গিমায় বোঝান যে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন হিরো, থাকবেন হিরো। বলেন, 'আহারে! জিরোদের কী কষ্ট!' কদমকে আদর করে 'টিআর' বলেন হিরো। টি ফর তবিবুর/আর ফর রহমান। কর্মস্থলের ফাজিল যুবকরা বলল, চিপা চিগ চিলে চিচি চিনে চিছা চিগ চিল। অর্থাৎ পাগলে চিনে ছাগল।

আমার কর্মগুরু আওয়াল খান আপত্তি করলেন। বললেন, কোন্ যুক্তিতে ওরা হিরোকে পাগল বলছে? হিরো কি এমন অর্ডার দিয়েছেন যে, 'কাউকে অফিসে আসতে হবে না। মাসের এক তারিখে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেতন পৌঁছে দিব।' তাঁর আরও প্রশ্ন, উনি কি ব্যাংক থেকে লাখ লাখ টাকা ড্র করে সেগুলো রাস্তায় রাস্তায় ছিটিয়ে দেন আর বলেন, 'কী সোন্দর উড়ে আমার তেজপাতা!' কর্মগুরু বলেন, 'তোমরাই পাগল। তাই বুঝতেই পারছ না যে টি-আর হয়ে গেছে লাঠি। এই লাঠির ঘায়ে তোমাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন নস্যাৎ করে দেওয়ার ফন্দি অাঁটছেন হিরো।' হঠাৎ ৪টি ইনক্রিমেন্ট পেয়ে গেল টি-আর। প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কুৎসাচার শুরু করল আমার নামে। ক্রুদ্ধ হয়ে ওর ঠ্যাং ভেঙে দেওয়ার প্ল্যান করলাম। রবিঠাকুর অশিক্ষা-কুশিক্ষা অনাচার ভ্রষ্টাচার কুসংস্কারকে সমাজপ্রগতির পথে 'বাঁধ' মনে করে ডাক দিয়েছিলেন, 'বাঁধ ভেঙে দাও/বাঁধ ভেঙে দাও।' ওই বাঁধ না ভেঙে একটা অর্ডিনারি সিটিজেনের ঠ্যাং ভাঙায় মনোযোগী হওয়া মানে যে যৎসামান্য প্রতিভা আছে তার ভয়ানক অপব্যবহার। এই বোধ দ্বারা চালিত হয়ে কদমের সঙ্গে দুশমনি করলাম পরিমিত।

কর্মনিষ্ঠদের একটা জোট গড়লাম। জোটের সদস্যরা টি-আর সমর্থিত জোটের সদস্যদের দুর্বল দিকগুলো সবল ভাষায় উচ্চারণ করতে লাগল। তারা আমায় বলল, 'ঠ্যাং ভাঙতে আপনার মন চাইছে না অলরাইট। ভাঙতে হবে না। ফাটান।' কী ফাটাব? তারা বলল, 'কী আবার! টি-আরের মাথা।' এই পরিস্থিতিতে এক বিকালে কর্মনিষ্ঠ জোটের দুই সদস্য রমিজ ও রশিদকে রমনা পার্কে পেয়ে কদম বলে, 'য়্যাই! তোমরা নাকি সাংকেতিক ভাষায় চিগাচিগা করে আমাকে 'ছাগল' বল?' ওরা বলে, 'জ্বে! বলি কদম ভাই।' কুপিত কদম হাই ভলিউমে গর্জে ওঠে, 'বাট হোয়াই?'

'আওয়াজ নিচে।' বলে রমিজ। 'বেশি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতেছেন। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করণেরও একটা লিমিট আছে'- বলে রশিদ। রমিজ বলে, 'বেশি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে যে ছাগল তারে জবাই কইরা খায়া ফেললে ছাগল সমাজ দুঃখ পাবে না। দুঃখ নাই মিন্স কান্নাও নই।' রশিদ বলে, 'ভালোই হইছে। আমি আবার ছাগলের কান্না সইতে পারি না।' এ ঘটনার পর কদম সংযত হয় এবং মাস তিনেকের মধ্যে সুইডেন চলে যায়।

২০০৯ সালে পারিবারিক এক বিপর্যয় আমাকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে উন্মাদ হওয়ার দশা। সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা : টাকা কোথায় পাই/ টাকা কোথায় পাই। নিবিড় বন্ধুত্বের বশবর্তী ছিলাম বলে যাদের সংকট মোচনের জন্য গলাসমান পানিতে নেমেছি, তারা আমার জন্য গোড়ালিসমান পানিতেও নামতে আগ্রহী নয়। যাদের কখনো কানাকড়ি উপকারে লাগিনি তারা আমায় উদ্ধার করার জন্য উতলা হয়েছে। দাবদাহ বিনাশে হিমশীতল বর্ষণের মতো স্বস্তিদায়ক ছিল তাদের আচরণ। এ সময় হঠাৎ কদমের ফোন পাই। সে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়। ঘোষণা করে, আমার জন্য সে তার যথাসাধ্য করবে। এবং করেছেও।

দৃষ্টান্ত দুই. পটুয়াখালীর সন্তান সিরাজ তালুকদার। জগৎ সংসারে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা মনে করে 'তোমার সঙ্গে আমার দোস্তি হয়েছে, এখন তোমার কর্তব্য হচ্ছে অবিরাম আমার খেদমত করা।' তালুকদার এই শ্রেণিভুক্ত। সে খেদমত গ্রহণে নিপুণ, প্রদানে অতিশয় কুণ্ঠ। ওর খেদমত করতে করতে বন্ধুরা ক্লান্ত। সে আমাকে কী কারণে 'অক্লান্ত' মনে করেছিল তা আজও একটা রহস্য। একদিন তালুকদার আমায় বলল, 'শুনলাম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মা-বাবা স্বরূপ বাঘা আমলাটি তোমার মামা। উনাকে বলে আমার ব্রাদার-ইন-ল সাজ্জাদকে কাস্টমস ডিপার্টমেন্টে ঢুকিয়ে দাও।'

'শুনলেই ঢুকিয়ে দিতে হবে, এটা কোনো সিস্টেম হলো?' বলতেই সিরাজ তালুকদার বলে, 'আমার ফাদার-ইন-ল মসজিদের সামনে খোরা হাতে বইসা থাকা ফকির মনে কর? তোমার মতো গাবুররে উনি টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্সে ফর্টি এইট টাইমস সেল অ্যান্ড পারচেজ করার হ্যাডম রাখেন হেইয়া বোঝো?' কামটা করে দিলে ওর শ্বশুর আমাকে মোটা অঙ্কের এমন একটা ইয়ে দেবে যা নাকি আমার কল্পনার অতীত।

মামাটির সঙ্গে তখন আমার আড়ি চলছিল। আড়ি না থাকলেও কেস এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। নিয়মনীতির বাইরে তিনি কখনোই কিছু করেন না। চাকরি জীবনের কোনো স্তরেই 'ইয়ে'র লোভে কাতর হননি। স্বজনদের অন্যায় আবদার শুনলে রেগে গিয়ে স্পিকটি নট হওয়া তার স্টাইল। ভুল বললাম, স্পিক পুরোপুরি নট হয় না। দম মেরে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বলেন, 'আর কখনোই এ ধরনের রিকোয়েস্ট আমায় করবে না। নেভার এভার।'

'তোমার এই মামার মতো অনেস্ট আমলা যদি ডজন দশেক থাকত, তাহলে দেশটা জান্নাতুল ফেরদাউসের চেহারা পাইয়া যাইত।' বলল সিরাজ তালুকদার। এরপর সে বদের হাড্ডি হাফ ডজন আমলার কুকীর্তির রসালো বৃত্তান্ত দেয়। কিন্তু ঘুরেফিরে আবার শ্বশুরের পুত্রের সদগতিতে মনোযোগী হয়। বলে, এক কাম কর। মামীজানরে ধর। মামীজান কন্টিনিউয়াস ঘ্যানর ঘ্যানর করলে মামাজান অ্যাকটিভ হতে বাধ্য। সেই যে কথায় আছে না 'রাজা করিছে রাজ্য শাসন/রাজারে শাসিছে রানী!' হ্যাঁহ্... হ্যাঁহ্... হ্যাঁহ্... হ্যাঁ...।

শৈশবে পড়েছি, 'তাই তাই তাই/মামাবাড়ি যাই/ মামী এলো লাঠি নিয়ে পালাই পালাই।' আরও পড়েছি 'ম': 'মামা ভালো/মামী নয়/' ভালো মামা পাত্তা দেয় না, মামী দেবে? যদি দেনও সেক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলতে পারেন, নিজের শালা তো নয়। বন্ধুর শালার জন্য প্রেশার দিচ্ছ, এটা তো বিশ্রী দেখায়।

তালুকদার এসব যুক্তিতে দমে না। তালুকদাররা এমনই হয়। তারা নিজেরটা বোঝে বাইশ আনা অন্যেরটা চার আনাও নয়। প্লাবনে প্লাবনে ধরা যদি হয় নিঃস্ব, তখনো তারা মুঠোয় নিতে চায় বিশ্ব। এই প্রকার তালুকদাররা, সেদিন টেলিভিশনের টকশোতে এক পণ্ডিত বললেন, দেশের রাজনীতিকে ফোকলা করে দিচ্ছে।

শ্যালক সেবায় ব্যর্থ সিরাজ তালুকদার আমায় ত্যাগ করেছে। ওর সঙ্গে বন্ধুত্বের মাত্রাটা বেশি হয়ে যাওয়ায় প্রকৃতি ওকে আলগা করে নেয়। ২০০৯ সালে আমার ঘোরতর আপদকালেও সে দেখা দেয়নি। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব যে আমি, তা লোকজনের মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য দুঃখময় ওই সময়েও সে সচেষ্ট ছিল, আজও আছে, কবরে গেলেও সচেষ্ট থাকবে মনে হয়।

'তুই হ্যাতারে ওয়াকওভার দিতেছস কিয়েল্লাই?' বলেন বাল্যবন্ধু আবদুল করিম মিন্টু, 'মাঠে নাইমা পড়। কবি নজরুলের সাজেশন মতো কাম কর। নজরুল কইছেন- পানসে বন্ধুত্বের চাইতে চুটিয়ে শত্রুতা ঢের ভালো।' মিন্টু জানতে চেয়েছিলেন, সিরাজ তালুকদার টাইপের জিনিস আর কয় পিসের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছে। না, মোলাকাত হয়নি। তবে গন্ধ পেয়েছি। দ্বিতীয় পিস হলেন পেশাদার লিডার। এবং লক্ষ্যাভিসারী নিষ্ঠাবান পুঙ্গব। 'নিজেরটা বাইশ আনা, অন্যেরটা এক আনাও নয়' নীতির সাধক।

লিডারের নাম জব্বর। তার সহচর থেকে জেনেছি তার লক্ষ্যার্জন নিষ্ঠার কাহিনী। যেমন : লিডার গোলটেবিল বৈঠকে ভাষণ দিতে গেলেন। মঞ্চে তার পাশে বসা বক্তা অনুচ্চ স্বরে বললেন, 'জব্বর ভাই। কী পাঞ্জাবি পরেছেন! রং চটে গেছে।' লিডার বলেন, 'আমার তো একটিই পাঞ্জাবি। তুমি আমারে গুলশান মার্কেট থেকে আট হাজার টাকা দিয়া একটা পাঞ্জাবি কিনে দাও না।'

আরেক গোলটেবিল। মঞ্চে লিডারের পাশে বসা আলোচক বললেন, 'জব্বর ভাই, ফার্স্ট ক্লাস একখান পাঞ্জাবি পরেছেন। যা সুইট লাগছে! একেবারে সুপারস্টার রাজেশ খান্নার মতো।' জব্বর লিডার বলেন, 'ভাইরে আমার তো এই একটাই পাঞ্জাবি। তুমি দশ হাজার টাকায় আমারে এরকম সিম্পল একটা পাঞ্জাবি কিইনা দাও না ভাই।'

'আমগো স্যারের সব সময় এক জবান' বলেন সহচর, 'পয়েন্টের থন নড়ন চড়ন নাই। পাঞ্জাবি একটা মুফতে পাওনের আগ পর্যন্ত লিডাররে থামানোর ক্ষ্যামতা আছে কোন ব্যাডার!'

এখানে টার্গেট পাঞ্জাবি। একাত্তরে পাকিস্তানি মিলিটারির টার্গেট মুরগি। এম আর আখতার মুকুল বলেছিলেন সেই মুরগি কাহিনী।

মিলিটারিরা মাগনায় মুরগি সংগ্রহের জন্য গ্রামে ঢুকেছে। কৃষকের বাড়িতে ঢুকে বলল, 'তোমার মুরগিগুলোকে কী খাওয়াও।' কৃষক ভাবে এই হারামজাদারা তো গমের আটা দিয়ে রুটি বানিয়ে খায়। গমের কথা বললে খুশি হবে। তাই বলল, 'গম খাওয়াই হুজুর।' মিলিটারি দিল পিটুনি। মানুষ পায় না গম। আর তুমি খাওয়াও মুরগিকে! পিটুনি দিয়ে দশটি মুরগি নিয়ে গেল। ঘটনাটা পাশের বাড়ির কৃষক জানে। তার বাড়িতে মিলিটারি ঢুকলে সে জানায়, 'আমার মুরগিকে চাল খাওয়াই হুজুর।' গর্জে উঠে মিলিটারি, 'মানুষ চাল খেতে পায় না। আর তুমি খাওয়াও তোমার মুরগিকে!' পিটুনি দিয়ে নিয়ে গেল দশটি মুরগি। মুরগির থনে নড়ন চড়ন নাই।

আরেক কৃষকের বাড়ি গেলে সে মিলিটারিকে বলে, হুজুর আমি রোজ সকালে প্রত্যেক মুরগিকে একটা করে আধুলি দিয়ে বলি, যাও। গম আর চাল বাদে যা ইচ্ছা দোকানে গিয়ে কিনে খাও।' মিলিটারি বলে, 'বহুত আচ্ছা! তো আভি হামলোগকো দশঠো কারকা (মুরগি) দে দো।'

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর